আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কর্ণেল জামানের স্মরণ সভায় (৪জুন, ২০১১ প্রেসক্লাব) গণসংহতি আন্দোলন এর প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকির বক্তৃতা

শ্রদ্ধেয় সভাপতি, উপস্থিত শ্রদ্ধেয় আলোচকবৃন্দ এবং সম্মানিত সুধীবৃন্দ আপনাদের সবাইকে আমাদের দল গণসংহতি আন্দোলনের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। প্রথমেই লে কর্ণেল কাজী নুর উজ জামানের প্রতি আমরা আমাদের গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। বাংলাদেশের একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লেখক আহমদ ছফা ১৯৭১ সালকে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, “‍‍‍‌৭১ মহাসিন্ধুর কল্লোল”। এই নামের মধ্যদিয়েই ৭১ সালের যে বৃহদ একটা প্রেক্ষাপট, তার যে পরিমণ্ডল এবং তাৎপর্য সেটা প্রকাশিত হয় বলেই বিষয়টি উল্লেখ করলাম। এটা আমরা সকলেই হয়তো মানি।

কিন্তু কাজে কতটা পরিণত করতে পারি এখন পর্যন্ত আমরা নিশ্চিত নই। ১৯৭১ সালের যুদ্ধ এখন পর্যন্ত এই জনপদের মানুষের সংগ্রামের সবচে উঁচু শিখর। ৭১ সাল সাম্রাজ্যবাদের মদদপুষ্ট পাকিস্তানি রাষ্ট্রের প্রায় উপনিবেশিক জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে একটা জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম। এই সংগ্রামের কোন একমাত্রিক ব্যাখ্যা নেই। এই সংগ্রামের কোন একমাত্রিক গল্প নেই।

এই কথাটা আমাদের আজকে জোরের সাথে বলা দরকার। একমাত্রিক গল্প বলে সেটা আমাদের মাঝে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। ৭১ সালের মধ্য দিয়ে আমাদের যেমন একটা বিজয় আছে। আমরা যেমন একটা রাষ্ট্র পেয়েছি। একটা ভুখণ্ডের উপর একটা স্বাধীন অম্তিত্ব, নিজেদের একটা পরিচয় দাঁড় করিয়েছি।

তেমনি জনগণের জন্য বড় আকারের পরাজয়ও এর একটি দিক। এই পরাজয় প্রতি মুহুর্তে আমাদের ভুলিয়ে দেয়া হচ্ছে। ভুলিয়ে দেয়া হচ্ছে বলেই আজকে আমরা অনেক খলনায়কদের পসার দেখি। আসল নায়কেরা আজকে দৃশ্যপটের আড়ালে পড়ে যাচ্ছেন। এবং এটা কোন বিষ্ময়ের ব্যাপার নয় যে লে কর্ণেল কাজী নুর উজ জামান, তাঁর মৃত্যু কিংবা জীবনকে উদযাপন করার কাজ এটা আমাদের দেশে হচ্ছেনা।

এটা একটা ঘটনা বটে। কিন্তু আমাদের দেশের প্রগতিশীল আন্দোলন, গণতান্ত্রিক আন্দোলন, জনগণের আন্দোলন যে একটা প্রান্তিক অবস্থায় এসেছে এটা তার একটা লক্ষণও বটে। এই স্বীকৃতি আজ আমাদের নিজেদের উপলব্ধি করা দরকার। সেটা যদি আমরা ঠিক মতো করি লে কর্ণেল কাজী নুর উজ জামানকে কেন আমাদের নিজেদের সংগ্রামের জন্য নতুন করে জীবন্ত করা দরকার, সেটা আমরা উপলব্ধি করতে পারবো। আমরা ১৯৭১ সালের দাবি ছেড়ে দিয়েছি।

বিশেষভাবে বামপন্থি আন্দোলন, প্রগতিশীল আন্দোলন ৭১ সালের দাবি ছেড়ে দিয়েছে। হয় তা আওয়ামী লীগের গল্প বলে, অথবা ৭১ সালকে এড়িয়ে যায়। এই অবস্থা রাজনীতির ক্ষেত্রে কোন ইতিবাচক জায়গা তৈরী করতে পারে না। রাজনীতি ইতিহাস ছাড়া চলে না। আমরা ইতিহাসের ভেতরেই জীবন যাপন করি।

