মধ্যবর্তী নির্বাচন হবে না জেনেও...
ফকির ইলিয়াস
====================================
যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশে ফিরেছেন। তার এই বিদেশ সফর ছিল নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি নিউইয়র্ক ত্যাগের প্রাক্কালে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে বলেছেন, প্রয়োজনে তার দল সংসদ থেকে পদত্যাগ করে হলেও 'মধ্যবর্তী নির্বাচন'-এর আন্দোলনকে বেগবান করবেন। তিনি সরকারের সমালোচনা করেছেন নানারকম কটাক্ষ করে। তিনি বলেছেন, তিনি সংগ্রাম করছেন বাংলাদেশকে 'ভারতের তাঁবেদারি' থেকে মুক্ত করার জন্য।
এবারের যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় বেগম জিয়ার অন্যতম এজেন্ডা ছিল হিলারি ক্লিন্টনের সঙ্গে বৈঠক করা। না, তার সেই এজেন্ডা পূরণ হয়নি। তা নিয়ে নানারকম হতাশা বিরাজ করছে বিএনপির সদরে-অন্দরে। আমরা পত্রপত্রিকায় দেখেছি আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ঢাকায় থেকে আগেই একটি সমাবেশে বলেছিলেন, 'বেগম জিয়ার হিলারি দর্শন হবে না। ' তিনি যেমন আন্দাজে সে কথা বলেছিলেন তা বলা না গেলেও তার অনুমান সত্যে পরিণত হয়েছে।
তা নিয়ে নেত্রীর প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান ও শমসের মুবিন চৌধুরী বলেছেন পরস্পরবিরোধী কথা। বিএনপি নেত্রী, ইংল্যান্ডে এবং আমেরিকায় বিভিন্ন রাজনীতিকের সঙ্গে মতবিনিময়কালে বর্তমান সরকারের সমালোচনা করেছেন। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত এসব ভাষ্যের অন্তঃসার হচ্ছে, এই বাংলাদেশের রাজনীতি বিষয়ে বিদেশি রাজনীতিকরা কোন মন্তব্যই করেননি। তবে মানবাধিকার ন্যায়বিচার সমুন্নত রাখার ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। মধ্যবর্তী নির্বাচনের কোন যৌক্তিকতা আছে বলেও তারা মনে করছেন না।
এমন কথা স্পষ্ট হয়েছে তাদের বক্তব্যে।
গেল ক'দিন আগে জাতীয় সংসদের উপনেতা বেগম সাজেদা চৌধুরীর একটি বক্তব্য নানাভাবে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সাংবাদিকরা তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, বিএনপি মধ্যবর্তী নির্বাচন দাবি করছে। এ বিষয়ে তার অভিমত কী? সাজেদা চৌধুরী বলেছেন, বিএনপি অনেক কিছুই চাইবে। তারা বলবে আওয়ামী লীগ থাকবে না।
তারা দাবি করতেই পারে। তাই বলে এদেশের মানুষ তাদের সব দাবি মেনে নেবে, তার কোন কারণ নেই।
এটা এদেশের মানুষের খুব ভালোই মনে আছে '৯১-'৯৫ কিংবা ২০০১-২০০৫ সালের বিএনপি শাসনামলের কথা। বেগম জিয়ার উচিত ছিল যেদিন দেশে একযোগে বোমা হামলা হয় সেদিনই ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়া। একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার কথা না হয় না-ই বললাম।
বিএনপি আরেক দফা ক্ষমতায় এলেই দেশ পাকিস্তানে পরিণতি বরণের দিকে অগ্রসর হতো, সন্দেহ নেই। কারণ বাংলা ভাই এবং শায়খ রহমানের মতো জঙ্গি ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তৈরি করে চারদলীয় জোট মূলত একটি জঙ্গিবাদী অসুরচক্র তৈরি করতে চেয়েছিল, যা ছিল প্রকৃতপক্ষে তাদেরই বি টিম। পাকিস্তানে সামরিক জান্তা পারভেজ মোশাররফ যেমন পরোক্ষভাবে জঙ্গিদের সঙ্গে আঁতাত করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চেয়েছিলেন, বাংলাদেশে চারদলীয় জোটও ছিল সেই পথের অনুসারী। ওয়ান-ইলেভেন নামক পরিবর্তনটি বাংলাদেশের মানুষকে মূলত সেই অজগরের মুখগহ্বর থেকেই রক্ষা করেছে। যে যাই বলুক না কেন, তারেক-মামুন-বাবর-পিন্টুচক্র দেশে একের পর এক যে বলয় তৈরি করে রেখেছিল তা আওয়ামী লীগের পক্ষে ভাঙা সহজ ছিল না।
এতে ব্যাপক রক্তক্ষয়ের সম্ভাবনা অনিবার্য ছিল। তাই ওয়ান-ইলেভেনের মতো পথ ছাড়া এর কোন বিকল্প ছিল না।
বাংলাদেশের রাজনীতি মূলত ব্যক্তিকেন্দ্রিক। তা কারও অজানা নয়। ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছা এবং কমান্ড নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে প্রধান দুটি দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ।
জাতীয় পার্টি দেশে তৃতীয় অবস্থানে আছে যদিও, দলটির জনপ্রিয়তা বাড়ছে এমন কোন সম্ভাবনা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। জাতীয় পার্টির প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও নিজ দলের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, তা-ও লুকানো কোন বিষয় নয়।
