সাতশ বছর আগের কথা। একজন মানুষ প্রায় পুরো পৃথিবীটাই জয় করে ফেলেছিল। নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আবিস্কার হওয়া অর্ধেক পৃথিবীর অধিপতি হিসেবে। শুধু কি তাই? তাঁর ত্রাস আর ভীতির রাজত্ব চলেছিল আরও প্রায় কয়েক প্রজন্ম। ফলে ‘শক্তিশালী গুপ্ত ঘাতক’ ‘বিধাতার চাবুক’ ‘প্রকৃত যোদ্ধা’ ‘রাজার রাজা’, এমন অনেক উপাধি পেয়েছিলেন তিনি।
এতো সব উপাধি পেলেও, তিনি আমাদের কাছে সবচেয়ে বেশী পরিচিত ‘চেঙ্গিস খান’ নামে।
এমন উপাধি অন্য অনেক সম্রাটই পেয়েছেন। অন্য সব সম্রাটের ক্ষেত্রে এইসব উপাধি প্রযোজ্য না হলেও, তাঁর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা তেমন না। উপাথিগুলোর সবগুলোই তাঁর প্রাপ্য। আমেরিকান আর ইউরোপীয় সংস্কৃতিতে বড় হওয়া মানুষদের কাছে ‘গ্রেট’ শুরু হতো ম্যাসেডন এর অ্যালেকজান্ডারকে দিয়ে।
আর তা চলতো সিজার হয়ে নেপলিয়ান পর্যন্ত। তবে চেঙ্গিস খান ছিলেন, ইউরোপের এসব পরিচিত নায়কদের চেয়ে অনেক বড় মাপের সম্রাট।
আসলে তাঁকে সাধারণভাবে পরিমাপ করা দুঃসাধ্য একটি কাজ। তিনি যখন তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করতেন, তখন তার পরিমাপ মাইলের হিসেবে করা যেত না, পরিমাপ করতে হত অক্ষাংশ আর দ্রাঘিমাংশের হিসেবে। তাঁর চলার পথে যে সব শহর পড়তো, সেসব শহর হারিয়ে যেত।
নদীর গতিপথ পাল্টে যেত, মরুভুমি পূর্ণ হয়ে যেত ছুটোছুটি করা আর মূমূর্ষ মানুষে। আর যখন তিনি কোন এলাকা পার হয়ে আসতেন, সেই এলাকায় নেকড়ে আর দাঁড়কাক ছাড়া অন্য কোন প্রাণীর দেখা পাওয়া যেত না।
তাঁর সৃষ্ট মানব জীবনের এমন ধ্বংসযজ্ঞ, আধুনিক সব কল্পনাকেও হার মানায়। গোবি মরুভুমি থেকে বেরিয়ে আসা একজন উপজাতি গোত্রপতি, এই চেঙ্গিস খান, পুরো পৃথিবীর সভ্য মানুষদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। আর তারপর জয়ীও হয়েছিল।
কথাগুলো বুঝতে হলে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে ত্রয়োদশ শতাব্দীর দিকে।
তাঁর পুরো গল্পটা যদি শুধু যদি শুধু এই ধ্বংসযজ্ঞ আর মানব সভ্যতাকে রুখে দেয়ার গল্পই হতো, তবে চেঙ্গিস খানকে কেউ দ্বিতীয় অ্যাট্টিলা (হুন দের রাজা, ৪৩৪-৪৫৩ পর্যন্ত ভয়ংকর ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে ছিলেন) বা তৈমুর লং এর চেয়ে বেশী কিছু ভাবতো না। এদের কাজ ছিল কোন উদ্দেশ্য ছাড়াই ধ্বংস যজ্ঞ চালানো। তবে ‘বিধাতার চাবুক’ নামে খ্যাত এই মানুষটি ছিলেন নির্ভুল এক যোদ্ধা। মুকুট আর উপাধির সম্রাট।
ত্রয়োদশ শতাব্দী আর তাঁর পরিবেশের আলোকে বিচার না করলে চেঙ্গিস খানকে ঘিরে থাকা রহস্যের অবসান হবে না। একজন উপজাতি, একজন শিকারি আর পশু চড়ানো রাখাল, কিভাবে তিনটি সাম্রাজ্যের শক্তি ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। তিনি নিজে ছিলেন একজন বর্বর। এমন একজন যিনি নিজে কখনও কোন শহর দেখেনি, জানতেন না লেখাপড়া। অথচ, তিনি আইন তৈরি করেছিলেন পঞ্চাশটি জনপদের জন্য।
