রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিবর্তনে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা
ফকির ইলিয়াস
==================================
রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন ছাড়া গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা সম্ভব নয়। সহনশীলতা ছাড়া রাজনৈতিক সমঝোতা সম্ভব নয়-এমন কথা আমরা বারবার শুনে আসছি। কিন্তু বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন হয়নি। বরং দেখা যায়, যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় যায় তারা মহাপরাক্রমশালী হয়ে ওঠে। নানা ধরনের অপকর্মের মদত দেয়।
আবার যখন রাষ্ট্রক্ষমতা তাদের হাত থেকে চলে যায় তখন তারা জনগণের অধিকারের প্রতিভূ হওয়ার চেষ্টা করে। তাদের অতীত ভোলানোর জন্য নানা ধরনের ছলনার আশ্রয় নেয়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে যারা অপশক্তি; প্রধান দলগুলোর শীর্ষ নেতারাও তাদের চেনেন, জানেন। তারপরও তারা নিজ নিজ দলের আগাছা পরিষ্কারে তৎপর নন, বরং জিইয়ে রাখেন। এরা অভ্যন্তরীণ কোন্দলও করে।
দেশে-বিদেশেও মুখোমুখি হয় পরস্পরের। সাদা-কালো পতাকা দেখায়। অথচ গোটা বাংলাদেশটিই আঁধারের কালো পতাকায় ঢেকে যাচ্ছে। রাহুগ্রাসের কালো চাদর ঢেকে দিচ্ছে বাংলার মাটি। সেদিকে শীর্ষ রাজনীতিকদের নজর খুবই কম।
আর থাকলেও তারা দলীয় স্বার্থের বাইরে বেরোতে পারছেন না।
একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদে দেখেছি, সম্প্রতি বেগম খালেদা জিয়ার ইংল্যান্ড সফরের সময় তারেক রহমান বেগম জিয়ার সঙ্গে অনেক কথা বলেছেন। তিনি নাকি জানিয়েছেন, বিগত সেনাসমর্থিত সরকারের সময় তিনি গ্রেফতারের পর বিএনপির কোন কোন নেতা ওই সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা বলেছেন, তা তারেক রহমান জানেন।
হ্যাঁ, রাজনীতিক তারেক রহমান তা জানেন, ধরে নিলাম। কিন্তু এটাও নিশ্চিত করে বলতে পারি, তারেক রহমানের নেতৃত্বে তার দল যদি কোনদিন ক্ষমতায় যায় তবে তিনিও সেসব অপশক্তির বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেবেন না।
আমরা দেখেছি গেল সেনাসমর্থিত সরকারের সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও কেউ কেউ সাক্ষী হয়েছিল। পরে তারা বলেছে, তারা পরিস্থিতির শিকার। কিন্তু এই চক্রটি এখনো নানা লেবাসে আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতির নেপথ্য ধারক হিসেবে রাষ্ট্রক্ষমতার ধারে কাছে থেকে যাচ্ছে। আর থেকে যাচ্ছে বলেই অন্য নানা খোঁড়া ইস্যুতে বিএনপি আন্দোলনের হুমকি-ধমকি দিলেও শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির প্রধান নায়কদের বিরুদ্ধে কিছুই বলছে না। অথচ এই শেয়ারবাজার লুণ্ঠনকারী হোতারা প্রধান দুটি দলের কাছেই অত্যন্ত পরিচিত।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তন না হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে এই দীনতা। যে দীনতা রাষ্ট্রের মেধাবী সন্তানদের মূল্যায়ন না করে কিছু লুটেরা শ্রেণীকে সবসময়ই পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছে।
এদেশ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন একজন শ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা পপগুরু আজম খান। বাংলা আধুনিক পপ সংগীতকে বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছিলেন তিনি। তার গান শুনে পরিশুদ্ধ মনন গড়ে উঠেছে এদেশের কয়েক প্রজন্মের।
কিন্তু খুব দুঃখজনক কথা হচ্ছে, এই মহান শিল্পী তার জীবদ্দশায় রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি। তিনি গুরুতর অসুস্থ হওয়ার পর রাষ্ট্র তাকে কিছু আর্থিক সাহায্য দিয়েছে।
অত্যন্ত খোলা প্রাণের মানুষ আজম খান ছিলেন আজন্ম দেশপ্রেমিক। তার কোন চাওয়া-পাওয়া ছিল না। বাউল ঘরানার মানুষদের এমন চাওয়া-পাওয়া থাকে না।
শুধু দিয়েই গেছেন। তার একটা সাক্ষাৎতকার টিভিতে দেখেছিলাম। সেই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, 'এই যে আমার গায়ে মোটা কাপড়ের শার্ট, এই শার্টটিই আমার বাংলাদেশ। আমি ভালো থাকতে চাই। আমি চাই আমার এই শার্টটি ভালো থাকুক।
'
হ্যাঁ, একজন মহান মানুষ এভাবেই চান তার প্রিয় স্বদেশ ভালো থাকুক। কিন্তু শকুনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে যারা এই দেশটিকে কঙ্কালসার করতে চাইছে তারা ভোগবাদে বিশ্বাসী। এরা ত্যাগের দীক্ষা নিচ্ছে না। নিতে পারছে না।
দুই .
