চারপাশে আত্মমুগ্ধ আদিমতাবোধ, আর গ্রন্থিবদ্ধ চিন্তা; সেখান থেকে মুক্তির পথ খুঁজি...
১
আজ সকালে স্যান্ডেলটি ছিড়ে গেল। গত বছর রোযার ঈদে কিনেছিল রুস্তম আলী। বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসতেই হেরিঙবোন করা রাস্তার ইটের সাথে হোঁচট খেয়ে চামড়ার ফিতা খুলে গেল। সেখান থেকে ল্যাঙচাতে ল্যাঙচাতে বড় রাস্তা পর্যন্ত আসতে বেশ কষ্ট হয়েছে।
শেষ পর্যন্ত কানাইলালের কাছে আসবার রিক্সাভাড়াও খরচ করতে হলো।
কিন্তু কেন, কানাইলাল কেন? কানাইলাল ছাড়া কি আর মুচি নেই? রুস্তম আলীর নিজের পাড়াতেই ছিল; বাড়ি থেকে মাত্র দু'মিনিটের হাঁটা পথ। তবু সে রিক্সা ভাড়া করে কানাইলালের কাছে যাবে কেন?
তারপরও সে যাবে। এই যাওয়ার পেছনেই একটা সেন্টিমেন্টাল ড্রামা লুকিয়ে আছে। কিন্তু কি সেটা? রুস্তম আলী কাউকে ঠিক বোঝাতে পারবে না। এর কারণ শুধুই কি এই যে, ফায়ার সার্ভিসের রাস্তার পাশে ঐ আমগাছটির তলায় কানাইলালকে তার চর্মকাজের ডালা সাজাতে সাহায্য করেছিল বলে! নাকি গতবার বন্যায় যখন কানাইলালের বাড়ি পানিতে তলিয়ে গেল, সেই সময় রুস্তম আলী নিজের বাড়িতে তাকে আশ্রয় দিয়েছিল বলে? নাহ! এসব ঠুনকো কারণ।
অবশ্য আসল কারণের ব্যপারেও রুস্তম আলী নিশ্চিত নয়। তবে মাঝে মধ্যেই তার এই প্রশ্ন মাথায় আসে।
কানাইলাল তাকে দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে গেল, 'সেলাম বাবু, ভাল আছেন তো?'
'ভালো তো ছিলাম, এই দ্যেখ্না স্যান্ডেলটা কিভাবে ছিড়ে গেছে? সারিয়ে দে তো। '
'বাবু এখন তো সলিশন (সলিউশন) নেই, কাল আনবো। আপনি সেন্ডেল জোড়া আজ রেখে যান।
'
'আচ্ছা তাহলে রাখ। ' খালি পা নিয়েই তাকে বাড়ির উদ্দেশ্যে রিক্সায় চড়তে হলো।
রুস্তম আলী কাঠুরিয়া। অনেক পেশার মধ্যে থেকে কাঠ ব্যবসায়ী হওয়ার কাহিনী তাকে প্রায়ই চিন্তিত করে। কাঠ ব্যবসায়ী না হয়ে অন্য কিছুও তো সে হতে পারতো।
বাবার সম্পদের অভাব ছিল না, বিস্তর জমি-জায়গারও মালিক ছিলেন তিনি। অল্প বয়সে নগদ টাকা নাড়াচাড়ায় পটু হওয়ায় মাধ্যমিকে পাশ হল না। কিন্তু পাশ করেছিলো অসাধারণ বাউডুলেপনায়, তারপর থেকে দাদার আমলের শালগাছ কেটে তার ব্যবসায় হাতেখড়ি হয়। হাতেখড়ি এভাবে হলেও উদ্দেশ্য ব্যবসা ছিল না, ছিল মালতির শাড়ি কেনার টাকা জোগাড় করা। শাড়ি কেনা হয়েছিল বটে, সেই সাথে শাড়ির একমাথা কাঠের সাথে আর এক মাথা তার নিজের গলায় বাধা হয়েছিল।
সেই বাঁধন আজো খোলেনি।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে। ভাবে, কি দায় পড়েছিল তার মালতির শাড়ি কেনার? মালতির শাড়ি ছিঁড়ে গেলে ওর কি? ও কি আর তার শাড়ি ছিড়ে দিয়েছিল?
