দেশের তরে আজ আমরা স্বাধীনতার ৪০ বছর উদযাপন করছি। বাংলাদেশি পতাকা জাতিসংঘের সদর দপ্তরের সামনে পৃথিবীর সব দেশের পতাকার মাঝে গৌরবের সাথে উড়ছে। আমরা আজ স্বাধীন জাতি । এই স্বাধীনতা ছিল বাঙ্গালি জাতির দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন । পরম আকাঙ্খিত বস্তু।
পলাশীর আমবাগানে যে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল তার পুনরায় উদয়ের জন্য এ জাতিকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। অনেক রক্ত ঝরেছে। বাঙ্গালি জাতি স্বাধীনতার স্বপ্নে বার বার ঐক্যবদ্ধ হয়েছে । ইংরেজ-বেনিয়াদের বিরুদ্ধে গড়ে তুলেছে ফকির বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, কৃষক বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, ফরায়েজি আন্দোলন। অনেক রক্ত আর ত্যাগের বিনিময়ে ১৯৪৭ এ আমরা পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত হই, কিন্তু আমাদের স¦াধীনতা ছিনতাই হয়ে যায় পাকিস্তানের একশ্রেনীর স্বৈরশাসকদের কারণে।
তারা আমাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। আমাদের ভাষার অধিকার কেড়ে নিতে চায়। বাঙ্গালি জাতি বুঝে তারা আবার পরাধীন হয়েছে। নতুন করে আমরা আবার স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখি। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে শুরু হয় ভাষা আন্দোলন ।
এরপর ’৫৪ যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬৬ এর ছয়দফা এবং ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এর পথ ধরে ১৯৭১ সালের চূড়ান্ত বিজয়। মাত্র একর্টি স্বপ্ন স্বাধীনতা। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে কত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছি আমরা। আমাদের স্বপ্ন ছিল,আত্মবিশ্বাস ছিল। তাই আমরা ধৈর্য হারাইনি।
সফল হয়েছি। স্বপ্ন একটি বিশাল ব্যাপার । স্বপ্ন দেখতে সাহস লাগে। স্বপ্ন মানুষকে বাঁচতে শিখায়। বেঁচে থাকার স্বপ্নে ডুবন্ত জাহাজের যাত্রীরা পানিতে ভাসমান তক্তা আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়।
বার বার আছাড় খেয়েও মানবশিশু হাঁটার স্বপ্নে আবার ওঠে দাঁড়ায়। এই স্বপ্ন মানুষের মাঝে এক অফুরন্ত প্রেরণা জাগায়। তাকে এনে দেয় প্রাণশক্তি। স্বপ্ন ছাড়া জাতি র্নিজীব-নিষ্প্রাণ হয়ে যায়। বিশ্বের দিকে তাকিয়ে দেখুন স্বাধীনতার স্বপ্নে ফিলিস্তিনি, কাশ্মীরিরা কত দীর্ঘ দিন ধরে লড়ছে।
ফিলিস্তিনের কিশোরেরা কি দুঃসাহসের সাথে গুলতি আর পাথর দিয়ে অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ইসরাঈলি সেনাদের মোকাবেলা করছে। অশিক্ষিত-দরিদ্র আফগানরা কীভাবে পরাশক্তি রাশিয়ার আগ্রাসন মোকাবেলা করেছে। বিশ্ববাসী অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখেছে ভিয়েতনামীরা কীভাবে পরাশক্তি মার্কিনিদের পরাজিত করেছিল। আমরা কীভাবে অল্পদিনের প্রশিক্ষণে পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেছি তাও এক বিষ্ময়। স¦াধীনতা আন্দোলনের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বাঙ্গালি জাতির যুবকেরা ছিল স্বপ্নে উদ্বেলিত।
৫২ তে কার্ফু লংঘন করে সারারাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্ররা পোস্টার লিখত। তাদের স্বপ্নাতুর চোখগুলো একটি স্বাধীন দেশের ছবি আঁকত। মুক্তিযুদ্ধের চিঠি বইয়েরর পাতায় পাতায় সেই স্বপ্নের কথাই শোনা যায়। হাজার হাজার তরুণ প্রিয়জনের মায়া ছিন্ন করে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের যুদ্ধে গিয়েছে। এক যুবক তার গর্ভবতী স্ত্রীকে চিঠি লিখেছে “আমি যুদ্ধ করছি আমার অনাগত সন্তানের জন্য এক স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নে”।
