ভালকে সমর্থন এবং খারাপকে বর্জন করতে শিখুন ।
হঠাৎ করেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উৎসবের আমেজ। উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু ক্যাম্পাসেরই এক ছাত্র। ছাত্রটির নাম সাজিদ আলী হাওলাদার। কারণ সাজিদ মাত্র ২৬ বছর বয়সে চবির ক্যাম্পাসে পেয়ে গেছে বিরল প্রজাতির ব্যাঙ।
আর সেই ব্যাঙ আবিষ্কার করে সাজিদ পরিণত হয়ে গেছে ক্যাম্পাস হিরোতে।
শুধুমাত্র চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নয় এটি বাংলাদেশের জন্যও গর্বের। কারণ বাংলাদেশে প্রাপ্ত বা কোনো বাংলাদেশির উভচর, সরীসৃপ বা স্তন্যপায়ী প্রাণী আবিষ্কারের ঘটনা এই প্রথম ঘটল। তাও আবার কোনো ধরনের অর্থ সহযোগিতা ছাড়া। আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে তুমুলভাবে সাড়া জাগায় সাজিদের এই আবিষ্কার।
তার উপর আন্তর্জাতিক প্রাণী বিষয়ক জার্নাল জুটেক্সায় প্রকাশিত হয় তার আবিষ্কৃত ব্যাঙ বিষয়ক প্রবন্ধ।
এবার জেনে নেই সাজিদের ব্যাঙ আবিষ্কারের ঘটনাটি:
২০০৪ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণিবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হয় সাজিদ। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকেই ব্যাঙ, পাখি নিয়ে তার আগ্রহের কমতি নেই। ব্যক্তিগত আগ্রহ থেকেই ব্যাঙের জীবন প্রণালী ও বংশবৃদ্ধি নিয়ে বিস্তারিত পড়াশোনা করতে থাকে সাজিদ। এ সময় ব্যাঙের বংশবৃদ্ধির জন্য হট-স্পট হিসেবে পরিচিত চবির কাটাপাহাড় রাস্তার দু’পাশ থেকে বিভিন্ন ব্যাঙের নমুনা সংগ্রহ করতে থাকে।
এর মধ্যে ২০০৮ সালে একদিন হুট করে পেয়ে যায় বিরল প্রজাতির একটি ব্যাঙ।
সব সময় বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, ব্যাঙ তার সংগ্রহে রেখে দেয়। তাই স্বভাবমতো ঐ বিরল প্রজাতির ব্যাঙটিকেও সাজিদ নিয়ে যায় তার ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায়। এরপর শুরু হয় সেটিকে নিয়ে গবেষণা। এই ব্যাঙটির প্রজাতি ও প্রকৃতি উদ্ধারের কাজে লেগে যায়।
বই-পুস্তক ঘেটে দেখলো পৃথিবীতে এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত সাড়ে ছয়শ প্রজাতির মধ্যে এ ব্যাঙটির কোনো অস্তিত্ব নেই। এবার গবেষণায় নিলো নতুন মোড়। এ ব্যাঙের ব্যতিক্রমী ডাক ও বৈশিষ্ট বের করতে সে যোগাযোগ শুরু করে পর্তুগাল, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, জাপানসহ বিশ্বের সেরা সব প্রাণীবিজ্ঞানীদের সাথে।
ব্যাঙটির গতিবিধি, ডাক অর্থাৎ সাউন্ড নিয়ে চলতে থাকে গবেষণা। সাজিদ দেখলো, ব্যাঙটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৩০ মিলিমিটার।
পরিচিত ব্যাঙের স্বরের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন সুরে ডাকে। পিঠে লালচে ছোপ। শরীরের মাঝখান বরাবর সাদা রেখা। গলার নিচের চামড়া ঝুলে থাকে। একটা পর্যায়ে স্বপ্নের মতো হলেও সত্যি সাজিদ বের করে ফেলে, ‘এ ধরনের ব্যাঙের অস্তিত্ব একমাত্র বাংলাদেশেই আছে’।
এরপর বিশ্বের সেরা প্রাণীবিজ্ঞানীদের সম্পাদনায় প্রকাশিত বন্যপ্রাণীর শ্রেণীবিন্যাসের কাজে নিয়োজিত জার্নাল “জুটেক্সায়” একটি প্রবন্ধ পাঠান। তারা আবিষ্কারের সত্যতা যাচাইয়ের পর এই বছরের জানুয়ারিতে তার প্রবন্ধটি গ্রহণ করে। এবং ৯ ফেব্রুয়ারি প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়।
ব্যাঙটির নাম দেয়া হয়েছে ‘ফ্যাজারভেরিয়া আসমতি’। এ প্রসঙ্গে সাজিদ বলে, ব্যাঙ গষেণার জন্য প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণ ফরমালিন ও অ্যালকোহল।
আমার তো আর এগুলো কেনার পয়সা নেই। তখন আমার শিক্ষক আসমত স্যার আমাকে সহযোগিতা করতেন। এমনকি স্যার আমাকে বইপত্র দিয়েও সহযোগিতা করেছেন। তাই এই গবেষণায় সব বিষয়ে সাহায্য করেছেন আমার শিক্ষক ড. গাজী সৈয়দ আসমত স্যার। এজন্য আমি স্যারের নামেই ব্যাঙটির নাম দিয়েছি।
বর্তমানে সাজিদের অবস্থা:
