ছন্দহীন জীবন বড়ই নীরস
সকালে শুরুটা দেখিয়েছিলাম। কিন্তু যিনি এর কেন্দ্রবিন্দু, সেই প্রজন্ম৮৬'র-ই কোনো খবর নেই। এখন একটা পর্ব পুরো দিলাম। দ্যাখেন কেমন লাগে। চিন্তা করেছি হাইস্কুল প্রতিমাসের ৩০ তারিখ এবং গাধা ১৫ তারিখ দেবো।
ওয়েলকাম ইউ অল।
১.
আমার নাম রুবেল। হাজিরা খাতায় মোহাম্মদ রুবেল। কিন্তু ডাক্তারের কাছে, বাসের টিকিট কাটতে কিংবা খেলায় নাম লেখাতে গেলে লিখি শান্ত রুবেল। এসব জায়গায় ইচ্ছেমতো নাম লেখালেও এফিডেভিটের পেছনে টাকা খরচের ধান্ধা করতে হয় না।
জিনিয়া আমাকে একদিন শান্ত বলেছিলো। নাম নয়, আমার স্বভাব না কি শান্ত। সেই থেকে এই নামের প্রতি আমার দুর্বলতা।
আমি ক্লাশ নাইনে পড়ি। যদিও সিক্স থেকে হাইস্কুল শুরু, কিন্তু সেভেনে ওঠার পর ভাব আসা শুরু হয়।
ভাব বলতে ব্যাটা ব্যাটা ভাব। মেয়েরা যেমন সবসময় বয়স কমাতে চেষ্টা করে, আমাদের থাকে বয়স বাড়ানোর চিন্তা। সেভেনে থাকতেই গালে ব্লেড চালাই। কিন্তু তখন কোনো লাভ হয়নি। এইটের শেষের দিকে এসে দেখি গোঁফ-দাড়ির জায়গাগুলো এমনিতেই ঘন আর মোটা হতে শুরু করেছে।
এখন তো নিয়মিত সেলুনে যাই।
আমাদের মহল্লার সেলুনে যে নাপিত, ওর নাম শঙ্কর। শঙ্করের একটা বাচ্চা আছে। এরপরও আমরা ওকে তুই করে বলি আর ও আমাদেরকে ডাকে আপনি বলে। সেলুনে গেলে ভাব আনার জন্য আগেই দোকান থেকে পাঁচ টাকা দামের একটা ব্লেড কিনে নিয়ে যাই।
দোকানদাররা কোনো জিনিস কিনতে গেলে বলে কয় টাকা দামেরটা নেবেন? কোনটা ভালো কোনটা খারাপ সেটা জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। তাদের কাছে সবই ভালো। ব্লেড নিয়ে শঙ্করের হাতে দিয়ে বলি : এই নে, তোরা তো আবার একটা দিয়ে যতজনকে পারিস কামাস। কখন আবার এইডস বানিয়ে ফেলিস!
ব্লেডে আবার এইডস অয় ক্যামতে?
কীভাবে জানিস না? এইডসঅলা কাউকে কামাতে গিয়ে যদি কেটে ফেলিস, এরপর একই ব্লেড দিয়ে আরেকজনকে কামাতে গিয়েও রক্ত বের করিস, তার শরীরে এইডসঅলার রক্ত ঢুকে কাজ শুরু করে দেবে, বুঝলি?
