যতোবার আমি শান্তি খুঁজেছি, ঠিক ততোবার আমার মাথায় শুধু একটি চিন্তাই এসেছে। সেটা হচ্ছে একটা ড্রিল মেশিন দিয়ে মাথার খুলিটা ফুটো করে দেওয়ার চিন্তা।
চেঙ্গিস খান,পৃথিবীর ইতিহাসে চিরকালের জন্যে স্থান পাওয়া মঙ্গোলীয় সম্রাটের নাম। তার নিষ্ঠুরতা অন্য যে কারো নিষ্ঠুরতাকে আজও হার মানায়। সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সময় যুদ্ধে ৪০ লাখেরও বেশি মানুষ হত্যা করে এই চেঙ্গিস বাহিনী।
ইতিহাসের সবচেয়ে বড় লুটেরা ছিলেন এই তেমুজিন বা চেঙ্গিস খান।
তার ২০ বছরের রাজত্বকালে আস্তে আস্তে সে জয় করে পারস্য ,এশিয়া মাইনর,কোরিয়া,দক্ষিন ভারত, ইউরোপের কিছু অংশ , চীন সাম্রাজ্য এবং ইন্দোনেশিয়া।
চেঙ্গিস খান মারা যান ১২২৭ সালে , চীনে , ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে। তার দেহ চীন থেকে ফিরিয়ে আনা হয় মঙ্গোলিয়াতে। তাকে কোন এক অজ্ঞাত স্থানে কবর দেওয়া হয়।
তার বিখ্যাত জীবনের ইতিহাস এখানে শেষ হলেও,ঠিক এখান থেকেই চমকপ্রদ এক রহস্যের শুরু।
যুগে যুগে মানুষ এই মঙ্গোলীয় সম্রাটের সমাধিক্ষেত্র খুজে গেছে। বছরের পর বছর নষ্ট করেছে এই সমাধি খোঁজার পিছে। সমাধি মেলেনি। মানুষ তবুও হাল ছাড়ে না।
কেন এতো আগ্রহ এই সমাধির পিছে ? কি তার রহস্য ?
বলা হয় ,চেঙ্গিস খানের সমাধিটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অনাবিষ্কৃত এবং অক্ষত,অর্ধেক পৃথিবীর ধনসম্পদে ঠাসা একটি রত্নভাণ্ডার !
এটি মোটামুটি নিশ্চিত যে চেঙ্গিস খান সারাজীবনে যে পরিমান ধনসম্পদ এবং রত্ন লুট করেছেন , তার পুরোটুকুই সমাধিক্ষেত্রে চেঙ্গিস খানের সাথে রেখে দেওয়া আছে। জয় করা ৭৮ জন রাজার মুকুট সেখানেই আছে বলে ধারনা করেন অনেকে।
ইতিহাস বলে , মৃত্যুর অনেক আগেই চেঙ্গিস খান তার নিজের কবরের জায়গা পছন্দ করে রেখেছিলেন। তার কবরের স্থান নিয়ে অনেক মতানৈক্য আছে। কেউ কেউ বলেন,মঙ্গোলিয়ার খিনগান পর্বতমালার “বুরখান খালদুন” নামক পর্বতের পাদদেশে কোন একটা বড় গাছের নিচে তার সমাধিক্ষেত্র ঠিক করা হয়েছিল।
অনেক ইতিহাসবেত্তার মতে ,তার সমাধিক্ষেত্র কোন এক নদীর আশেপাশে কিংবা নদীর কোন এক অগভীর অংশে অবস্থিত। আবার অনেকে বলেন , তাকে কবর দিয়ে কবরের উপর থেকে শত শত ঘোড়া দৌড়িয়ে নেওয়া হয় ,যাতে তার কবরের উঁচু অংশ পুরোপুরি মাটির সাথে মিশে যায় এবং সেখানে গাছপালা লাগিয়ে একটি গভীর জঙ্গল তৈরি করা হয়।
ইতিহাস অনেক কথাই বলে। যে সমাধিক্ষেত্র এতো ধনসম্পদে ঠাসা , ইতিহাস খুজে কি আর তাকে বের করা যায়? ইতিহাস দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে হয়তোবা। এই গুপ্ততথ্য মানুষের চিন্তার আড়ালে নিয়ে যাওয়ার জন্যে মঙ্গোলীয়দের প্রচেষ্টাও তো কম ছিল না।
এমনকি , চেঙ্গিস খানের কবর খোঁড়ার কাজে নিয়োজিত ২৫০০ শ্রমিককে হত্যা করে চেঙ্গিস একদল সৈন্য , যাতে কোনোভাবেই কবরটিকে আর খুজে না পাওয়া যায়। এটা আরও নিশ্চিত করতে সেই সৈন্য দলকেও পরবর্তীতে হত্যা করে আরেকদল সৈন্য যারা সেই স্থানে উপস্থিত ছিল না । চেঙ্গিস খানের কবর হারিয়ে যায়। চিহ্ন রয় না আর সমাধিক্ষেত্রটির। মঙ্গোলীয় এক অভিশাপ দিয়ে জায়গাটা বেধে দেওয়া হয় ,যাতে সম্রাটের শেষ শান্তির ঘুম কেউ নষ্ট না করতে পারে।
প্রশান্ত মহাসাগর থেকে অ্যারাল সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত তার সাম্রাজ্যে অগনিত স্থানকে তার সমাধিক্ষেত্র হিসেবে সন্দেহ করা যায়। কিছু কিছু ইতিহাস বেশ জোরেশোরেই বলে ,চেঙ্গিস খান এর সমাধি মঙ্গোলিয়ার ভিতরে কোন দুর্গম পাহাড়ের কাছে রয়েছে। আবার কারো কারো দাবী , চেঙ্গিস খান কে চীন দেশেই সমাধিস্থ করা হয় ,যেখানে তার মৃত্যু হয়েছিলো। অবশ্য দ্বিতীয় ধারনাটি খুব বেশি গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।