সেদিন পশ্চিমের ঐ বাঁশঝাড়ের নিচে শক্ত করে মালতির হাত ধরেছিল সে। ভেবেছিল মালতি বুঝি ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করবে। কিন্তু তা সে করেনি।
শুধু ভয়ার্ত গলায় বলেছিল, 'ছোট বাবু। কেউ দেখে ফেললে আমি মরে যাবো। '
'তোকে মরতে দিলে তো'
'ছেড়ে দাও না। হাত টা ভেঙ্গে যাবে তো। '
রুস্তম হাত ছেড়ে দিয়েছিল।
তারপর বলেছিল. 'তুই আমার সাথে এক জায়গায় যাবি?'
'কোথায়?'
'অনেক...দূরের এক জায়গা'
'হায় ভগবান। বড় বাবু জানলে আর আস্ত রাখবে না। '
'বাবা জানার আগেই দেখবি আমরা অনেক দূর চলে গেছি। '
'কোথায়?'
'ঢাকায়'
'ঢাকায়?'
'হ্যা। ঢাকায়।
'
'বাড়ি ছেড়ে যেতে তোমার কষ্ট হবে না?'
'নাহ। কিসের কষ্ট?'
'আমার কিন্তু কষ্ট হবে। '
'যাবি না?'
মালতি কথা না বলে মাথা হেলিয়ে সায় দিয়েছিল। কিন্তু মালতিকে নিয়ে পলিয়ে যাওয়া হয়নি তার। সেটা আরেক গল্প।
রুস্তম আলীর বাবার হাতের কড়ের মধ্যে কোন ফাঁক ছিল না। সামনে দিয়ে তাঁর পিঁপড়ে যেতে পারতো না, তবে পিছনে হাতি গেলেও তিনি টের পেতেন না। এই সুযোগ যে শুধু ঝি-চাকররাই নিতো তা নয়, রুস্তম আলী ও তার বড় ভাইও ঝোপ বুঝে কোপ মেরে দিতেন। সেই কোপই সেদিন দাদার আমলের শালগাছে পড়েছিল। সেই থেকে সে নিজে কাঠুরিয়া হলেও বড় ভাই মোহাম্মদ আলী হয়েছিলেন বিপ্লবী।
কখনও কখনও বড় নিম গাছটার নিচে বসে খুব কঠিন কঠিন কথা বলতেন, রুস্তম তার কিছু বুঝতো কিছু বুঝতো না। একদিন বললো, 'বুঝলি রুস্তম, সব মানুষ একদিন মুক্তি পাবে। মানুষ জাগবে। ধনী-গরিব, ছোট-বড় এগুলো থাকবে না'
'মধু কাকা?' রুস্তম আলী জিজ্ঞাসা করে।
'মানে মালতির বাবা?'
মাথা নেড়ে সায় দেয় সে।
'হ্যা, মধু কাকাও। '
রুস্তম আলীর আনন্দ লেগেছিল সেদিন। কিন্তু সেই দিন কবে হবে, বড় ভাই তা বলেননি। বড় ভাই হঠাৎ একদিন বাড়িতে বউ নিয়ে হাজির হলেন। রুস্তম আলীর বাবা প্রথমে রেগে গেলেন বটে, পরে শান্ত হলেন।
ভেবেছিলেন এবার হয়তো অবাধ্য সন্তানকে বাধ্য করতে পারবেন। অন্যদিকে নতুন বউ ভেবেছিল বাঙালীর চিরাচরিত নিয়মে রাধুনীর কৌশল দিয়ে শ্বশুরের মন গলানো যাবে। পরদিন নতুন বউ হেসেলে ঢুকলো শ্বশুরের জন্য দুপুরের খাবার রাঁধতে। 'কিন্তু তেল কই?'
'এ বাড়িতে তো তেল কেনা হয় না'
'তো তেলের কাজ কি দিয়ে হয়?'