এই যে ব্যক্তিবিশেষের একচ্ছত্র আধিপত্য, সেটা অনেকটা কায়েমি স্বার্থবাদিতা। মুখে গণতন্ত্রের কথা বলা হলেও এক ধরনের স্বৈরাচারী মনোভাব এর পেছনে কাজ করছে বেশ শক্ত ভাবেই। আর তা এখন পারিবারিক উত্তরাধিকার ধারণ করারও প্রয়াস হচ্ছে।
যা কোন জাতির জন্য অবশ্যই মঙ্গলজনক নয়।
বেগম জিয়া ইংল্যান্ড-আমেরিকা সফর শেষে ঢাকায় ফেরার পর বিমানবন্দরে প্রায় লাখো লোকের সমাবেশ করেছে বিএনপি। এ সমাবেশের মাধ্যমে জনমানুষের দৈনন্দিন জীবন ব্যাহত হয়েছে। এতে রাজনৈতিক দলের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সঙ্গত কারণে এ প্রশ্নটিও আসে, মানুষ এভাবে এসব অভ্যর্থনা সমাবেশে যায় কেন? এসব লোকদের কোন কাজ-কর্ম নেই? হ্যাঁ, বেকারত্ব বাংলাদেশে একটি বিরাট সমস্যা তো বটেই।
তার ওপর রাজনৈতিক উদ্যম যতটা না বেশি তার চেয়ে বেশি হুজুগের প্রবাহ।
বর্তমান মহাজোট সরকার মধ্যবর্তী নির্বাচন দেবে তা কস্মিনকালেও ভাবার কোন অবকাশ নেই। কারণ এই সরকার তো আর উড়ে এসে জুড়ে বসেনি। তার ওপর সরকার তাদের এজেন্ডা নিয়ে এগোচ্ছে। এরপরও বিরোধীদল সরকারি দলের সমালোচনা করতে পারে।
সরকারের ভুল নিয়ে জনগণের সমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করতেই পারে। কিন্তু তা হওয়া দরকার নীতিগতভাবে, তা না করে 'সরকার ফেলে দেব', 'কুপোকাত করে ছাড়ব' এমন দাম্ভোক্তি করার মাধ্যমে নিজেদের অপকর্মকেই ঢাকাতে চাইছে বিএনপি।
সরকারি সফরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন যুক্তরাষ্ট্র সফরে এসেছেন। তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, বিএনপি সরকারের সময়ই র্যাব তৈরি করা হয়েছিল। র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের সদস্যরা জঘন্য অপরাধীদের ধরতে অ্যাকশনে যায়।
ফলে শক্তিধর এসব অপরাধী পাল্টা আক্রমণ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর। আত্মরক্ষার্থে র্যাবকে তখন গুলি ছুড়তে হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, চারদলীয় জোটের সময়ই ক্রসফায়ারে বেশি নিহত হয়েছে। তিনি আরও বলেন, দোষী র্যাব সদস্য, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বর্তমান সরকার বদ্ধপরিকর।
বাংলাদেশে কিছু কিছু বিষয় আছে, যা প্রতিটি সরকারই নিজেদের প্রয়োজনে লালন করে।
র্যাব জন্ম দিয়েছিল বিএনপি। আওয়ামী লীগও তা লালন করছে। ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশে প্রায় পনেরো কোটি মানুষের নিরাপত্তা বিধানে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের মতো একটি চৌকস বাহিনী থাকতেই পারে। থাকা আবশ্যক বলে আমিও মনে করি। তবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- কোনমতেই সমর্থনযোগ্য নয়।
অন্যদিকে ঘৃণতম হত্যা, ধর্ষণ, রাহাজানি, ডাকাতি মামলার আসামিরাও যখন আইনের ফাঁক-ফোকর গলে জামিন পায় তখন আশ্চর্য না হয়ে উপায় থাকে না। এসব জঘন্য অপরাধীর বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে কেউ দাঁড়ানোর সাহস করে না। কারণ সাক্ষী হলে প্রাণভয় থেকে যায়। অপরাধীরা জামিন পেয়ে আরও জঘন্যতম সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়ে। এই যে আইনের ফাঁক-ফোকর, তা শুধরাতে না পারলে এসব সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়।
খুবই হতাশাজনক কথা হচ্ছে, আইনি ধারা কঠোর করে গণমানুষের জানমালের নিরাপত্তা দেয়ার প্রশ্নে বিএনপি সরকার কিংবা আওয়ামী লীগ সরকার কেউই গ্রহণযোগ্য দক্ষতা দেখাতে পারেনি অথবা পারছে না।
নিজেদের সমুদ্রসমান ব্যর্থতা জমা রেখে অন্যদের ব্যর্থতা খোঁজার চেষ্টা আকাশকুসুম কল্পনামাত্র। মধ্যবর্তী নির্বাচন হবে না জেনেও বেগম জিয়া এমন দাবি তুলছেন। এতে সংকট আরও জটিল হবে সন্দেহ নেই। কোন সমাধান হবে না।
নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত সরকারকে কাজ করতে দেয়া উচিত। গণতন্ত্র সেই সহনশীলতার শক্তিকেই শ্রেষ্ঠ বিবেচনা করে।
নিউইয়র্ক, ৩১ মে ২০১১
------------------------------------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ / ঢাকা / ৩ জুন ২০১১ শুক্রবার প্রকাশিত
ছবি- ডিওন লীন ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।