এ কথাগুলো বারবার আমাদের বলতে হচ্ছে। এবং বিশেষভাবে প্রগতিশীল রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে আমাদের আবার ভাবা দরকার যে, ইতিহাস শ্রেণী সংগ্রামের,কাজেই রাজনীতির খুবই গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। এবং শাসকরা আজকে যে ক্ষমতার প্রাধান্য সৃষ্টি করতে পেরেছে এটা এই কারণে যে, তারা ইতিহাসকে দখল করেছে। কর্ণেল জামান যুদ্ধের পরপরই বলেছিলেন যুদ্ধ শেষ হয়নি। এবং যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।

ফলে আশ্চর্য হবার কিছু নেই তিনি যখন যুদ্ধের স্মৃতি লেখেন সেখানে প্রথমে শুরু করেন মুজিব বাহিনী দিয়ে এবং যুদ্ধের কেবল একটা কাহিনী ছিলনা। কারা যুদ্ধ করেছে আর কারা করেনি। কীভাবে একটা রাষ্ট্রের পত্তন ঘটছে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে? এবং সেই রাষ্ট্রের গোড়ার গলদগুলো কী?একটা সেনাবাহিনী গড়ে উঠছে কিন্তু কীভাবে সেটা ভারতীয় কর্তৃত্বে চলে যাচ্ছে?কীভাবে একটা সেনাবাহিনী আমলাতন্ত্রের কর্তৃত্বে চলে যাচ্ছে?বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গোড়ার দিকে তাকান সংবিধান, আমলাতন্ত্র, বিচার বিভাগ, সেনাবাহিনী কোনটাই মুক্তিযু্দ্ধের জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ হিসাবে, সেই আকাঙ্ক্ষার রাষ্ট্র হিসাবে পত্তন হয়নি। যুদ্ধপরাধের বিচার কোন অরাজনৈতিক প্রশ্ন নয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কায়েম হবার প্রশ্ন একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন ছিল।

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমরা রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করেছি। যুদ্ধাপরাধী আজকে যাদের বলা হচ্ছে তারা পাকিস্তানের পক্ষে রাজনৈতিকভাবে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র কায়েম হওয়ার অর্থ হচ্ছে এর বিরুদ্ধের যে রাজনীতি তা নির্মুল হওয়া। যে রাজনীতির বিরোধীতা করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উত্থান সেই রাজনীতি নির্মুল হয়নি, বরং আমরা দেখেছি উল্টোস্রোত বয়ে গেছে। জনগণের আকাঙ্ক্ষাই পরাজিত হয়েছে।

যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতিই এখানে প্রাধান্য বিস্তার করেছে। এমনকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্ন ক্ষমতায় থাকার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার হবে কিন্তু বাংলাদেশ সাম্রাজ্যবাদের পদতলে যাবে। যুদ্ধাপরাধের বিচার হবে কিন্তু বাংলাদেশে জনগণের কোন আকাঙ্ক্ষাই বাস্তবায়ন হবে না। এই ধরনের যুদ্ধাপরাধের বিচার দিয়ে বাংলাদেশ খুব বেশি এগুবে না।

এই কথাটা স্পষ্ট করে বলা দরকার। আজকে কর্ণেল কাজী নুর উজ জামানকে আমাদের প্রয়োজন এই কারণে যে, মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকার বয়ান তৈরী করতে না পারলে, জনগণের বয়ান তৈরী করতে না পারলে আমরা আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবো না। আমরা দুর্বল অবস্থায় আছি বটে, কিন্তু এই অবস্থা কোন স্থায়ী ব্যাপার নয়। এই অবস্থা যদি সত্যি সত্যি আমাদের কাটিয়ে তুলতে হয় আমাদের রাজনৈতিক উপলব্ধি দরকার। আজকে নূর মোহাম্মদ ভাই আসার সময় বলছিলেন শাহরিয়ার কবির, যিনি কর্ণেল জামানের এক সময়ের দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক সহকর্মী তিনি একটি লেখা লিখেছেন যে পিকিং পন্থিদের মধ্যে একমাত্র কর্ণেল জামানই ভারতের প্রতি কিছুটা নমনীয় ছিলেন।

