আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

উড়াল পঙ্খী



আধাপাকা ধানের বিশাল ক্ষেত। ধানের শিষগুলো মাথা নিচু করে পরিকপক্বতার ক্রম জানিয়ে দিচ্ছে। আর সেই ক্ষেতের আইল থেকে কিছুক্ষণ পরপর মাথা তুলে কাস্তে দিয়ে ঘর্মাক্ত গলার পেছন ভাগটা চুলকাচ্ছে নোমান। তারপর একসময় ঘাসগুলো খাচিতে ভরে কাস্তের সমগ্র অংশটা ঘাসের ভিতর ঢুকিয়ে দিল। খাচাটি মাথায় নিয়ে আস্তে আস্তে বড় রাস্তায় ওঠে মাথা থেকে খাচাটি নামিয়ে রাখল।

লুঙ্গির নিচের অংশটা দিয়ে মুখ মুছে একটা বড় নিশ্বাস ফেলল। নিজ কর্তব্যের ইতি টেনে এরকম নিশ্বাস ফেলতে নোমানের খুব ভালো লাগে। তেমাথা রাস্তা। একটা রাস্তা শীল পুকুর থেকে সোজাসুজি তাইজ্যা পুকুরের পাশ দিয়ে পূর্ব দিকে চলে গেছে। অন্যটা ঢুকে গেছে দক্ষিণ দিকে।

যেন সরল কোণের ওপর একটি লম্ব। চৈত্রে এমন দাবদাহে মাঝে মাঝে বাতাসের দুর্বল ঝাপটায় গাছের তালায় বিশ্রাম নেওয়া নোমানের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। নির্জন এই দুপুরে হঠাৎ নোমানের ভিতরটা খুশিতে আনচান করে উঠল। সে নীরবে বলে উঠল, ‘পেয়ে গেছি। ’ এতদিন যা তার কল্পনায় ছিল আজ তা বাস্তবেই পেয়ে গেল।

সুতরাং এরকম দুর্লভ কিছুর সন্ধান পাওয়ায় তার মন আনন্দে ভরে উঠল। ক্ষণিকের জন্য একটু শৈশবে ফিরে গেল নোমান। এক বেদনা বিধুর স্মৃতি তার চোখের পর্দায় ভেসে উঠে। বছর চারেক আগে তার দাদার নিয়ে আসা একসঙ্গে তিনটি সবুজ টিয়ের কথা মনে পড়ল। সবুজ - মেহেদী রাঙা লাল ঠোঁট- লম্বা লেজ, অপূর্ব।

সেদিন খুব খুশি হয়েছিল নোমান। কৌতূহল বসত:টিয়ে গুলোর থাকা খাওয়া বাসা ইত্যাদি সম্পর্কে দাদাকে অনেক প্রশ্ন করেছিল সে। দাদাও তাকে সবকিছু বলেছিল। আরো বলেছিল, ধরতে গিয়ে নাকি একটি উড়াল দিয়েছে। এগুলো গাছের কোটরে বাসা বাঁধে।

নোমান এই চৈত্রের দুপুরে পুকুর পারের শিরিষ গাছে সেই টিয়ের বাসাই দেখতে পেল আজ। (২) নোমানের আজ পরিষ্কার মনে পড়ে, সেই টিয়ে পাখিগুলো তার দাদা শীল পুকুরের উত্তর পারের উলানা গাছের কোটর থেকে তুলে এনেছিল। পুরোনো আমলের বিরাট পুকুর। এই পুকুরের জল কেউ ব্যবহার করেনা। গাছের ওপর থেকে স্বচ্ছ জলের ভিতর বড় বড় মাছ থেকে শুরু করে তলার ছোট বড় উদ্ভিদগুলো পর্যন্ত দেখা যেত।

আয়নার মতো স্বচ্ছ এই পুকুরের জল। সেই কবে এই পুকুরের তলা থেকে একটি শীল বা পাথর পাওয়া গিয়েছিল, সেই থেকে এর নাম শীল পুকুর। দাদাও নাকি টিয়ে ধরার সময় পুকুরের নিচের বড় বড় মাছগুলো দেখতে পেয়েছিল। নোমান সবিস্ময়ে সেদিন কথাগুলো শুনেছিল। সেদিন থেকে তার ইচ্ছা, একদিন পুকুর পারে গিয়ে এই কাহিনীর সত্যতা যাচাই করার।

