আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কলেজের দিনগুলো



কলেজ জীবনটা তেমন একটা ভালো কাটেনি আমার। অনেক বেশি কড়াকড়ি ছিল আমাদের কলেজে। অবশ্য এটাকে "নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস" এরকম কিছুও বলা যায়। আমার সব সময় মনে হত অন্য কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা আরও অনেক মজা করে। অবশ্য আমরাও যে মজা করতাম না তা নয়।

আইসিসি সেমিফাইনালে বাংলাদেশের বিজয় যখন বিশ্বকাপে প্রবেশ নিশ্চিত করেছিল, আমরাও সেই আনন্দের ভাগীদার হয়েছিলাম । মাঝে মাঝে শিক্ষকদের কড়াকড়ির চোটে হাঁপিয়ে উঠতাম। তবে এর মধ্যেও মজার স্মৃতি যে একেবারে নেই তা না। গণিতের একজন ম্যাডাম ছিলেন যিনি প্রতি সেশনে একজনকে তার বলির পাঁঠা হিসেবে বেছে নিতেন। কোন কারণ ছাড়াই তাকে প্রতি ক্লাসে বকা-ঝকা করতেন।

"এই মেয়ে তুমি হাসছ কেন?" "এই মেয়ে আমার ক্লাসে অন্য ক্লাসের পড়া করছ কেন?" (এই কাজটা আমি প্রায়ই করতাম , কিন্তু ধরা খাইনি কোনদিন। ) তো এই ম্যাডামের উচ্চারণে একটু সমস্যা ছিল। সেটা যে খুব বড় ব্যাপার তাও না। তবে এর জন্য উনার ক্লাসে রোলকলটা হত খুব মজার। "অন, টু, তিরি, পুর, পাইব, সিক্স, সেবেন, এইট, নাইন, টেন, এলেবেন, টুয়েলেব, তারটিন, পুরটিন, পিপটিন......" এইভাবে প্রতিদিন চলত।

অনেকগুলো শব্দের উচ্চারণে সমস্যা থাকলেও আমাদের টার্গেট হয়েছিল একটাই, টুয়েলেব। বারো রোলের মেয়েটার নামই আমরা দিয়ে দিয়েছিলাম টুয়েলেব। সবাই ওকে এই নামে ডাকত, কেউ মনে হয় ওর আসল নামটা মনে রাখার প্রয়োজন মনে করেনি। ও নিজেও এটা খুব আনন্দের সাথেই মেনে নিয়েছিল। নিজের নামটা মনে হয় মাঝে মাঝে সে নিজেও ভুলে যেত।

একবার অন্য একটা ক্লাসে তাকে অন্য এক ম্যাডাম পড়া ধরছিলেন। সে সুন্দরমত পড়া বলেছে। এরপর ম্যাডাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার রোল কত? সে সাথে সাথে উত্তর দিল, টুয়েলেব। সারা ক্লাসে হাসির ঝড় বয়ে গেল, সে নিজেও হাসতে হাসতে পেট চেপে বসে পড়ল। ম্যাডাম হঠাৎ একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন।

সবার হাসি একটু কমে আসলে বললেন, এইভাবে কাউকে হেয় করো না তোমরা, উচ্চারণে সমস্যা তো থাকতেই পারে, তোমাদের উচিৎ ওকে ঠিক করে দেয়া, এই মেয়ে দাঁড়াও তো, বল টুয়েলভ। আবারও হাসির বন্যা। আর যাকে ম্যাডাম টুয়েলভ -এর উচ্চারণ শেখাচ্ছেন তার তখন কথা বলার মতও অবস্থা নেই। দুই হাতে মুখ চেপে হাসির দমকে কেঁপে কেঁপে উঠছে। ম্যাডাম বললেন, লজ্জার কিছু নেই রে মা, বল টুয়েলভ, চেষ্টা কর, ঠিকই পারবে।

এক ইংরেজী স্যার ছিলেন অতি শুদ্ধ ইংরেজী বলতে গিয়ে যা করতেন যে সেটাকে ইংরেজী না বলে সাপের ভাষা বললে ঠিক হবে। সব শব্দের শেষের অক্ষরটা কিভাবে যেন "শ" বানিয়ে দিতেন আর সাপের মত হিশশশশ হিশশশশ করতে থাকতেন। "দিশশশশশশ ইজ আ ভেরী গুড কলেশশশশশশশশ। " তার প্রতিটা কথার সাথে সাথে ক্লাসের বিভিন্ন কোণা কোণা থেকে প্রতিধ্বনি হতে থাকত। কিভাবে হত কে জানে? আরেক স্যার ছিলেন রসায়নের, যিনি বেশির ভাগ সময় একটা এমন বিদঘুটে রঙের টি-শার্ট পরে আসতেন যে ঐটা দেখেই তার ক্লাস করতে অরুচি ধরে যেত।

