,,,কুয়াশার আড়ালে লুকানো ঘটনা কুয়াশার চাদরে জড়ানো সকালের মোহনীয় রূপের মত নিস্পাপ, নিস্কলঙ্ক, নির্মোহ নয়,,,
‘ব্রেক-ডাউন’ শব্দটা শুনলে আপনি সাথে সাথে বুঝে নেবেন কোন কিছুর ছন্দ-পতন বোঝানো হচ্ছে। সেটা হতে পারে গাড়ির স্পীড লিমিটের ক্ষেত্রে বা কোন কাজ করার ক্ষেত্রে মনযোগের ব্যাঘাত ঘটা। কিন্তু আপনি যখন এই লেখাটার শিরোনাম পড়ে লেখাটি পড়তে উদ্যত হলেন, আমি নিশ্চিত আপনি আমাদের ফাস্ট জেনারেশনের রিলেশন ‘ব্রেক-আপ’ নামক রোগটার ব্যাপার নিয়ে কিছু একটা পড়তেই ঢুকেছেন।
আমি আপনাকে আশাহত করব না। আমার এই লেখাটির বিষয় সেই ব্রেক-আপ নিয়েই।
সেদিন বসে আছি লেকের পাড়ে, রবীন্দ্র সরোবরের সীমানা ঘেষে। বরাবরের মতই রাত ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে আড্ডার ব্যাপ্তিও বাড়ছে। আড্ডায় নতুন নতুন পোলাপানের সমাগম ঘটছে। মোটামুটি সবাইকে দেখলেও আকাশের কোন খবর নেই। কিন্তু বিশ্বপ্রেমিক আকাশ কখনই এইসব অকেশন মিস করে না।
আমি সজলকে জিজ্ঞেস করলাম- ‘কিরে, আকাশ কই?’
-জানি না, দুইদিন ধরে ক্লাশেও আসে না।
-আশ্চর্য!! ফোন করে খবর নিবি না?
-ফোন ধরলে তো খবর নিব? ওর ফোন তো দুইদিন ধরে বন্ধ।
তখনি আমার মনে পড়ে যে আমিও ওকে গতকাল ফোন করে পাইনি। মনে করেছিলাম এমনি কোন কারণে বন্ধ আছে। কিন্তু এমন একটা বড় গেদারিং আড্ডাবাজ আকাশকে ছাড়া কোন মতেই জমানো সম্ভব না ভেবে ফোন দিলাম ওর নিচের ফ্লাটের ছোট ভাই রাসেলকে, বললাম তুমি ফোন নিয়ে আকাশের রুমে যাও আমি কল দিচ্ছি।
একটু পর আকাশের ভারী কন্ঠস্বর ওপাশ থেকে ভেসে আসে। এক মিনিটের ফোনালাপেই বুঝলাম আকাশের অসুখটা হৃদয় ঘটিত। সেদিনের আড্ডাটা আর জমলো না।
বিকেলের নাস্তা খেয়েই সবাই মিলে রওনা দিলাম লালমাটিয়ায় আকাশের বাসার উদ্দেশ্যে। দরজা খুলে দেন সদা-হাস্যোজ্জল পারভীন আপু।
কিন্তু আজকে তার চেহারা মলিন। বুঝলাম আদরের ছোট ভাইয়ের হঠাত এই পরিবর্ত্ন তাদেরকেও স্পর্শ করেছে। আমরা সবার মিলে ঢুকি আকাশের রুমে। দেখি প্রতিদিনের প্রাণচঞ্ছল আকাশ মরার মত উপুড় হয়ে পড়ে আছে। ও’কে আমি ডেকে তুলি।
এভাবে সবাইকে দেখে ও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।
-কিরে শালা, ফোন বন্ধ রাখসিস ক্যান? সজলের প্রথাগত চেচানো শুরু হয়ে যায়।
কিন্তু কথার পিঠে কথা বলতে ওস্তাদ আকাশ এখন নিস্প্রভ দৃষ্টিতে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে।
অনেক জোড়াজুড়িতে প্রায় আধঘন্টা পর ও মুখ খুলে। আমরা পাই আকাশের ব্রেক-আপের খবর।
এই ধরণের খবর আমাদের কাছে নতুন কিছু ছিল না। কারণ আকাশ শুধুমাত্র ও’র ভার্সিটিরই তিনটা মেয়ের সাথে এই কান্ড করেছে। আর সবগুলো ঘটেছে ও’র পক্ষ থেকেই। সুন্দর থেকে সুন্দরতমের প্রতি অদম্য আকর্ষনের কারণে আমরা ওর নামই দিয়ে দিয়েছি বিশ্বপ্রেমিক। কিন্তু গত এক বছর ধরে এক ব্যাচ জুনিয়র নাঈমা’র সাথে আকাশ খুবই স্ট্যাবল ছিল।
এতটা স্ট্যাবল আগের অন্য কোন রিলেশনে ও ছিল না। আমাদের যে কোন পার্টিতে ও নাঈমা’কে সাথে করেই নিয়ে আসত। এমনকি আকাশের বাবা-মাও নাঈমাকে ছেলের হবু বধূ হিসেবে মেনে নিতে মনস্থির করে ফেলেছিল। কিন্তু গত সপ্তাহে নাঈমা নাকি ওকে বলেছে এই রিলেশন কন্টিনিউ করা ওর পক্ষে সম্ভব না। আকাশ অনেক চেষ্টা করেছে।