পুকুরটিও তার অচেনা নয়। উলনা গাছও সে চেনে। কিন্তু এতগুলো গাছের ভিতর ঠিক কোনটিতে টিয়ের বাসা তার জানা ছিলনা। তাই দাদার সাথে একদিন ঘাস কাটতে যাওয়ার সময় সে গাছটির অবস্থান জেনে নিয়েছিল। মাস কয়েক পর বন্ধু সজলকে নিয়ে নোমান ঐ গাছের গোড়ায় গেল।

প্রথমে গাছের ওপর দিকে চোখ তুলে একটু তাকাল। তারপর চারদিকে একটু দেখে নিয়ে সে গাছে ওঠা শুরু করল। গাছের অর্ধেক উঠে সে পুকুরের জলের দিকে চোখ রাখল। দাদার কথা একেবারে অক্ষরে অক্ষরে ঠিক। এযে সত্যিই পুকুরের তালায় বড় বড় মাছ ভেসে বেড়াচ্ছে! সে কিছুতেই তোর চোখ দুটোকে বিশ্বাস করতে পারছিলনা।

তারপরও প্রত্যক্ষ প্রমাণযোগ্য বিষয় গুলোকে বিশ্বাস করতে হয়। নোমানের মুল উদ্দেশ্য গাছের কোটরে টিয়ে পাখি আছে কি-না তা পরীক্ষা করে দেখা। একটু ওপরে উঠলেই মগডাল। একটি ডাল অতিক্রম করা মাত্রই মা টিয়ে পাখিটি ডাকাডাকি শুরু করে দিল। আনন্দ এবং ভয় দুটো একসাথে ঘিরে ধরল নোমানকে।

এ এক বর্ণনাতীত অনুভূতি। যা শুধু মাত্র আক্রান্তজনই বুঝতে পারে। আরেকটু মাথা তুলল নোমান। গাছের তিনটি ডাল তিনদিকে চলে গেছে। একটি ডাল সোজা উপরের দিকে।

গাছের বয়স মোটেই কম হয়নি। তার দাদার শৈশবেও গাছটি এত বড় ছিল। গাছটির মূল মাজার মাঝ বরাবর একটি গভীর কোটর। কোটরের ভেতরে আরো কয়েকটি কোটর। জীবনে এই প্রথম সে এত সুন্দর টিয়ে পাখির ঠিকানার হদিস আবিষ্কার করল।

কোটরের ভিতরে হয়ত বাচ্চা পাওয়া যেতে পারে। সে একটু ধীরে সুস্থে এগোচ্ছে। দুটি পা গাছের প্রশস্ত প্রশাখার ওপর রেখে এক হাতে একটি ডাল শক্ত করে ধরে প্রথমে বড় কোটরটিতে আঙ্গুল সঞ্চালন করল। তারপর ধীরে ধীরে আঙ্গুল গুলো ছোট ছোট কোটর গুলোতে ঢোকানোর চেষ্টা করল। কয়েকটি জীর্ণ শীর্ণ পালক ছাড়া আর কিছুই নেই।

নোমান দ্বিতীয়বার হাত ঢুকিয়ে দিল। এবারের কোটরটি বেশ গভীর। যেন কোটর নয়। একটি গভীর গর্ত। একটু গভীরে হাত ঢুকানো মাত্রই ফোঁস ফোঁস আওয়াজ বেরিয়ে আসল।

একটু চমকে উঠল নোমান। এক অজানা আশঙ্কায় কাঁপতে লাগল। একবার ভাবল, টিয়ে পাখির বাচ্চা কী ফোঁস ফোঁস করে? এ জ্ঞান তার কাছে পূর্বত: সিদ্ধ নয়। তৎক্ষণাৎ দেখতে পেল, একটি লম্বা দাড়াশ সাপ তার বাম হাতের পাশ দিয়ে শাঁ শাঁ করে চলে যাচ্ছে। যেন হৃদকম্পন থেমে গেল তার! একটু পর বুকের ভিতর থেকে ধুপ ধুপ করে শব্দ বেরিয়ে আসতে লাগল।

মুহূর্তের মধ্যেই সে গাছের নিচে নিজকে আবিষ্কার করল। পাশে সজল। ঘোর কাটল তার। (৩) বয়স বাড়ার সাথে সাথে নোমানের বুদ্ধি ও সাহস দুটোই ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে। সে এখন বুঝতে পারছে বাচ্চা না থাকলে টিয়েগুলো ঘন ঘন কোটরে ঢুকতো না।