সেলুনে কেউ বাকি রাখে না। কিন্তু আমাদেরকে বাকি রাখতে হয়।
নইলে ক্ষমতার প্রকাশ ঠিকভাবে হয় না।
ক্ষমতাবানদের সাথে সবাই সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করে। বিশেষ করে দুর্বলরা এই কাজটা বেশি করে। মেয়েরা যেহেতু নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে সবসময় চিন্তা করে, সেজন্য ওরা সাহসী ছেলেদেরকে খোঁজে।
আমি যদি ক্ষমতা প্রকাশের চেষ্টায় না জড়াতাম, তাহলে এই বয়সে এতকিছু জানতাম না।
খেয়াল করে দেখেছি, আমাদের ক্লাশে চার ধরনের ছেলে আছে। এক ধরনের ছেলে আছে যারা স্বার্থপর। মেয়েদের চেয়েও বেশি স্বার্থপর। এরা মা-বাপের অতিযত্নে বড় হয়েছে। যত্ন মানে সবসময় আদর নাও হতে পারে।
এর মানে লাইনে রাখার জন্য যেমন যত্ন করা দরকার তেমনটা। এরা সমাজের ধনীক শ্রেণী নয়, কিন্তু নিজেদেরকে সবচেয়ে সভ্য মনে করে। অন্য শ্রেণীর সাথে এদের সম্পর্ক খুবই কম। কারো সুখে-দুঃখে এরা জড়ায় না। এইসব ছেলের রোল সাধারণত এক-দুই-তিনের মধ্যে থাকে।
এদের প্রতি আমার চরম আক্রোশ। এদের সমাজে মদও চলে কিন্তু এমনভাবে যাতে মাতাল না হওয়া লাগে। ডায়েট কন্ট্রোল কালচারটা এদের মধ্যে বেশি। দ্বিতীয় শ্রেণীতেও কিছু আছে যারা হয় প্রচণ্ড মেধাবী। এদের সাইজ সাধারণত ছোট থাকে।
প্রথম যে শ্রেণীর কথা বললাম, ওরা কোনো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে বড় চাকরি নিয়ে বিদেশে যায়। আর এই শ্রেণীর ছেলেরা মেধার জোরে দেশেই সরকারী বা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে প্রথম শ্রেণীর চাকরি পেয়ে যায়। বিদেশেও স্কলারশিপ নিয়ে যায়। তৃতীয় এবং বড় যে অংশটা আছে, তারা ঠিক জানে না তারা কী হবে। তারা হলো মধ্য শ্রেণী।
এরা ক্ষুদ্র ব্যবসা কিংবা ছোট চাকরিতে লেগে যায়। বেকারও থাকে অনেক। চতুর্থ শ্রেণীতে আছে আমার মতো ছেলেরা। এদের মধ্যে যে মেধাবী নেই তা নয়। কিন্তু এরা লেখাপড়া করবে না।
এই শ্রেণীর আবার দুইটা ভাগ আছে। প্রথম ভাগে আমার মতো বড়লোকের ছেলেরা, যারা ইচ্ছে করলে যখন-তখন ব্যবসা বা বিদেশ করতে পারে। দ্বিতীয় ভাগে অতিগরিব ছেলেরা, যারা হয় সন্ত্রাস না হয় কারিগরী/অকারিগরী কাজে লেগে যায়। অকারিগরী কাজ বলতে যে কাজে কোনো যন্ত্রপাতি লাগে না।
অন্যদের কথা অনেক বললাম।
এবার আমার কথায় আসি আবার। আমার আব্বু তো আগেই বললাম ব্যবসায়ী। আমি কী করি না করি তা নিয়ে আব্বুর অত মাথা ঘামানোর সময় নেই। আমরা যা চাই সাথে সাথে পেয়ে যাই। আম্মু থাকেন হিন্দি সিরিয়াল, শপিং আর বেড়ানো নিয়ে।
এর মধ্যে খাবারের ব্যাপারটা উল্লেখ না করলেই নয়। ডাক্তার তাকে বলেছেন খাবার কমাতে। কিন্তু তার কাছে দুনিয়ার যেকোনো খাবারই মজা লাগে। ডাইনিং টেবিলের কাছ দিয়ে গেলে আর তার বাধ মানে না। তিনি ওজন কমাতে রাজী; কিন্তু না খেয়ে নয়।
আমার বোন আমার চেয়ে ছোট। ওর নাম রুজিনা। রুবেল-রুজিনা নামগুলো পুরনো মনে হয় না? আমার আব্বু যদিও বিএ পাশ, কিন্তু মফস্বলে থেকে পড়ালেখা করেছেন। সেজন্য এরকম পুরনো নাম রেখেছেন আমাদের। রুজিনা পড়ে সেভেনে।
ও আবার আম্মুর বিপরীত। খুবই স্বাস্থ্যসচেতন। তবে কলা ওর পছন্দের খাবার। কলা খেলে না কি চেহারার লাবণ্য বাড়ে। কলা আসে নরসিংদী থেকে।
একদম গাছপাকা। আমাদের সব খাবারই এভাবে বিভিন্ন জায়গা থেকে খাঁটিগুলো আসে। মাছ নারায়ণগঞ্জ, সবজি কুমিল্লা, চাউল ঠাকুরগাঁও, ঘি-মধু খুলনা-বাগেরহাট। এর জন্য আমাদের কোনো বাড়তি খরচ নেই। আব্বুর টেক্সটাইলের শ্রমিকরা যে যেখানকার, তাকে দিয়ে সেখান থেকে এসব আনানো হয়।
রুজিনা এসবের কারণে বাইরের খাবার বলতে গেলে খায়ই না। পোশাকের ব্যাপারেও ওর ভিন্ন রুচি। ওর ডিজাইনের পোশাক দুনিয়ার আর কারো গায়ে থাকতে পারবে না। সেজন্য ওর পোশাক আম্মু কখনো কিনতে পারে না। ও নিজেই ডিজাইন করিয়ে নেয়।
রুজিনার কথা বলতে বলতে ও চলে এসেছে। এখন ওর সাথে একচোট ঝগড়া হবে।
ভাইয়া, তুমি আমার রুমে গিয়েছিলে আবার?