চেঙ্গিস খানের মৃত্যুর পর বহুবছর মঙ্গোলিয়া পাশ্চাত্য প্রত্নতত্ত্ব দলের আয়ত্তের বাইরে ছিল।
সেসময় মঙ্গোলিয়ার একটা অংশ সোভিয়েত ইউনিয়নের এবং আরেক অংশ চীনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযানের জন্য তৎকালীন সরকারের সেরকম সামর্থ্য এবং ইচ্ছা কোনটাই ছিলনা। সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পরে এটি কিছুটা হলেও বহিরাগত প্রত্নতত্ত্ববিদদের আয়ত্তের মধ্যে আসে।
তথ্যের অভাবে ও জনগণের অসহযোগিতায় খুব শীঘ্রই প্রত্নতত্ত্ব বিদরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। এমনকি তারা এটাও নিশ্চিত হতে পারছিলেন না যে চেঙ্গিস খান কে আসলেই সমাধিস্থ করা হয়েছে কিনা।
‘মরি ক্রাভিটস’ তার জীবনের ৪০ বছর অতিবাহিত করেছেন শুধুমাত্র চেঙ্গিস খানের সমাধি খোঁজার পিছে। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বেশ কয়েকবার অভিযান চালানো হয় যা ছিল পুরোপুরিভাবেই ব্যর্থ।
১৯৯৩ থেকে ১৯৯৬ সালের মাঝে একটি জাপানিজ টীম স্যাটেলাইট ও ম্যাগ্নেটোমিটার ব্যবহার করে অভিযান চালায় , যদিও সেটাও ছিল ফলশুন্য। এরপর ২০০০ সালে আবারো ‘মরি ক্রাভিটস’ এর নেতৃত্বে আমেরিকান ও মঙ্গোলীয় যৌথ এক দল বিশাল এক অভিযান চালায়। ২০০১ সালে এক চমকপ্রদ আবিস্কার করে ক্রাভিটস এর দল।
তারা ‘খেরেম’ নামক একটি স্থান বের করতে সক্ষম হয় , যেখানে সমাধি থাকার বেশ ভালোরকম সম্ভাবনা ছিল। খেরেম কে চেঙ্গিস এর দেয়াল বলা হয়ে থাকে।
২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত অভিযাত্রিক দলটি ছিল পুরোপুরি নিস্প্রভ। এমতাবস্থায় খেরেম সম্বন্ধীয় তথ্য প্রকাশ করা হয়নি কোন এক অজ্ঞাত কারনে। ২০০৬ সালে আবারো খননকার্য শুরু হয়।
৩৯ টি সাধারণ কবরের উপস্থিতি এখানে সম্রাটের সমাধির সম্ভাবনাকে অনেকটাই ম্লান করে দেয়।
গ্রহণযোগ্যতার দিক থেকে অবশ্য “বুরখান খালদুন” পর্বত অনেক এগিয়ে। ১৫ শ শতকের এক ফরাসী পাদ্রী বেশ দৃঢ়ভাবেই বলে গেছেন -“বুরখান খালদুন” পর্বতের কাছের দুটি নদী ‘খেরলেন’ এবং “ব্রুচি” এর সংযোগস্থল সবচেয়ে সম্ভাবনাময় একটি জায়গা।
এটিই সেই জায়গা যেখানে চেঙ্গিস খানের শৈশব কেটেছে। ‘এই জায়গাটি চিরকালই আমার প্রিয় রবে’ কোন একটা যুদ্ধ জয়ের পরে এভাবেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন বলে দাবী করেন পাদ্রী।
‘খেরলেন’ নদী খুজে পাওয়া যায় , কিন্তু বর্তমানে “ব্রুচি” এর যে কোন চিহ্নই নেই। এই নদীটির কোনরকম অস্তিত্ব বর্তমানে খুজে পাওয়া সম্ভব না। কালের গর্ভে সেই সম্ভাবনা বিলীন হয়েছে।
তাই চেঙ্গিস খানের সমাধিক্ষেত্র আজও রয়েছে অধরা,অনাবিষ্কৃত। মধ্যযুগীয় ধনসম্পদের সবচেয়ে বড় গুপ্তধনটি কেউ ছুঁতেও পারেনি ।
রয়ে গেছে তা শত শত বছর পরেও সব চোখের আড়ালে।
বুরখান খালদুন
তবুও ক্রাভিটস এর ব্যক্তিগত মতামত অনুসারে -“বুরখান খালদুন” পর্বতমালাই হল সম্রাটের শেষ আশ্রয়স্থল। তবে পর্বতমালার বিশেষ কোন পাহাড়টিতে লুকিয়ে আছে মূল্যবান ধনসম্পদে ঠাসা সম্রাটের সেই রহস্যময় সমাধি ,তা তাদের কাছে পুরোপুরি আঁধারে। এই আধারে কোন আলোই খুজে পাচ্ছেন না আজকের দুনিয়ার প্রত্নতত্ত্ববিদরা। দুর্গম পর্বতমালা জয় করাও অনেক কঠিন , এখানে পদে পদে ছড়িয়ে আছে হিংস্র বন্য সব জন্তু , বিষাক্ত সাপ, গভীর গভীর সব খাঁদ , প্লেগের প্রকোপ , এবং সবশেষে মঙ্গোলীয় অভিশাপ !
তথ্য : ইন্টারনেট ।
ছবি : ইন্টারনেট ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।