এটা যে ঠিক নয় তা বোঝার জন্য আপনারা কর্ণেল জামানের অন্তত পক্ষে যুদ্ধের স্মৃতি বইটি পড়বেন। দেখবেন কীভাবে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, বাংলাদেশের প্রতিরোধ যুদ্ধ ভারত তার নিজের কর্তৃত্বে নিয়ে গেল এবং বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষা, জনগণের রাষ্ট্র যাতে কায়েম না হতে পারে তার জন্য ১৬ই ডিসেম্বরের আগে এবং এর অব্যবহিত পর থেকে কীভাবে সেই কর্তৃত্ব কায়েম করেছে সেটা তিনি বর্ণনা করেছেন। তিনি তাঁর নিজের, যাকে বলে যথার্থ স্ট্র্যাটেজি, যথার্থ ট্যাকটিকস সেটা জানতেন বলেই বাংলাদেশের ৭১ সালে বিরাজমান আঞ্চলিক রাজনৈতিক সমীকরণ, সেইখানে ভারতের ভূমিকা, আমাদের যুদ্ধে ভারতের কী অংশগ্রহণ হবে,তার সাথে কীভাবে একটা ঐক্য এবং বিরোধের সম্পর্ক রাখতে হবে সেটা যথার্থভাবেই নির্ণয় করতে পেরেছিলেন। যারা পারেননি তাদের আজকে পর্যালোচনা করা দরকার যে আমরা পারিনি। পারিনি স্বীকার করেই ঐ জায়গায় আমাদের দাঁড়ানো দরকার।

কিন্তু যারা আজকে বন্ধুত্বের কথা বলে আধিপত্যকে জায়েজ করতে চান তাদের ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকা দরকার। বর্তমান বাস্তবতা এটা প্রমাণ করেছে, বাংলাদেশে অস্তিত্ত্বের সাথে ভারতের আধিপত্যের একটা বিরোধাত্মক সম্পর্ক রয়েছে এবং বাংলাদেশকে যদি এগুতে হয় আজকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং এ অঞ্চলের স্থানীয় মাতব্বর ভারতের সাথে মোকাবেলা করেই এগুতে হবে। এটা কোন সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন নয়। এই জায়গা আমাদের নির্ধারণ করা দরকার। এসব প্রশ্নগুলোকে রাজনীতিতে আবারো সক্রিয় করার জন্যই কর্ণেল জামানকে আমাদের মাঝে অত্যন্ত জরুরি।

কর্ণেল জামান পুরো যুদ্ধকে পুরো লড়াইকে অস্তিত্ত্বের প্রশ্ন হিসেবে দেখেছিলেন। সেকারণে তার পরিবারকেও পুরো যুদ্ধের মধ্যে খুবই দ্রুততার সাথে, একদিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে যুদ্ধে চলে গিয়েছিলেন। তিনি পরবর্তী পুরো জীবনটাতেও লড়াই করে গেছেন। ৭৫ বছর বয়সেও আমার মতো যুবকের সাথে কাজ করতে তিনি উদ্বুদ্ধ বোধ করতেন। আমরা ৯২ সালে তার সাথে লড়াই করেছি ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটিতে।

৯৮ সালে ফ্যাসিবাদ বিরোধী কমিটিতে। এই যে একটা তারুণ্য, এই তারুণ্য যে আবেগ থেকে তৈরি হয়, যে অঙ্গীকার থেকে তৈরী হয় আজকে সেই অঙ্গীকারই আমাদের নতুন করে জাগিয়ে তুলতে হবে। নতুন করে সেই উত্থানের জায়গা তৈরী করতে হবে। বাংলাদেশে একটি নতুন রাজনৈতিক উত্থান অত্যন্ত জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই রাজনৈতিক উত্থান রাজনীতির পর্যালোচনা ছাড়া হবেনা।

আমরা যদি সেই পর্যালোচনায় মনোযোগী হই তবেই আমাদের সামনে মুক্তির পথ। কর্ণেল জামানকে সেই লড়াইয়ে সাথী করবো আমরা। সেই আশাবাদ রেখে তাঁর প্রতি আবারো গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে এবং আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.