অঙ্কে ভুল করলে শিক্ষক ছাত্রকে তিরস্কার করে বলেন, ‘এই সাধারণ বিষয়টাও বুঝতে পারছ না? এ তো পানির মতো সোজা। ’ ‘পানির মতো সোজা’ বা ‘জলের মতো সহজ’—এই বাক্যাংশ আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে এমনভাবে ব্যবহূত হয়ে আসছে যে পানির সহজলভ্যতার ব্যাপারে আমাদের মনে কোনোরকম সন্দেহের উদ্রেক হয় না। কিন্তু সেদিন আর হয়তো বেশি দূরে নেই, যেদিন কোনো উপমা দিতে গিয়ে আমাদের বলতে হবে, ‘পানির মতো কঠিন’।
বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যেই হুঁশিয়ার করে বলেছেন, খাবার পানির জন্য একুশ শতকের মাঝামাঝিতেই আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে গৃহযুদ্ধ লেগে যেতে পারে। পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগজুড়ে পানি থাকলেও এক গ্লাস পানির জন্য মানুষকে রীতিমতো সংগ্রাম করতে হবে।
পানিই হবে শ্রেষ্ঠ সম্পদ।
সামনে মহাসংকট
বিবিসির পরিবেশবিষয়ক প্রতিবেদক অ্যালেক্স কারবির বেশ কয়েকটি গবেষণামূলক প্রতিবেদনে তিনি যেসব তথ্য দিয়েছেন তা রীতিমতো আঁতকে ওঠার মতো। পরিবেশবিজ্ঞানীদের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেছেন, এখনই ব্যবস্থা না নিলে শুধু খাবার পানির অভাবে বিশ্বে প্রতিদিন লক্ষাধিক মানুষ মারা যাবে।
‘ডন অব এ থাস্ট্রি সেঞ্চুরি’ (একটি তৃষিত শতকের ভোর) শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে কারবি বলেছেন, পৃথিবীতে যে পরিমাণ পানি রয়েছে তার মাত্র ২ দশমিক ৫ শতাংশ পানি লবণমুক্ত অর্থাত্ পান করার উপযোগী। পানযোগ্য এই সামান্য পরিমাণ পানির দুই-তৃতীয়াংশ আবার মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে জমাট বরফ অবস্থায় রয়েছে।
বাকি থাকল যে এক-তৃতীংয়াংশ, তার ২০ শতাংশ আবার জনবসতি থেকে এতটাই দূরে যে তার নাগাল পাওয়া দুঃসাধ্য।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, পৃথিবীতে যত পানি রয়েছে তার ০.০৮ শতাংশেরও কম পরিমাণ পানি মানুষের ব্যবহারের আওতায় আছে। অথচ আগামী দুই দশকের মধ্যে পানির চাহিদা বেড়ে যাবে ৪০ শতাংশ।
জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক কার্যক্রম ইউএনইপি (ইউনাইটেড নেশনস এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম) এক প্রতিবেদনে বলেছে, ৫০টি দেশের ২০০ জন বিজ্ঞানী নতুন সহস্রাব্দের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দুটি ভয়াবহ সমস্যার কথা উল্লেখ করেছেন। এর একটি হলো খাবার পানির সংকট, অন্যটি হলো বৈশ্বিক উষ্ণতা।
জাতিসংঘের ২৩টি সংস্থার দেওয়া তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ইউনেসকোভিত্তিক ওয়ার্ল্ড ওয়াটার অ্যাসেসমেন্ট প্রোগ্রাম (ডব্লিউডব্লিউএপি) ঘোষণা দিয়েছে, শুধু পানির সংকটের কারণেই ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব গড়তে আরও অন্তত ৩০ বছর সময় লাগবে। ডব্লিউডব্লিউএপি মনে করে, বিশ্বে বর্তমানে একজন মানুষ গড়ে যতটুকু বিশুদ্ধ পানি পায়, ২০২০ সাল নাগাদ তার তিন ভাগের এক ভাগ পাবে।
সংস্থাটি বলছে, লবণমুক্ত যতটুকু পানি বিশ্ববাসীর হাতে রয়েছে, তার ৭০ শতাংশ পানি ব্যবহার হয় কৃষিকাজে। বাকি ৩০ ভাগ দিয়ে খাওয়া, শিল্প-কারখানার কাজ চালানো ও অন্যান্য প্রয়োজন মেটানো হয়।
ওয়ার্ল্ড ওয়াটার কাউন্সিল বলছে, জনসংখ্যা যেভাবে বাড়ছে, তাতে মানুষকে বেঁচে থাকার জন্য আরও বিপুল পরিমাণ ফসল উত্পাদন করতে হবে।