বাংলানিউজটোয়েটিফোর.কম থেকে সাজিদকে ফোন দেয়া হলে জানা যায় সাজিদ মাষ্টার্স শেষ না করে মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে। সাজিদ এ প্রসঙ্গে বলে, পড়াশোনা করে নিশ্চয় অনেক কিছু শেখা যায় কিন্তু সত্যিকার অর্থে পড়াশোনা কী শেখায়? আসল হলো কাজ। কাজের সাথে পড়ালেখা করলে অনেক কিছু শেখার আছে। আমি গবেষণার সাথে সাথে পড়াশোনা করতে চেয়েছি। কিন্তু আমার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তেমন কোন সহযোগিতা পাচ্ছি না।
উল্টো, আমার শিক্ষকরা আমাকে গবেষণার বিষয়ে নিরুৎসাহিত করছেন। তাই চিন্তা করলাম আর পড়াশোনা করে কী হবে।
সাজিদ আরও জানায়, আমার ব্যাঙের নতুন প্রজাতির আবিষ্কারটাকেই বেশী ফোকাস করা হয় কিন্তু আমি শুধু একটি প্রজাতিই আবিষ্কার করি নাই। আমি ২০০৭ সালে ৫টি ভিন্ন প্রজাতি আবিষ্কার করেছি। অর্থাৎ বিশ্বের নানা জায়গায় এই ব্যাঙগুলো আছে।
কিন্তু বাংলাদেশে এর কোনো অস্তিত্ব এর আগে খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমিই প্রথম এই প্রজাতিগুলো দেশে বের করেছি। এবং ২০১০ সালে আরও একটি প্রজাতি বের করি। সুতরাং আমি কিন্তু একটি বিষয় নিয়েই বসে নাই। আমি ব্যাঙ নিয়ে অবিরত কাজ করে যাচ্ছি।
পড়াশোনা ছেড়ে চলে আসার বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাওয়া হলে সাজিদ বলে, ২০০৮ সালের ২৮ এপ্রিল আমরা কয়েকজন প্রথম ‘ব্যাঙ সংরক্ষণ দিবস’ পালন করছিলাম। তখন আমাদের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর পুলিশ দিয়ে আমাদের উঠিয়ে দেন। অথচ এই বছর খুব জাঁকজমকভাবে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে “ব্যাঙ সংরক্ষণ দিবস” পালন হলো, যেখানে আমি নেই। এবং আমার বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে ৫০ হাজার টাকা উপহার দিতে চায়। আমি টাকা দিয়ে কী করবো? কিংবা মাত্র ৫০ হাজার টাকা দিয়ে আমি কী গবেষণা করতে পারবো? অবশ্যই না।
আমার তো গবেষণা করতে হবে।
গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার জন্য অর্থ ছাড়া আর কী প্রয়োজন?
এই প্রশ্ন করলে সাজিদ উত্তরে বলে, না, টাকার প্রয়োজন নেই আমার। আমি সারা বাংলাদেশটা ঘুরতে চাই। রেলওয়ের ইঞ্জিন ড্রাইভার যেমন বিনা খরচে ট্রেনে করে দেশ ভ্রমণ করে ফেলতে পারেন, আমি সেরকমই সুযোগ চাই। আমি বাংলাদেশের যে কোনো বনে যে কোনো সময় প্রবেশের অনুমতি চাই।
আমি বন মন্ত্রণালয়ে আবেদন জানাই। তারা জানায়, আমার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনুমতি লাগবে। বিশ্ববিদ্যালয় রেকোমেন্ড করলে বন মন্ত্রণালয় আমাকে অনুমতি দেবে। কিন্তু দুঃজনক হলো আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো অনুমতি দেয়া হয়নি। উল্টো আমার অনেক শিক্ষক আমাকে কটাক্ষ করে।
এক শিক্ষক তো আমাকে বলেই ফেলেছেন, ‘ঘোড়ার চাইতে গাড়ি আগে দৌড়ালে তো হবে না’। মোট কথা কেউ আমার কাজ নিয়ে খুশী নন। তারা সবসময় বলে পড়াশোনা শেষ করো তারপর গবেষণা করো। কিন্তু আমি তো পড়াশোনার পাশাপাশি গবেষণা করতে চাই। আর আমি তো গবেষণায় অনেক সফলতা পেয়েছি।
তাই আমাকে কেনো জটিলতায় পড়তে হচ্ছে সেটাই বুঝে উঠতে পারলাম না। আর অর্থ তো দরকার। ফরমালিন-অ্যালকোহল প্রয়োজন। তাই অর্থও প্রয়োজন।
ভবিষ্যত নিয়ে কী ভাবছে সজিদ?
এমন প্রশ্ন করলে সাজিদ একটা দীর্ঘশ্বাস নেয়।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, আমি কাজ করতে চেয়েছি। দেশের জন্য কিছু করতে চেয়েছি। আমি দেশকে দিতে চাই। কিন্তু দেশ আমার কাছ থেকে নিতে চায় না। তাই চিন্তা করছি দেশের বাইরে চলে যাবো।
দেশের বাইরে গবেষণার অনেক সুযোগ আছে। আমি এখন পর্যন্ত যতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার থিসিস পাঠিয়েছি, সবাই পড়ে মুগ্ধ হয়ে আমাকে তাদের সাথে কাজে নেবার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু নিজের দেশে আমার প্রতি সবাই আগ্রহ হারিয়ে ফেলল। তাই কষ্ট হয়। আমার দেশেই সম্ভব ছিল অনেক কিছু করার।
আমি প্রকৃতির বিপদের পূর্বাভাস দেওয়ার বিশ্বস্ত প্রাণী ব্যাঙ নিয়ে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে চেয়েছিলাম। চেয়েছিলামও বলব না। আমি এখনও চাই।
Click This Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।