তার এ অনুমান ভুল হবার নয়। তাই অনেকটা প্রফুল্ল মনে গুন গুন শব্দ করে ঘাসের খাচিটি মাথায় নিয়ে বাড়ীর দিকে রওনা হল। পথিমধ্যে একটু আধটু চিন্তাও করতে লাগল, কেউ দেখে ফেলবে না তো? আর বেশিদিন ধৈর্য ধরতে পারলা নোমান। এ এক কৌতূহল নিবৃত্তির দারুণ যন্ত্রণা। সবার আগে তাকে গিয়ে বাচ্চা গুলো নিয়ে আসতে হবে।

বাড়ী থেকে তাইজ্যা পুকুরের দূরত্ব বেশি নয়। শীল পুকুরের মতো এপুকুরটিও বেশ প্রাচীন। কিন্তু ভয়ঙ্কর। দিনের বেলা পর্যন্ত এর পাশদিয়ে গেলে শরীর র্শি র্শি করে ওঠে। শৈশবে সে মায়ের মুখে এপুকুরের অনেক কাহিনী শুনেছে।

গ্রামের শুক্কুর আলীকে আজো অভিশাপ দেয় নোমান। কী কান্ডটাই না ঘটিয়েছিল সে! শুক্কুর আলী যদি একটি বাটি সেদিন রেখে না দিত তাহলে আজো গ্রামবাসীর প্রয়োজনে সোনার নৌকাটি ভেসে উঠত। কিন্তু সে তা করেননি। মেয়েও বিয়ে দিল, সোনার বাটিটাও বজিমাত করল। সেই থেকে এই পুকুরে আর কোনো সোনার নৌকা ভেসে উঠেনি।

কারণ নৌকা থেকে নেওয়া সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে বুঝিয়ে দিলেই নাকি নৌকা অদৃশ্য হয়ে যেত। গ্রামে বিয়ে শাদি হলেই নৌকাটি যাবতীয় তৈজস পত্র নিয়ে ভেসে উঠত। কিন্তু শুক্কুর আলী তো সব শেষ করল। পরে শুক্কুর আলীকে নাকি কয়েকবার স্বপ্নও দেখিয়েছিল বাটিটা রেখে আসার জন্য। তিনি তা করলেন না।

সে বলল, ‘সোনা রূপার প্রতি লোভ নেই কার। ’ সুতরাং হোক ইষ্টে অনিষ্ট। এত সাত-পাঁচ ভাবার তার দরকার নেই। কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণের কাহিনীও এই পুকুরের কম নেই। পুকুর পারে কত লোক মরল সাপের দংশনে।

বয়সের ভারে ন্যুব্জ, চক্ষু কোটরাগত সাপগুলো চলাফেরা করার সময় ছোট ছোট ঝোপগুলো দুধারে ফাঁক হয়ে যেত। সারাক্ষণ মাছি ভন্ ভন্ করত এগুলোর গায়ে। উত্তর পারের কবর খননের সময় নোমান ও তার বাবা বিরাট এক সাপ দেখতে পেয়েছিল। সেদিন ইমাম সাহেবের আযানের পর সাপটি অদৃশ্য হয়ে যায়। আর তাহের নামের লোকটিকে সন্ধ্যার সময় বাজার হতে ফেরার সময় যদি মেরে না ফেলত তাহলে এই পুকুরের নাম আর মরা তাইজ্যা পুকুর হতো না।

কাক চক্ষুর মতো কালো এই পুকুরের জল। মাছ ধরতে পেশাদার জেলে পর্যন্ত নামতে চায় না। মাছগুলো তাই বড় হতে হতে ইয়া বড় দৈত্যে পরিণত হয়েছে। তাই এই পুকুরের ধারে কাছে যাওয়া নোমানের মায়ের কড়া নিষেধ। কিন্তু এই বয়সে নিষেধের বন্ধন না ভাঙলে কি আর বড় হওয়া যায়! টিয়ে পোষার নেশা নোমানকে উদ্বুদ্ধ করেছে সেই নিষেধের বাঁধা অতিক্রম করতে।

তাই টিয়ে পাখি যেখানে আছে সেখানে যেতে নোমান মৃত্যুর ঝুঁকিকেও পরোয়া করেনা। (৪) নোমানের পড়ার টেবিলে ক্লাস সেভেনের বইপত্র গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সে আজ স্কুল কামাই করেছে। ঘাস নিয়ে দেরি করে ঘরে ফিরেছে। বাবার কড়া আদেশ, বাড়ির কাজও করতে হবে- সাথে পড়ালেখাও চালিয়ে যেতে হবে।

