স্বাধীনতার প্রতি আনুগত্য, প্রজন্মের ভাবনায় স্বাধীনতার চেতনা
ফকির ইলিয়াস
-----------------------------------------------------------------
আটত্রিশ বছর একটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতার জন্য কম সময় তা বলা যাবে না। বাংলাদেশ এই দীর্ঘ সময় পেরিয়ে এসেছে। কিন্তু সময়টি কি খুব সুখকর ছিল জাতির জন্য? খুব অনুকূল ছিল রাষ্ট্র গঠনের জন্য? না ছিল না। কেন ছিল না, সে উত্তর খোঁজার প্রয়োজন মনে করি। ১৯৪৭ সালে যখন পাক-ভারত ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীন হয় তখন ধর্মীয় সম্বরে দোহাই দিয়ে উর্দু ভাষি পাকিস্তানিরা দল বাঁধতে আগ্রহী হয় বাঙালিদের সঙ্গে।
এই ঐক্যের মূলমন্ত্র কি ছিল, তা পর্যালোচনা করার প্রয়োজন আজও আসছে।
জাতিসত্তার পরিচয় নয় বরং ‘আমরা মুসলমান’ এই ডঙ্কা বাজিয়ে উর্দু ভাষিরা ‘বিগব্রাদার’ সেজেছিল বাঙালিদের। কেন বাঙালিরা সেদিন এই নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিলেন যে প্রশ্ন আমি আজও করি নিজেকে। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সমকক্ষ নেতা কি ছিলেন না সেদিন বাঙালিদের মাঝে? হ্যাঁ, ছিলেন। তারা কেন সেদিন বাঙালিদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ডাক দেননি তা এখনও আমার বোধে আসে না।
ভারত পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ এই তিনটি রাষ্ট্র ১৯৪৭ সালেই জন্ম নিতে পারত। কিন্তু তা নেয়নি। পাকিস্তানি নেতারা সে সময়েই নিজেদের স্বার্থ চাপাতে ব্যস্ত ছিলেন বাঙালিদের ওপর। ভাষার দাসত্ব চাপিয়ে দেয়ার কাজটি ছিল প্রথম প্রচেষ্টা। তাতে তারা সফল হননি।
এরপর সামরিকতন্ত্র চাপিয়ে দিয়ে যে শিকল পরানোর চেষ্টা করা হয়েছিল তার প্রধান লক্ষ্য ছিল সেই বাঙালি জাতিই। পাকিস্তানিরা আসলেই গণতন্ত্রমনা ছিল না। এবং তাদের গণতন্ত্রমনস্কতা যে এই ২০০৯ সালেও গড়ে ওঠেনি তার প্রমাণ আমরা এ বছরও পেয়েছি। জারদারি-গিলানির সরকার নওয়াজ শরিফের দলও সমর্থকদের টুঁটি চেপে ধরতে চেয়েছিল। পরে আমেরিকার চাপ এবং সামরিক জান্তারা আবার ক্ষমতা নিয়ে নেয়ার ধমক দেয় তখনই তারা মেনে নেয় নওয়াজ সমর্থকদের দাবি।
এটা খুব স্পষ্ট, এখনও পাকিস্তানে গণতন্ত্র নিরাপদ নয়। তাদের নেতাদের ডানহস্ত এখনও সামরিক বুটের নিচে।
সেই পাকিস্তানিরা ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বাঙালিদের সঙ্গে যে আচরণ করেছিল, এখন তারা সে আচরণ করছে নিজ দেশের মানুষের সঙ্গেই। পাঞ্জাব, বেলুচ, সিরিা যে একে অপরকে বিশ্বাস করতে পারছে না তা স্পষ্ট হচ্ছে ক্রমেই। আর অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে এগুচ্ছে পাকিস্তান।
ঠিক একইভাবে পাকিস্তানিরা, বাঙালি জাতিকে অনিশ্চয়তায় ডুবিয়ে রেখে শোষণ করতে চেয়েছিল। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় বাঙালি জাতি। সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে আদায় করে নিজেদের স্বাধীনতা।
কিন্তু স্বাধীনতা পাওয়াটাই কি শেষ কথা ছিল? না, ছিল না। সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রত্যাশা নিয়ে যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল এর জনসংখ্যা এখন ঠিক দ্বিগুণ।
বাড়েনি ভূমি। কিন্তু মানুষ ঠিকই বেড়েছে।
যে ভূমি, শক্তি, সামর্থ্য নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল তা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে এই দেশটিও উন্নতির বরমাল্য পেতে পারত। কিন্তু তা হয়নি।
দুই.