তাঁর সামরিক প্রতিভাও ছিল অবাক করা। ইউরপীয়দের সেনাপতিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী সামরিক প্রতিভা ছিল নেপলিয়ানের। কিন্তু তিনি করলেন? বিশাল এক সেনাদলকে মিশরে তাঁদের নিজ ভাগ্যের ভরসায় পরিত্যাগ করেছিলেন। আর বাকীদের কে পরিত্যাগ করেছিলেন রাশিয়ার বরফে। শুধু কি তাই? তিনি নিজে ছত্রভঙ্গ হয়েছিলেন ‘ওয়াটার লু’ র যুদ্ধে।
এরপরে তাঁর সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়ে। ছুঁড়ে ফেলা হয় তাঁর আইন। আর তাঁর মৃত্যুর পূর্বেই তাঁর পুত্র হন ক্ষমতাচ্যুত।
ম্যাসিডনের আলেকজান্ডারের সঙ্গে যদি তুলনা করা হয়, দেখা যাবে দুজনই ছিলেন বেপরোয়া। দুজনেই জয় করেছিলেন অর্ধেক পৃথিবী।
বিশাল বাহিনী সঙ্গে নিয়ে উদীয়মান সূর্যের দিকে যাত্রা শুরু করতেন। দুজনেই মারা গিয়েছিলেন এমন এক সময় যখন তাঁরা ছিলেন তাঁদের সক্ষমতার তুঙ্গে। কিন্তু তাঁদের মৃত্যু পরবর্তী অবস্থা ছিল একেবারেই ভিন্ন। আলেকজান্ডারের সেনানায়কেরা যুদ্ধ শুরু করেন নিজেদের ভেতরে। ফলস্রুতিতে তাঁর পুত্রকে পালিয়ে বাঁচতে হয়েছিল।
সত্যিকার অর্থেই চেঙ্গিস খান নিজেকে আর্মেনিয়া থেকে কোরিয়া আর তিব্বত থেকে ভল্গা পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকার একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর রাজত্বে অনায়াসেই আসীন হয়েছিলেন তাঁর পুত্র। তাঁর দৌহিত্র কুবলাই খানও রাজত্ব করে গিয়েছেন অর্ধেক পৃথিবীর।
কিভাবে এই বর্বর অশিক্ষিত মানুষটি, একেবারে নিঃস্ব অবস্থা থেকে এক বিশাল সাম্রাজ্য তৈরি করলেন, তা ইতিহাসবিদদের কাছে আজও এক রহস্য। সম্প্রতি ইংল্যান্ডের একজন পন্ডিত ব্যক্তি বলেছেন, ‘তাঁর এই উত্থান সত্যিই ব্যাখ্যাতীত’।
ব্যক্তিত্বটি রহস্যময় হয়ে আছেন বেশ অনেকগুলো কারণেই। পুরোপুরি জানা সম্ভব হয় নি তাঁর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে। প্রথমতঃ মোঙ্গোলরা লিখতে জানতো না অথবা তার প্রয়োজনও তারা বোধ করতো না। আর তাই তাঁর সম্পর্কে ছড়ানো ছিটানো যতটুকু জানা যায়, সেই তথ্যগুলো পাওয়া যায় উঘুইর, চীনা, পার্সি আর আর্মেনিয়ীয় সাহিত্য থেকে। আর কিছুদিন আগে পর্যন্ত তো মোঙ্গোলদের এই জয়গাঁথাগুলো অনুবাদই করা হয়নি।
এই মহান মোঙ্গোল সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আরও একটা ব্যাপার ভেবে দেখা উচিৎ। তাঁর সম্পর্কে তথ্য দেয়া বেশিরভাগ বিচক্ষণ ইতিহাসবিদই ছিলেন আসলে তাঁর শত্রু। একে তো অপরিচিত এক জাতি। তাঁর ওপর এসব ইতিহাসবিদদের অবস্থা ছিল ত্রয়োদশ শতকের ইউরোপীয়দের মত। অর্থাৎ তাঁদের দেখা পৃথিবীর বাইরে আর কোন পৃথিবী সম্পর্কে তাঁদের নিজেদেরও কোন স্পষ্ট ধারণাই ছিল না।