'বড়ো জোড় সরিষা বেঁটে'
তবু বউ তেল জোগাড় করলো। বাবার বাড়িতে তার রাধুনী হিসেবে সুনাম ছিল, কৌশলও জানা ছিল হরেক রকম।
তার সব ঢেলে দিলেন শ্বশুরকে খুশি করতে।
দুপুরে ভাত খেতে বসে শ্বশুর বললেন, 'আজ কে রেঁধেছে?'
দরোজার আড়ালে দাড়িয়ে নতুন বউ জবাব দিলেন, 'বাবা আমি। তরকারি ভাল হয়নি?'
'ভাল হয়েছে, তবে তেলের গন্ধ। এর পর থেকে তেল-টেল দিও না বউমা। '
বউমা শ্বশুরের কথা রেখেছিল।
কিন্তু শ্বশুর রাখতে পারেনি তাঁর বড় ছেলের বউকে। ছেলে না থাকলে ছেলের বউকে কি করে রাখবেন? মোহাম্মদ আলী হঠাৎ উধাও হয়ে গিয়েছিলেন। তিনদিন যাবত কোন খোঁজ ছিল না। তিনদিন পর তাঁকে পাওয়া গেল ঐ মধুপুরের বাঁধের উপর। রুস্তম আলী দেখে এসেছিল।
জবাই করা গরুর মতো গলা ফাঁক হয়ে পড়ে ছিল বড় ভাই। লাশ পুলিশ নিয়ে গিয়েছিল। পরদিন ছবিসহ পত্রিকার পাতায়ও বেড়িয়েছিল খবর। লেখাছিল 'প্রতিপক্ষের হাতে নিহত'।
ঘটনায় রুস্তম আলীর বাবা ভয় পেলেন।
তিনি ভাবলেন তাঁর দ্বিতীয় ছেলের ভাগ্যেও বুঝি এই পরিণাম আছে। ভয় পেয়েছিল রুস্তম আলী নিজেও। প্রাণভয়ে পালিয়ে ছিল সে। মালতিকে ছাড়াই সে ঢাকায় গিয়েছিল আর ফিরেছিল দু'বছর পর।
২
পরপর তিনদিন কানাইলাল স্যান্ডেল জোড়া মেরামত করেনি।
এ তিনদিনে প্রতিদিন বিভিন্ন কারণ দেখিয়েছে সে। রুস্তম আলী আজ বিরক্ত হয়ে বললো, 'দে আমার স্যান্ডেল জোড়া দে, তুই ছাড়া আরও মুচি আছে। আমি সেখানেই যাই। '
'মাফ করবেন বাবু, আর একটা দিন সময় দিন'
'না। আর একদিনও না'
'কালই দিয়ে দিবো ।
খুব কষ্টে আছি বাবু, বাড়িতে ছেলের মা অসুস্থ্য'
'কি হয়েছে?' রুস্তম আলীর গলা নরম হয়ে আসে।
'আজ কয়েক দিন যাবত গায়ে জ্বর'
'ডাক্তার দেখাস নি?'
'না বাবু'
'আজই ডাক্তার দেখাবি। ' পকেট থেকে দুটি একশ টাকার নোট বাড়িয়ে ধরে ও। কানাইলালের ওপর রাগ কমে যায় রুস্তম আলীর। সে ভাবে, ''ওর কি দোষ।
সে হয়তো ভেবেছে আমার কাছে সে অনেক ঋণী। আমি যদি তার স্যান্ডেল মেরামতের মজুরী না দেই, অথবা একটু সময় নিয়ে সে বিনাপয়সায় কাজটা করে দিতে চেয়েছিল। আমিতো তার ঋণ বৃদ্ধি করেছি, তার অভাব দূর করার ব্যবস্থা তো করে দেই নি। কেন করিনি? মালতি ঐ কনাইলালের ঘরের বউ বলে?''
সমাপ্ত
বি.দ্র: গল্পটি পূর্বে অন্য একটি ব্লগে প্রকাশ করা হয়েছিল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।