‘তুমি যাকে মৃত্যু বল, তুমি যাকে বল শেষ, সমূল পতন মানুষ গড়ার কারিগরেরা মাটির পুতুল থেকে সোনার মানুষ গড়ে দিয়েছেন। সবাই যে সোনার মানুষ হয়েছেন তা নয়, তবে অধিকাংশই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছেন নিজের জায়গায়। কেবল তাদের নিজেদের ভাগ্যের কোন উন্নয়ন ঘটেনি। তবে এতে বিন্দুমাত্র দুঃখের লেশ কখনো দেখিনি তাদের মাঝে।
আমি, আমাদের শিক্ষকদের কথা বলছিলাম।
কিছুদিন পূর্বে বাড়িতে গেছিলাম। বাড়িতে গেলে মোটরসাইকেল ছাড়া কোথাও বের হইনা। নিতান্ত না পেলে রিকশা নেই। সেদিন বাজার করে রিকশায় যাচ্ছিলাম। এমন সময় আমাদের স্কুলের একজন শিক্ষককে দেখলাম, ঘেমে নেয়ে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাচ্ছেন।
আমাদের বাসা থেকে স্কুলের দূরত্ব ৫ কিলোমিটার। আমার ঐ স্যারের বাসা আমার বাসা থেকেও আরো ৩ কিলোমিটার দূরে। মানে প্রতিদিন তিনি ৭ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে স্কুল করছেন। প্রচন্ড গরমে এই মধ্যবয়সে এসে একজন মানুষ কত কষ্ট করে স্কুলে যাচ্ছেন, ভাবতেই বুকের ভিতর থেকে একটা দ্বীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো। বিশেষ করে, সেই মানুষটার কল্যানেই আজ আমরা নিজ নিজ জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি।
অভাগা আমরা একবার খোঁজ নেয়ারও প্রয়োজন মনে করিনা, ভাগ্যাহত এই মানুষ গড়ার কারিগরদের।
তো, স্যারের স্কুলে যাওয়ার এই দৃশ্য নতুন নয়। আবার এমনও নয় যে, তিনি একাই এভাবে স্কুল করছেন। তার মত আরো অনেকেই এভাবে দিনের পর দিন সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যান-আসেন। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর আমাদের মত সাধারন ছাত্ররাই সাইকেল চালাতে পারিনা।
একেত পরিশ্রম আর অন্যদিকে প্রচন্ড গরম। অথচ সব কষ্ট ভূলে এই মানুষগুলো ছাত্রদের মানুষ করার মহৎ উদ্দ্যেশ্য নিয়ে ছুটে চলেছেন। নিজেকে বিলিয়ে অন্যের সন্তানদের মানুষ করার এই নজীর আর কে দখাতে পারে এই স্যাররা ছাড়া? অবশ্য আমার বিশ্বাস, কখনোই তারা ছাত্রদের অপরের সন্তান ভাবেন না, ভাবলে নিজের সন্তানের চেয়ে বেশী আদর আর ভালোবাসা দিয়ে আমাদের মানুষ করতে পারতেন না।
মনে পড়ে, ক্লাস ফোরে যখন পড়তাম, একজন বয়োবৃদ্ধ শিক্ষক আমাদের ক্লাস নিতেন। একই ক্লাসে তার ছেলেও পড়তো, যে কি’না এর আগের বার পাস করতে না পাড়ায় আমাদের সাথে পড়ছে।
সময়ের ব্যাবধানে সম্মানিত শিক্ষকের সেই ছেলের পড়াশুনা থেমে যায়। কিন্তু আমাদের মত পরের সন্তানদের মানুষ করার মিশন কিন্তু তিনি এক মুহূর্তের জন্যও থামাননি।
আমাদের বন্ধুদের অনেকেই এখন বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, অনেকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েও ভালো করছে। মেডিক্যাল কলেজ কিংবা বুয়েটেও পড়ছে কেউ কেউ। কিন্তু অল্প কিছু টাকা বেতন পেয়ে কোনরকম খেয়ে না খেয়ে থাকা সেই গুরুজনদের একান্ত তত্ত্বাবধান না পেলে ক’জন আসতে পারতো আজকের অবস্থানে?
১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই স্কুলে আমাদের আগের অনেক ছাত্র-ছাত্রী এখন প্রশাসনের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত।
স্যাররা গর্বের সাথে তাদের গল্প শোনাতেন। আমাদের বন্ধুদের অনেকেই হয়ত সেই অবস্থানে যাবে। এই সফল মানুষদের জীবনের প্রথম লগ্নতে মেঘে ঢাকা শঙ্কায় শঙ্কুল আকাশের মেঘ কেটে কেটে যারা দেখিয়েছেন প্রথম সূর্যের মূখ, কখনো সেই সূর্যের আলোটা তাদের বাড়ির উঠানে পড়বে কি’না তারা কি জানেন?
আজ দূর হতে অন্তরের অন্তস্থল থেকে ভালোবাসা জানাচ্ছি মানুষ গড়ার সেই কারিগরদের। তিলে তিলে নিজেদের নিঃশেষ করে যারা এগিয়ে চলেছেন মাটির পুতুল থেকে সোনার মানুষ গড়ার এই কঠিন অভিযানে বিপ্লবী অভিযাত্রির মতই। সালাম জানাই আমার সেই সম্মানিত শিক্ষকদের।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।