মোঙ্গোলদের তাই তারা পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল অস্পষ্টতা থেকে আচমকা বেরিয়ে আসা এক জাতি হিসেবে। তাঁরা তাঁদের জীবনে মোঙ্গোলদের ভয়ংকর প্রভাব অনুভব করেছিল। দারুণ প্রভাব ফেলা এইসব অভিজ্ঞতা ছিল তাঁদের একেবারেই অচেনা। তাঁর সম্পর্কে সে সময়ের একজন মুসলিম পন্ডিতের বক্তব্য ছিল, ‘ওরা আসতো, দখল করতো, হুলস্থুল লাগিয়ে দিত। এরপর সবকিছু লুটপাট করে পালিয়ে যেত।
‘
মোঙ্গোলদের সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জানা এবং তা পর্যালোচনা করা ছিল বেশ কষ্টকর একটা ব্যাপার। তার ফলে, এবং স্বাভাবিক কারণে, সবাই তাঁর যুদ্ধ জয়ের রাজনৈতিক উপাখ্যানই লিখেছেন। । চেঙ্গিস খানকে তারা দেখিয়েছেন ক্ষমতা লিপ্সু এক অসভ্যের প্রতিমূর্তি হিসেবে। প্রায়ই যারা মরুভুমি থেকে আসতো, আর সভ্যতা গুঁড়িয়ে দিয়ে চলে যেত।
তারা তাঁকে দেখিয়েছেন শয়তানি ক্ষমতার অধিকারী এক আগ্রাসী মানুষ হিসেবে।
তাঁর জয়গাঁথা পড়ে তাঁকে ঘিরে জমে থাকা রহস্যের কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে না। এসব পড়ে মনে হবে তিনি ছিলেন ঈশ্বরের পাঠানো একটি জাতির অধিকর্তা। ফলে তাঁর গল্পগাঁথা পড়ে রহস্যের বদলে মনে হবে অলৌকিক।
তাঁদের পরিধানের পোশাকটি ছিল পশুর চামড়ার।
আহার ছিল, সেই পশুর দুধ আর মাংস। শরীর তৈলাক্ত করে রাখত ঠাণ্ডা আর আর্দ্রতা থেকে বাচতে। কখনও অনাহারে, কখনও প্রচন্ড শীতে আসতো মৃত্যু। আবার কখনও মৃত্যু আসতো অন্য মানুষের অস্ত্রের আঘাতে। যেদিকে চোখ যায় কেবল নিস্ফলা মরুভুমি।
ক্বচিৎ চোখে পরে নদীর পাশ ঘেঁষে উর্বরা একটু জমি।
আবহাওয়াও ছিল বেজায় রুক্ষ। গ্রীস্মের মাঝামাঝি সময়ে বজ্র সহ ভয়ানক ঝড় হত। প্রচুর মানুষ মারা যেত এইসব ঝড়ে। শুধু তাই না, কখনও হত প্রচন্ড তুষারপাত।
কখনও এমন হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা বাতাস হত যে লোকে ঘোড়ার পিঠেও বসে থাকতে পারতো না। এমনই এক প্রচণ্ড ঝড়ে আমরা মাটিতে পড়ে গিয়েছলাম আর ধুলা ছাড়া আর কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। এই প্রচন্ড গরম আবার এই তীব্র শীত। এমনই ছিল গোবি মরুভুমি।
যদি তাঁকে সেই সময়ের আলোকে দেখা হয়, তবেই বোঝা যাবে কেমন মানুষ ছিলেন এই চেঙ্গিস খান।
বোঝা যাবে কিভাবে তিনি এক অপরিচিত উপজাতিকে অর্ধেক বিশ্বের অধিকর্তা করেছিলেন। তাঁকে প্রকৃতভাবে বুঝতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে সাতশত বছর আগে, তাঁর নিজের পরিবেশে, নিজের মানুষের মাঝে। অনুর্বর এক এলাকায় বেড়ে ওঠা, বল্গা হরিনের পেছনে ছোটা একদল শিকারী আর ঘোড়সাওয়ারী উপজাতির মাঝে। বর্তমান সভ্যতার আলোকে তাঁকে বিচার করলে, কাজটি সঠিক হবে না।
দিব্য প্রকাশ থেকে প্রকাশিত বিখ্যাত ইতিহাসবিদ হ্যরল্ড ল্যাম্ব এর ‘চেঙ্গিস খান—দ্যা এম্পেরর অফ অল মেন’ এর অনুবাদ ‘চেঙ্গিস খান—গণ মানুষের রাজা’ অবলম্বনে
http://rokomari.com/author/25420
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।