আজ স্বাধীনতার ৪০ বছর পর মনে হয় আমাদের আজকের যুবকদের তরুণদের কোন স্বপ্ন নেই। তারা আজ হতাশার মরু-প্রান্তরে তৃষ্ণার্ত বেদুঈনের মতো মরীচিকার পিছনের ঘুরে ঘুরে মরছে। মাদকের নীল নেশায় তারা তাদের জীবনের অর্থ খুঁজে ফিরছে। যদি কোন ছাত্রকে হঠাৎ প্রশ্ন করা হয় তুমি তোমার দেশের জন্য কি করতে চাও? অধিকাংশই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যাবে অথবা যে উত্তর দিবে তা তাৎক্ষণিক চিন্তার অপরিপক্ক ফসল। জাতির যুবকদের সব স্বপ্ন আজ ভাল চাকুরী, সুন্দরী বউ, বিলাসহুল গাড়ি আর নিশ্চিন্ত জীবনের নিশ্চয়তার জন্য একটি ব্যাংক ব্যালেন্সের বৃত্তে আবদ্ধ।
আমাদের স্বপ্নের আকাশটা খুব ছোট। ব্যক্তি স্বার্থের বাইরে গিয়ে চিন্তা করা যুবকের সংখ্যা খুব কম । যে জাতিতে যুবক-যুবতীদের সংখ্যা বেশি তারা প্রাণবন্ত জাতি, কিন্তু কোটি কোটি যুবক নিয়েও আমরা মন্থর গতিতে এগিয়ে চলছি। স্বাধীনতার স্বপ্নপূরণের পর একটি জাতির সামনে সে স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার দায়িত্ব আসে। জাতির নেতাদের তখন কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় যুবকদের মাঝে দেশগড়ার স্বপ্ন ছড়িয়ে দেয়া।
এ কাজটি করতে পেরেছিল জার্মানির নেতারা। ১ম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয় ও ২য় ভার্র্সাই চুক্তির অপমানের প্রতিশোধ নিতে জামার্নীকে জাগিয়ে তুলেছিলেন হিটলার। ১৯৩৩ সালে জার্মানির চ্যান্সেলর হয় হিটলার । ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৯ মাত্র ছয় বছর। এ সময় হিটলার সারা জার্মানি ঘুরে বেড়ায়।
যুবকদের নিয়ে সমাবেশ করে। হিটলারের অগ্নিঝরা ভাষনগুলো যুবকদের রক্তে আগুন ধরিয়ে দেয়। হিটলার জার্মানদের আত্মাভিমান জাগিয়ে তুলে। তাদের স¦প্ন দেখায় বিশ্বজয়ের। স্বপ্নাতুর জার্মান যুবকেরা বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংস স্তূপ থেকে জার্মানিকে আবার বিশ্বে উচ্চ মর্যাদায় আসীন করে।
আবার ২য় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হয় জার্মানরা কিন্তু পরাজয় মানে না তাদের স্বপ্নগুলো। তারা পুনরায় জার্মানিকে গড়ে তুলে। আজ জার্মানি পৃথিবীর ২য় বৃহত্তম রপ্তানীকারক দেশ। আবার আমরা জাপানের দিকে তাকালে কি দেখি। জাপানিরা হিরোসিমা নাগাসাকির ধ্বংস স্তূপ থেকে জাপানকে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত করেছে মাত্র দুই দশকের ব্যবধানে।
চাইনিজ জাতি, ভারতীয় জাতি দুর্বার গতি বেগে এগিয়ে যাচ্ছে। কারণ তাদের নেতারা যুবকদের স্বপ্ন দেখাতে পেরেছে। এক মাহাথির মোহাম্মদ মালয়দের স্বপ্ন দেখিয়ে মাত্র ২৩ বছরে কত উচ্চে নিয়ে গিয়েছে। মাহাথির যখন মালয়েশিয়ায় পৃথিবীর সর্বোচ্চ ভবন পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিল তখন অনেক মন্ত্রীরা এ উচ্চাভিলাসী পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছিল। তখন মাহাথির বলেছিলেন এ টাওয়ার দেখে মালয় জাতি সবোর্চ্চ স্বপ্ন দেখার প্রেরণা পাবে।
তাই আমাদের স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার জন্য দেশগড়ার স্বপ্ন দেখানের মতো একদল ভিশনারি নেতা দরকার। যারা যুবকদের স্বপ্ন দেখাবে। তাদের স্বাধীনতার গল্প শুনাবে। তাদের আমাদের সোনালি অতীতের প্রেরণাদায়ক কাহিনি শুনাবে। পৃথিবীর সফল দেশ ও সফল মানুষদের গল্প শুনিয়ে আমাদের উজ্জীবিত করবে।
আর বর্তমানের মূর্খ, ক্ষমতার মোহে অন্ধ, প্রতিহিংসা পরায়ণ নেতাদের কাছে এ জাতীয় স্বপ্ন আশা করা বোকামী। আমাদেরকে নতুন একটি মুক্তিযুদ্ধ প্রয়োজন। দেশ গড়ার মুক্তিযুদ্ধ,স্বপ্ন দেখার যুদ্ধ,স্বপ্ন দেখানোর যুদ্ধ। আমাদের মাঝ থেকেই বের করে আনতে হবে নতুন দিনের স্বাপ্নিক নেতৃত্ব। এরকম নেতা আসমান থেকে নাযিল হবে না।
আমাদের নিজেদেরকে এ দায়িত্ব কাধে তুলে নিতে হবে। আমরা আমাদের দেশপ্রেম, ভালবাসা আর স্বপ্নের সম্মিলনে আমাদের বাংলাদেশকে গড়ে তুলব মনের মাধুরী মিশিয়ে। আজ থেকে শুরু হোক স্বপ্ন দেখা আর স্বপ্ন দেখানোর দিন। আমাদের স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়েই স্বাধীনতার সফলতা আসবে ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।