কিন্তু রোববার যখন ক্লাশ শেষে নাঈমা তার প্রাক্তন বয়-ফ্রেন্ডের পাজেরোতে চড়ে বসে, তখনি আকাশ বুঝে ফেলে আসলেই এই রিলেশন আর টিকবে না। নাঈমা তার সাবেক বয়-ফ্রেন্ডের নব্য প্রেমডাকে সাড়া দিয়ে নতুন বসন্ত সাজাতে ব্যাস্ত। অথচ এক বছর আগে নাঈমার এই আধ-পাগলা বয়-ফ্রেন্ড যখন আরেক হুর-পরীর ভালবাসা অন্বেষনে নাঈমাকে গুড-বাই বলেছিল তখন আকাশই ওকে স্বাভাবিক হতে সাহায্য করেছে।
কথাগুলো যখন শুনছিলাম তখন পুরো রুমটাতে পিন-পতন নীরবতা। কথার পিঠে টিপ্পনী কাটার স্বভাবটা সবার রক্তে মিশে থাকলেও আমাদের সবার প্রিয় বন্ধুর হৃদয় ভাঙ্গার বেদনা তখন আমাদেরকেও স্পর্শ করেছিল।
আকাশের চোখে-মুখে ছিল খুব কাছের কাউকে হারাবার বেদনা।
আমার এই বন্ধুটি যখন নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে বিরহ পালন করছে, ঠিক তখনি হয়তো নাঈমা ক্লাশ ফাকি দিয়ে তার ফিরে আসা প্রেমিক, কোটিপতি বাবার একমাত্র ফার্মের মুরগীটির সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নাঈমার এই ব্রেক-আপটা হয়তো তার নিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য দরকার ছিল। সত্যিই তো, মধ্যবিত্ত পরিবারের আকাশের প্রতিষ্ঠা পাবার জন্য নাঈমা তো আর বসে থাকতে পারে না। তাই নাঈমা তার এক বছরের রিলেশন ‘ব্রেক’ করে ‘আপ’ স্ট্যাটাসের দিকে হাত বাড়িয়েছে।
আকাশও হয়তোবা এমনি বসে থাকবে না। আকাশও হয়তোবা খুব শিঘ্রী দূর-দৃষ্টিবান হয়ে ফাস্ট ইয়ারের কোন হায়ার স্ট্যটাস-ওয়ালা মেয়েকে পটিয়ে ফেলবে-যাতে পাশ করে স্ট্যাব্লিশ হবার সময় পাওয়া যায়। আর বিয়ের সময় রাজত্ব আর রাজকন্যা দুটোর দখল একসাথে পাওয়া যায়।
এটাই হয়তো এখনকার নিয়ম। কারণ আমরা যে ডি-জ্যুস জেনারেশন।
আমদের কি আর রোমিও-জুলিয়েটের মত প্রেম করা সাজে! আমরা সারা রাত একজনের সাথে কথা বলব, ক্লাশে এসে একজনের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসব আর ক্লাশ শেষে অপর আরেকজনের সাথে মার্কেটে যাব। এখন একটি মেয়ে একটি ছেলের সাথে হেসে পাচ মিনিট গল্প করলেই প্রেমিক-প্রেমিকা হয়ে যায়। ফেসবুকে ছেলেটার কোন অ্যক্টিভিটি মেয়েটার পছন্দ না হলেই রিলেশন ব্রেক-আপ হয়ে যায়। প্রেম-ভালবাসা যেন এখন লাইফ সার্পোটিং সিস্টেম, যেখানে ২৪ ঘ্ন্টা অক্সিজেনের সাপ্লাই চালু রাখতে হয়। আর তানাহলে বেচারা ‘প্রেম’ বেঘোরে প্রাণ হারায়।
আমাদের এই সিঙ্গেল থাকা, সিঙ্গেল থেকে এনগ্যজড হওয়া এবং আবার ব্রেক-আপ করা যেন একটা ফ্যশনে পরিণত হয়েছে। আমাদের এই মেকি প্রেমাভিনয়ের ছোটলোকিকে আমরা প্রতিদিনই নিত্য-নতুন মাত্রা দিচ্ছি। প্রেমিককে করেছি বয়ফ্রেন্ড, প্রেমিকাকে করেছি টাইমপাসের আইটেম। এর চেয়ে বুঝি বা টলস্টয়ের আন্না কারেনিন’ও ভাল ছিল। ভ্রন্সকির সাথে প্রেম পুরোপুরি অবৈধ হলেও তাতে কোন খাদ ছিল না।
অথচ আমরা আধুনিকতার দোহাই দিয়ে লোভনীয় শিকারের খোজে প্রেমের আকাশে আজ শকুনের মত উড়ে বেড়াচ্ছি।
হায় আল্লাহ, আমরা যারা এখনো সিঙ্গেল তারা যেন প্রফিটেবল কাউকে গার্লফ্রেন্ড/বয়ফ্রেন্ড হিসেবে পাই। আর যারা এখন এনগেজড তারা যেন চলমান রিলেশন ব্রেক হয়ে গেলে আপ স্ট্যাটাসের কাউকে শিকার করতে পারি।
আমিন। ।
(বন্ধুত্বের দায়বদ্ধতার প্রতি সম্মান দেখাতে আমার এই লেখাটির স্থান-কাল-পাত্র সামান্য পরিবর্তিত)
১৮/০৪/১১
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।