কিন্তু নোমান কাজ থেকে ফিরে আর স্কুলে যেতে চায় না। কাজ করতে করতে পড়ালেখার সময়ও চলে যায়। তাই নোমানের দুরন্ত মন যখনই ঘর থেকে বের হত তখনই প্রকৃতির সাথে মিশে যেত। কখনো কখনো ঘাস বিহীন ঘরে ফিরলে ভাত জোটে না। বাবার নিষেধ।

তবুও মা অনেক বকাঝকা করে কালক্ষেপন করে ভাত দেয়। আজ সে ঘাস এনেছে, তবে স্কুলে যেতে পারেনি। নোমানের যুক্তি, লাল গাভীটা খুলুমিয়ার পাহাড়ে হারিয়ে গেছিল। খুঁজতে খুঁজতে সময় শেষ। মিটিমিটি হাসে তার মা।

প্রশ্রয়ের হাসি। নোমান তার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। চৈত্রের দুপুর। বাইরে খাঁ খাঁ রোদ। এমন গরমের দিনে সবাই একসাথে শীতল পাটিতে ঘুমানো প্রাত্যহিক রুটিন।

বাবা ঘরে। বাবার চোখকে ফাঁকি দেওয়া খুবই কষ্টকর। ঘরে বাবা থাকলে ভাজা মাছটাও সে উল্টিয়ে খেতে জানেনা। তাই বাধ্য ছেলের মতো সেও চোখ দুটো বন্ধ করল। তারপর ঘুমের ভান করে নিশ্বাসের পর নিশ্বাস নিতে লাগল।

কিন্তু তার চোখে ভাসছে তাইজ্যা পুকুর, শিরিষ গাছ, টিয়ে পাখি ইত্যাদি। যখনই বাবা নাক ডাকতে শুরু করল তখনই উঠে নোমানের এক ভোঁ দৌড়। সেই দৌঁড় গিয়ে থামল একেবারে আমতলায়। আজ সজলেরও আসতে অনেক কষ্ট হলো। পাকা ধানক্ষেত।

ভ্যাপসা গরম হাওয়ার উচ্ছ্বল তরঙ্গ ধানের শিষগুলোকে নাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। তার মাঝ খান বরাবর ছুটে চলছে নোমান ও সজল। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা তাইজ্যা পুকুরের সেই গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়াল। প্রায় চার ফুট পরিধির গাছ। বিসমিল্লাহ বলে গাছে চড়ে বসল নোমান।

কোনো ভয় নেই। বাহাদুর সেপাই সজল দাঁড়িয়ে আছে গাছের নিচে। গাছে উঠতে জানেনা সে। শীল পুকুরের সাপের কথা মনে পড়ল নোমানের। তাই গর্তে হাত দেওয়ার আগে একটি কাঠি দিয়ে সাপ আছে কি-না পরীক্ষা করে দেখল।

কোটর থেকে ক্যাঁ ক্যাঁ মৃদু শব্দ বেরিয়ে আসল। তাহলে নিশ্চিত টিয়ে পাখির বাচ্চা রয়েছে। তারপর হাত ঢুকিয়ে সে যার পরানই অবাক। বাচ্চা গুলোকে সে যেরকম কল্পনা করেছিল সেরকম হয়নি। খুব ছোট, চোখও ফুটেনি।

লেজ আর পাখার পালকগুলোও ভাল করে গজায়নি। সুতরাং যে আশা উদ্দীপনা নিয়ে তারা এসেছিল তা নিরর্থক হয়ে গেল। সজল গাছের ওপর দিকে তাকিয়ে আছে। সে নোমানকে বাচ্চাগুলো নিয়ে নেমে আসার জন্য পরামর্শ দিল। তারা না নিলেও অন্য কেউ নিয়ে যেতে পারে।

নিরীহ চারটি পক্ষী শাবক নিয়ে নেমে পড়ল নোমান। একটি বাচ্চা সে সজলকে দিল। চেহারা গোমরা করে ফেলল সজল। কারণ তাকে দুটি বাচ্চা দেওয়ার কথা ছিল। সদ্য ফোঁটা শাবকের একটি মাত্র নরম লাল ঠোঁট ছাড়া টিয়ে পাখির আর কোনো অবয়ব নেই।