ক'দিন আগে ঢাকার একজন খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে ফোনে কথা হচ্ছিল।
তিনি খুব দুঃখ করে বললেন, যে দেশের কোটি কোটি টাকার কাছে শীর্ষ রাজনীতিকরা নিজেদের বিকিয়ে দেন, সেদেশে ন্যায়-নীতি তো সুদূরপরাহত। তিনি খুব ব্যথিত চিত্তে বললেন, আমরা এই বলয় থেকে বেরিয়ে আসার জন্য প্রায় দিনই তো কথা বলছি। দেশের জাতীয় দৈনিকগুলোতে প্রতিদিনই নানারকম প্রবন্ধ, নিবন্ধ, কলাম লেখা হচ্ছে। কিন্তু কেউ কারও কথা শুনছে বলে তো মনে হয়নি।
আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনে বুদ্ধিজীবীরা জোরালো ভূমিকা রাখতে পারছেন কি? অথবা রাখছেন না কেন? তিনি বললেন, কারণ বুদ্ধিজীবীরা তাদের কর্ম ও বিশ্বাসের সমন্বয় রাখতে পারছেন না।
কেউ কেউ ধর্ম ও সংস্কৃতিকে গুলিয়ে ফেলেছেন। ফলে মৌলবাদী তস্কর শ্রেণী তাদের কাঁধে বন্দুক রেখে শিকার করার সাহস পেয়েছে। তার কথাগুলো আমার বেশ যুক্তিযুক্ত বলেই মনে হলো। মনে পড়ে গেল বছর কয়েক আগে 'পেন'-এর একটি সেমিনারে মার্কিন কবি ডব্লিউ এস মারউইন প্রায় একই কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ধর্মীয় বিশ্বাসই হচ্ছে মানুষের অত্যন্ত অনুভূতিশীল বিষয়।
চালাক বুদ্ধিজীবীরা গোঁড়া সমাজগুলোতে মানুষের ব্রেনওয়াশ করতে সেই শক্তিটিকেই কাজে লাগায়। তারা সংস্কৃতির বিবর্তনকে বিক্রি করে দেয় মুনাফাখোর রাজনীতিকদের কাছে এবং তারা নিজেরাও এর ফল ভোগ করে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কথাগুলো খুবই যৌক্তিকভাবে প্রযোজ্য। এদেশে সামরিক শাসকরা বুদ্ধিজীবীদের বিবেক কিনে নিয়েছিল অর্থ কিংবা ক্ষমতা মূল্যের বিনিময়ে। দেশের বেশ কিছু বুদ্ধিজীবী তাদের বিবেক বন্ধক রেখেছেন কালো টাকার কাছে।
ফলে একপক্ষ মৌলবাদীরাও এ সুযোগ কাঁধে নিয়ে তাদের পক্ষকেও মজবুত করেছে অর্থমূল্যের বিনিময়ে। আর খুব স্বল্পসংখ্যক বুদ্ধিজীবী অত্যন্ত অসহায় জীবনযাপন করে তাদের কালাতিপাত করেছেন। এসব বিবেকবান বুদ্ধিজীবীর কথা সরকার পক্ষ কখনই শোনেনি।
বাংলাদেশে একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব প্রয়োজন। না, এই বিপ্লব অবশ্যই রক্তপাতকে প্রমোট করবে না।
এই বিপ্লব হতে হবে মেধাবৃত্তিক। সুকুমার মনোবৃত্তির মানুষদের দাঁড়াতে হবে সব অপরাজনীতি, অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে। আমরা জানি এবং দেখেছি, ইউরোপ-আমেরিকায় বুদ্ধিজীবীরা কখনই সরকারের মুখাপেক্ষী নন। তারা সরকারের লাউড স্পিকার হিসেবে কাজ করেন না। তারা কাজ করেন সরকারের সৃজনশীল প্রতিনিধি হিসেবে।
সরকারও বিনা স্বার্থে এসব বুদ্ধিজীবীর পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে এমনটি রাতারাতি হবে, তেমন প্রত্যাশা করা যায় না। তবে এর বীজ বুনতে হবে। স্বার্থ পরিহার করে রাষ্ট্রের কল্যাণে বুদ্ধিজীবীদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। কারণ রাজনীতির দুষ্ট গ্রহ রাজনীতিকদের আচ্ছন্ন রাখে, বুদ্ধিজীবীদের নয়।
সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রেখে কিছু মানুষও যদি সমস্বরে তীব্র অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন তবে শ্রেণীস্বার্থ রক্ষাকারীরা ক্রমে পালাবেই। আর প্রজন্ম তখনই প্রকৃত অর্জনের মুখ দেখবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার চলি্লশ বছর এদেশে যেসব রাজনৈতিক আগাছা তৈরি করেছে তা চিহ্নিত করতে হবে সৃজনশীল মানুষদেরই। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ ভূখ- ও পতাকা দিয়েছে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিপুষ্ট মাঠ তৈরি করতে না পারলে কোন মানুষেরই মুক্তি নেই এদেশে।
নিউইয়র্ক, ৮ জুন ২০১১
------------------------------------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ/ ঢাকা/ ১০ জুন ২০১১ শুক্রবার প্রকাশিত
ছবি- মার্টি স্ট্রাটৈ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।