ওই বাড়তি উত্পাদনের জন্য বর্তমানের চেয়ে ১৭ শতাংশ বেশি পানি দরকার হবে।
বর্তমান বিশ্বে প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন মানুষ বিশুদ্ধ খাবার পানি পায় না। বিশুদ্ধ পানির অভাবে প্রতিদিন ৩০ হাজার শিশু তাদের পঞ্চম জন্মদিন উপভোগ করার আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়।
এই ভয়াবহ তথ্যের পাশাপাশি আছে বাড়তি জনসংখ্যার অন্ন সংস্থান করতে চীন ব্যাপক হারে চাষাবাদ শুরু করেছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এক টন গম উত্পাদনের জন্য চীন সরকারকে এক হাজার টন পানি খরচ করতে হয়।
হাজারো কারণে পৃথিবী এই সংকটের দিকে যাচ্ছে। এর মধ্যে মূল তিনটি কারণ হলো জনসংখ্যার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, উন্নত জীবন মানের আকাঙ্ক্ষা ও অপচয়। প্রথমোক্ত দুটি বিষয় বিবেচনাপ্রসূত হলেও অপচয়ের বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। অপচয় ছাড়াও দূষণের মাধ্যমেও সুপেয় পানি নষ্ট করা হচ্ছে।
কলকারখানা ও মনুষ্যবর্জ্য কী পরিমাণ স্বাদু পানি নষ্ট করছে, তার একটি বড় চাক্ষুষ প্রমাণ আমাদের ঢাকা শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ঐতিহাসিক বুড়িগঙ্গা নদী।
ঢাকা শহরের যাবতীয় বর্জ্য দিনের পর দিন এই নদীর বুকে ঢালা হচ্ছে। কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য, মলমূত্র—কী ফেলা হচ্ছে না সেখানে? এর ফলে বুড়িগঙ্গার পানি খাওয়া তো দূরের কথা, দুর্গন্ধে এর পাশ দিয়ে হাঁটাও অসম্ভব।
দুই দশক আগে ‘এ দেশে পানি বিক্রি হবে’—এ কথা কেউ ভাবতে পারেনি। সেই সুজলা দেশে এখন বোতলজাত পানি ও দুধের দাম প্রায় সমান। আরও দুই দশক পরে কী অবস্থা হবে, সেটা বড় ধরনের গবেষণার বিষয়।
জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলেস, চীনের উত্তরাঞ্চল, ভারত, আলজেরিয়া, ইরান, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে খাবার পানির সংকট তীব্র আকার নেবে। গঙ্গা, সিন্ধু, ব্রহ্মপুত্র, ইয়াংসি, মেকং—এ নদীগুলোই মূলত এশিয়ার প্রাণ। অথচ গবেষণা বলছে, ২০৩৫ সালের মধ্যে এই নদীগুলোকে হয়তো জীবিত দেখা যাবে না।
সমাধানের পথ কি নেই?
এই ভয়াবহ সংকট মোকাবিলায় কোনো উদ্যোগই কী কাজে আসবে না? বিজ্ঞানীরা বলছেন, এর জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টা। আর তার জন্য প্রয়োজন বিশ্বব্যাপী জনসচেতনতা।
স্থানীয় পর্যায়ে যদি সবাই স্বাদু পানি সংরক্ষণে সচেষ্ট হয়, তাহলে ভবিষ্যতের এই ভয়াবহ সংকট এড়ানো সম্ভব। সেচের জন্য বহু জায়গায় ভূগর্ভস্থ পানি ডিপটিউবওয়েলের মাধ্যমে ওঠানো হয়। ভূগর্ভস্থ পানি অনেকটা সঞ্চিত টাকার মতো। আপত্কালীন সঞ্চিত অর্থের মতো। এই পানি ব্যবহার না করে সাগরের নোনা পানি লবণমুক্ত করার ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর কোনো অঞ্চলে অতিবৃষ্টি এবং কোনো অঞ্চলে অনাবৃষ্টির আশঙ্কা বেড়েই চলেছে। এই বৃষ্টির পানি সুষ্ঠুভাবে ধারণ, সংরক্ষণ ও সুষম বণ্টন সংকট সমাধানে ভূমিকা রাখতে পারে। ইউএনইপির পরামর্শ হলো, সংকট থেকে মুক্তির জন্য ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রকৃতির প্রতি সংবেদনশীল হতে হবে। এক দেশ অন্য দেশকে, এক মহাদেশ অন্য মহাদেশকে সহযোগিতা করলে এ সংকট মোকাবিলা সহজ হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।