ঘরে এসে মায়ের হাতে এক বকা খেল নোমান। নোমান বলল, ‘টিয়ের বাচ্চা যত ছোট হয় ততই ভালো। দুনিয়ার আলো বাতাস দেখার আগো কান দিয়ে যদি মানুষের ভাষা ঢুকানো যায় তাহলেই তো টিয়ে মানুষের মতো কথা বলতে শিখবে। ’ মাকে একটি উত্তম সবক দিতে পেরে গর্বে বুক ফুলে উঠল তার। (৫) পুরানো আমলের একটি বড় মট্কি সংগ্রহ করে ফেলল নোমান।

ভিতরে কিছু শুকনো খড় বিছিয়ে দিল। এখানে কোনো আলো বাতাস ঢুকতে পারবে না। চমৎকার পদ্ধতি। ছেলের উৎসাহ দেখে মা-ও উৎসাহ বোধ করে। গভীর রাতে পক্ষী শাবকগুলো চ্যাঁ চ্যাঁ আওয়াজ শুনে ঘুম ভাঙল নোমানের মায়ের।

ওমের জন্য বাচ্চাগুলো ছটফট করছিল। নোমানের মা প্রথমেই আশঙ্কা করেছিল এমন একটা কিছুর। সকালে বাচ্চাগুলোকে কলা টিপে টিপে খাওয়াল নোমান। স্কুল থেকে ফিরে আবার পাখিগুলোর যতœ আত্তি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। নোমান ভাবল, পাখিগুলো বাসায় থাকলে এতক্ষনে তাদের বাবা মা কত দানা পানাই না খাওয়াত।

একটানা কলা খেতে খেতে পাখিগুলোর কলার প্রতি বিরক্তি চলে আসল। তাই পরের দিন বিকেলের সময় নোমান ভাঁদি ফল সংগ্রহ করতে বের হয়ে গেল। বাচ্চাগুলো ইতিমধ্যেই বেশ বড় হয়ে উঠল। অবশ্য সজলের পাখিটি ইতিমধ্যেই অনাদরে মৃত্যুবরণ করেছে। কিন্তু বিধিবাম।

একদিন নোমান স্কুল থেকে ফিরে দেখল, তার পোষা বিড়ালটি দু’টি বাচ্চা সাবাড় করে দিয়েছে। বলতে গেলে মিনিটা পাখি দু’টির ওপর এক প্রকার প্রতিশোধ নিল। এই পাখি গুলো এবাড়িতে ঢোকার পর থেকেই মিনির আদর যতেœ ভাটা পরতে শুরু করেছে। নোমান মিনিকে আচ্ছামত পেটাল। একসময় নোমান এই মিনির তুলতুলে পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে দারুণ আনন্দ উপভোগ করত।

আজ সেই হাত থেকে বেদম মার খেল মিনি। অত্যধিক আদর যতœ দিয়ে নোমান অবশিষ্ট বাচ্চাটিকে বড় করে তুলল। এখন তার লম্বা লেজ, মেহেদী রাঙানো লাল ঠোঁট, প্রশস্ত ডানা আর ঘন সবুজ দেহ জানান দিচ্ছে একটি পরিপূর্ণ টিয়ে হয়ে ওঠার কথা। স্কুল থেকে ফিরেই ডাক দেয় নোমান। নোমানের ডাক শুনে টিয়েটিও ক্যাঁ ক্যাঁক করে কলরব করে উঠে।

নোমানকে দেখলেই ব্যস্ততা বেড়ে যায় টিয়ে পাখির। মাথা নেড়ে, চোখ ঘুরিয়ে, নেচে নেচে নোমানকে স্বাগত জানায় সে। তখন নোমান দানা পানি পাল্টে দেয়। এক সময় নতুন খাবার খেয়ে শান্ত হয় পাখিটি। ইদানিং সুন্দর একটি টিয়ে পোষার জন্য এলাকার বন্ধুদের কাছে অতিরিক্ত সমাদর পাচ্ছে নোমান।

মাঝে মাঝে পড়শি বন্ধুদের নিয়ে টিয়ের খাঁচাটিসহ দল বেধে ঘুরতে বের হয়। খাঁচা থেকে টিয়েটি বের করে কাঁধে বসায়। কখনো হাতে নিয়ে অন্য হাতে মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত বুলিয়ে দেয়। পাখিটি নীরবে অনুভব করে নোমানের ভালোবাসার স্পর্শ। সজলকে গর্ব করে বলে আমার সবুজ দারুণ পোষ মেনেছে।