কেন?
আমার ড্রয়ারে অ্যালবামের ছবিগুলো সব এলোমেলো।
এলোমেলো হলেই আমি করেছি? অন্য কেউ করতে পারে না?
এই, তুমি আমার দিকে তাকিয়ে বলো। পাশে বসে আমার দিকে তাকিয়ে বললো।
আমি খাটে শুয়ে আছি।
ওর দিকে তাকাতেই ও বললো : তোমার শরম নেই তুমি মেয়েদের ছবি দেখো?
কেন, তোর বান্ধবীদের ছবিগুলো বলেছে যে আমরা শরম পাই?
ওগুলো আমাদের সিক্রেট ছবি না?
চিন্তা নেই, তোর বান্ধবীদের কাউকে আমি পছন্দ করি না।
আমার বান্ধবীরা মনে হয় তোমার জন্য পাগল!
তোর বান্ধবীরা কেন, ওদের মা-বাপসুদ্ধ পাগল। আমি পয়সাঅলার ছেলে না?
ওদের মনে হয় পয়সা নেই!
রুজিনা এসব নিয়ে কথা বলার জন্য আসেনি, আমি জানি। ও এখন যেটা বললো, তার অপক্ষায়ই আমি ছিলাম।
খপ করে ও আমার হাত ধরে ফেললো।
ভাইয়া, আমার ঐ কাগজটা দাও না।
কোন কাগজটা?
ভাইয়া, ঢং কোরো না। তুমি যে আমার রুমে গেছো, তার বড় প্রমাণ হলো আমার রুমে এখনো তোমার গন্ধ আছে।
আমার গন্ধ?
হুঁ, তুমি যে সিগারেট আর চুইংগাম সমানে খাও, গায়ে স্প্রে মেখে ভরে রাখো, যে-কেউ এসব গন্ধ টের পায়।
ভাইয়া, এখন আমার কাগজটা দাও না।
রুজিনা আমার দিকে আরো বেশি নুয়ে পড়লো। আমি লজ্জায় সরে গিয়ে বললাম : আচ্ছা, তুই তোর রুমে যা। মেয়েদের হালকা-পাতলা পোশাকে আমি যখন সেভেন-এইটে, তখন খুব পুলকিত-উত্তেজিত হতাম। এখন এগুলো স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
তারপরও বোন বলে কথা। আমার কাছে অবশ্য কেন জানি আমার চেয়ে বয়সে দ্বিগুণ যেসব নায়িকা, তাদেরকে ভালো লাগে। পপির চাহনি, প্রিয়াংকার হাসি—এগুলো আমাকে খুবই মুগ্ধ করে। রুজিনার কাছেও এসব কথা বলেছি। আমাদের মধ্যে প্রায় সব কথাই হয়।
কিন্তু রুজিনা এখন যে-কাগজটা খুঁজতে এসেছে, সেটা যে একটা গোপন চিঠি, তা আমি জানি। তবে কোনো ছেলেকে লেখা চিঠি নয়। ছেলেদের নিয়ে ওর মধ্যে খুব একটা গরজ নেই। ও জানে ও ধনীর দুলালী, যাকে চাইবে, তাকে খুব সহজেই পেয়ে যাবে।
আমি বললাম : তুই যদি বলিস ওটার লেখা কীভাবে পড়তে হবে, তাহলেই আমি দেবো।
মুহূর্তেই ওর চেহারা মলিন হয়ে গেলো। আমি ওকে ডেকে বালিশের নিচ থেকে চিঠিটা বের করে দিয়ে দিলাম। চিঠিটায় কোনো অক্ষর নেই। বারো রঙের পেন্সিলের দাগ বিভিন্নভাবে দেয়া আছে। লম্বা, শোয়ানো, ডানে বাঁকা, বামে বাঁকা—এরকমভাবে।
সব অক্ষরই ওতে আছে, আমি নিশ্চিত।
ছোটবেলা থেকেই ওর প্রতিটা জিনিস খুঁটিয়ে দেখা আমার স্বভাব।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।