কাংখিত লক্ষ্যবিন্দুতে পৌঁছতে না পারার প্রথম কারণটি হচ্ছে রাজনৈতিক ব্যর্থতা।
এই ব্যর্থতার বীজ কারা বুনেছিল এবং কিভাবে বুনেছিল তা সচেতন মানুষের অজানা নয়। ১৯৭২ থেকে পঁচাত্তরের আগস্ট, মাত্র সাড়ে তিন বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল বঙ্গবু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার। জাতির জনক বঙ্গবুকে যতই সমালোচনা করার চেষ্টা করা হোক না কেন রাষ্ট্রগঠন এবং জাতির স্বপ্নপূরণে তার চেষ্টার কোন ঘাটতি ছিল না। অথচ ঠিক সে সময়ে সেই শকুনেরা ছিল তৎপর। তারা সর্বহারা, সমাজবাদী, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের বিপ্লবীদের সঙ্গে মিশে গিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিলে তৎপর ছিল।
জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার পর এরা নিজ চরিত্রে বেরিয়ে আসে প্রত্যক্ষরূপে। সেনা শাসকদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তারা গোটা বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে ’৭১-এর পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে তৎপর হয়।
সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের ছায়াতলে দাঁড়িয়ে যারা তথাকথিত ‘দেশ গড়া’-র যে প্রত্যয় (?) ব্যক্ত করেছিল তারা কি আসলেই জাতিসত্তার প্রতি অনুগত ছিল? না ছিল না। মুখে তারা ‘মিলেমিশে’ কাজ করার কথা বললেও মূলত ছিল সেই পাকিস্তানি পরাজিতদের প্রেতাত্মা। যারা বাংলাদেশের বিজয়কে মেনে নিতে পারেনি।
আর পারেনি বলেই ছলে-বলে-কৌশলে তারা সেই পাক প্রভুদের স্বার্থ রক্ষা করেছে। তাদের জয়গান গেয়েছে। ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি কিংবা ক্ষমতায় টিকে থাকার খাম্বা হিসেবে তারা কাজে লেগেছে সামরিক শাসকদের।
এর মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের সংগঠিত করেছেন নানাভাবে আবির্ভূত হয়েছে সস্তা বুলি আওড়িয়ে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা, স্বার্বভৌমত্বের জন্য এখনও প্রধান হুমকি হচ্ছে সেই মৌলবাদীরাই।
যারা ধর্মীয় জোশ কাজে লাগিয়ে জনগণের চোখে ধুলা দিতে চায়। বাংলাদেশে প্রায় প্রতি মাসেই নতুন নতুন ধর্মীয় জঙ্গিবাদী দলের অস্তিত্বের খবর পত্রপত্রিকায় বেরুচ্ছে। এরা কারা? তারা কি নতুন? না তারা নতুন নয়। তারা বহু নামে আবির্ভূত হচ্ছে। বহু পরিচয়ে।
একই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য মরিয়া হয়ে উঠছে। আর সেই তত্ত্বটি হচ্ছে ধর্মীয় উন্মাদনা ভরা মৌলবাদ। যা ক্রমশ পাকিস্তান-আফগানিস্তানকে গ্রাস করেছে। যে আল কায়দা তত্ত্ব হরণ করতে চাইছে গোটা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের পরিশুদ্ধ চেতনার উৎস।
বাংলাদেশে এখনও দুইটি পক্ষ।
একটি গণমানুষের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ী। আর অন্যটি ‘মিলেমিশে’ কাজ করার প্রত্যাশী। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময় দেখা গেছে, এই ‘মিলেমিশে’ কাজ করার প্রবক্তারা ক্রমশ গ্রাস করেছে বিএনপির বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। মীর শওকত, কর্নেল অলি, মেজর আখতারুজ্জামানের মতো বিএনপির নেতারা কোণঠাসা হয়েছেন রাজাকারদের হাতে। এর কারণ কি? কারণটি হচ্ছে, জিয়াউর রহমান কর্তৃক রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব পরাজিত রাজাকারদের হাতে তুলে দেয়ার পরিণতি।
বর্তমান মহাজোট সরকার যে বৃহৎ জয় পেয়েছে এর অন্যতম কারণ হচ্ছে যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের বিরুদ্ধে জনগণের ম্যান্ডেট। গণমানুষ চেয়েছে এদের বিচার হোক। রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার যাত্রা স্খায়িত্ব পাক। বর্তমান সরকারকে সেই কাজটি করার মাধ্যমেই একটি ধাপ এগিয়ে যেতে পারে। যতই কঠিন হোক এই কাজটি করতেই হবে বর্তমান সরকারকে।
দু’মাস বয়সী মহাজোট সরকারকে থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে নানাভাবে। সময়টি খুব খারাপ সতর্ক থাকবে। আমি খুব দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। এই প্রজন্মের চেতনায় স্বাধীনতার পরিশুদ্ধ বিবেক উজ্জ্বলভাবে জাগ্রত। এই শক্তিকে ধরে রাখতে হবে।
কাজে লাগাতে হবে। যতই বাধা আসুক, এই পতাকার প্রতি সম্মান জানাতেই হবে বুকে হাত দিয়ে। মনে রাখতে হবে, যারা লাখো শহীদের রক্তের ঋণ স্বীকার করে না তারা এ মাটির মিত্র নয়।
২৩ মার্চ ২০০৯
--------------------------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ। ঢাকা।
২৬ মার্চ ২০০৯ বৃহস্পতিবার প্রকাশিত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।