উড়তে জানে। কিন্তু আমাকে ছেড়ে সে উড়াল দেবে না। নোমান মাঝে মাঝে আদর করে পাখিটিকে সবুজ বলে ডাকে। (৬) অনেকদিন নোমান তার সবুজকে বাড়ি থেকে বের করেনি। অতিরিক্ত উৎসাহ উদ্দীপনাতেও ধীরে ধীরে ভাটা পড়ছে।

অথচ ইদানিং তার সবুজ খুব দুরন্ত হয়ে উঠেছে। আগের মতো খাচায় আর শান্ত হয়ে বসে থাকতে চায় না। সারাক্ষণ অস্থির হয়ে থাকে। কখনো কখনো খাচার উপরের দিকে উঠে সার্কাসের খেলার মতো নিচের দিকে ঝুলতে থাকে। তার সাথে থাকে বিচিত্র সব কসরত।

নোমানের বাড়ির পাশে বাৎসরিক মেলা বসেছে। হাজারো লোকের বিশাল মেলা। এখানে ঐতিহ্য অনুযায়ী গরুর লড়াইও হয়। সেই মেলা দেখতে একদিন নোমান সজলকে নিয়ে টিয়ে পাখি সহ বাড়ি থেকে বের হলো। অনেক ঘোরাঘুরির পর দুজনেই ভিড় থেকে একটু দূরে ঘুড়িওয়ালার পাশে গিয়ে বসল।

সবুজের জন্য নিল একটি কলা। ইতিমধ্যে সবুজকে দেখার জন্য কয়েকজন কৌতূহলী বালক জুটে গেল। সেই বালকদের আগ্রহ দেখে একসময় নোমান সবুজকে খাঁচা থেকে বের করল। তারপর বাম হাতের তর্জনিতে রেখে ডান হাত দিয়ে সবুজের মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত আলতো ভাবে বুলাতে লাগল। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ সবুজ নোমানকে চমকে দিয়ে আকাশে উড়াল দিল।

বালকের দল মনে করল এটাও এক রকম খেলা হয়ত। কিন্তু এক অজানা আশঙ্কায় নোমানের বুক ঢিপ্ ঢিপ্ করে কাঁপতে লাগল। কিন্তু না, নোমানের আশঙ্কা অমুলক। কিছুদূর গিয়ে আবার ফিরে আসল সবুজ। খুশিতে অন্তরাত্মা নেচে উঠল নোমানের।

সজলকে বলল, ‘দেখেছিস্ আমার সবুজ ইতিমধ্যেই কী পোষ মেনে গিয়েছে। ’ তার বাহাদুরিতে কোনো রকম ন্যূনতা না রাখার জন্য এবার নোমান ইচ্ছা করেই সবুজকে বলল,‘ যা! আবার কিছুদূর গিয়ে ঘুরে আয় বেটা। ’ স্বাধীনতায় মুক্ত ডানা মেলে এবার উড়াল দিল পঙ্খী। বৈশাখী মেলা, স্কুল ঘরের ছাদ, পাশের ছোট নদী, নদীর চর, একে একে সবকিছু পার হয়ে উড়ে চলছে নোমানের অহঙ্কারের সবুজ। উড়তে উড়তে একসময় আরেকটি সবুজের দলে মিলে নোমানের একান্ত টিয়ে, সবুজ।

নোমান একেবারে থ বনে গেল। তার সবুজ আজ তাকে বালকের দল ও সজলের সামনে জীবনের নিষ্ঠুরতম অপমানের মুখোমুখি করল। নোমান তার চোখ দু’টোকে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেনা। একবার খাঁচার ভিতর তাকায় আরেকবার আকাশের দিকে তাকায় নোমান। তার ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠল।

অপমানে তার মাথাটা কেমন জানি বোঁ বোঁ করছে। পৃথিবীটা আজ ঝাপসা মনে হচ্ছে তার। শূন্য খাঁচা, স্কুল ঘর, বৈশাখী মেলা, নদী, নদীর চর সবকিছুই আজ অর্থহীন। বেলা পরে যাচ্ছে। গোধূলীর লালিমায় রঙিন হয়ে উঠছে সজলের চোখের জল।

তার স্মৃতির ক্যানভাসে ভেসে উঠছে অতীতের খন্ড খন্ড স্মৃতি, সোনালী দুপুর, আর মৃত্যুময় বিভীষিকা। সহকারী শিক্ষক ইউসেপ-সি এফ এস ডি মোবাইল:০১১৯০২২০৭০০ ই-মেইল: ফযঁশশর@মসধরষ.পড়স

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।