চোখের সামনে এমন হাগু রঙের জামা পরা মানুষ দেখলে কি আর তার পড়া শুনতে আগ্রহ হয়? গাজী আজমল স্যার সপ্তাহে একদিন ক্লাস নিতেন। তার ক্লাসে সবাই ফার্স্ট বেঞ্চে বসার জন্য রীতিমত মারামারি কান্নাকাটি লাগিয়ে দিত। যত আগ্রহ আর মনোযোগ নিয়ে স্যারের ক্লাস করতাম, তাকে নকল করার পূর্ণ প্রচেষ্টা করতে থাকা এক ম্যাডামের ক্লাস করতে ততটাই বিরক্ত লাগত। কেন জানি ব্যাঙ আর কেঁচোর জায়গায় কাক আর ময়ূরের নামগুলোই বারবার মাথায় আসতে থাকত। বাংলার একজন ম্যাডাম ছিলেন খুব সুন্দর করে পড়াতেন।

কিন্তু পড়ানোর সময় একটু বেশিই আবেগী হয়ে পড়তেন। মাঝে মাঝে একটু বাড়াবাড়ি মনে হলেও তার পড়ানোর প্রতি আমাদের মনোযোগটা নষ্ট হত না। তবে তার একটাই দুঃখ ছিল, তিনি যখন পড়াতেন, আমরা শুধু তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে শুনতাম, কিছুই নোট করে নিতাম না। অন্যরা কেন নিত না জানি না, আমি কখনই বাংলা নোট করতাম না। পরীক্ষার হলে বসে বানিয়ে বানিয়ে লেখাই অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল।

অবশ্য ম্যাডাম এই দুঃখটা খুব বেশিও করতে পারতেন না, কারণটা উনি নিজেই বলতেন, "আর্টসের মেয়েরা অনেক নোট নেয়, তবু কেন যেন প্রতি বছর সায়েন্সের মেয়েরাই বাংলায় বেশি নাম্বার পেয়ে যায়। " পদার্থের এক ম্যাডাম ছিলেন আমাদের ক্লাস টিচার। তার ক্লাসে বলতে গেলে কিছুই বুঝতাম না। আমারই অক্ষমতা হয় তো। তবে তার নিত্য নতুন শাড়ী আর তার সাথে ম্যাচিং গয়নাগুলো দেখতে খুব ভালো লাগত ।

ম্যাডাম আমাকে তেমন একটা পছন্দ করতেন না, কারণ কলেজের পরীক্ষায় তার বিষয়ে আমি কখনই ভালো করতে পারতাম না। কিন্তু পরে আমার ছোট বোন যখন একই কলেজে ভর্তি হল, আমি ততদিনে বেরিয়ে গিয়েছি, সে প্রায়ই আমার কাছে এসে গাল ফুলিয়ে বলত, "তুমি এই ম্যাডামকে কী জাদু করেছ? খালি আমাকে বকা দেয়, বলে তোমার বোন এত ভালো ছিল, তুমি তার মত পারো না কেন?" আজব! মনে হয় বলতে চাইছিলেন তুমিও তোমার বোনের মত পরীক্ষায় কম নাম্বার পেতে পারো না কেন? বাংলার আরেকজন ম্যাডাম ছিলেন আমার খুব প্রিয়, ম্যাডামও আমাকে নেকনজরে দেখতেন। তার একটা অবশ্য কারণ ছিল, ম্যাডাম আমাকে আরও আগে থেকেই চিনতেন। মেডিকেলে ভর্তি হবার পর কলেজে গিয়েছিলাম শুধু এই ম্যাডামের সাথে দেখা করে সুখবরটা জানাতে, আর তার চোখে আনন্দটুকু দেখতে। নিরাশ হইনি।

বায়োলজীর প্র্যাকটিকালের ম্যাডামকেও ভালো লাগত। রসায়ন প্র্যাকটিকালের ম্যাডামকে একটু কেমন যেন অস্থির অস্থির মনে হত। সব সময় যেন একটা তাড়ার মধ্যে থাকতেন। তবে শেখাতেন ভালোই। কলেজের আরও অনেক স্মৃতি আছে।

আজ শুধু শিক্ষকদের কথা বললাম। পরে হয়ত আরও লিখতে চেষ্টা করব।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.