আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একটি কলেজের আত্মকাহিনী

অসতী মাতার পুত্র সে যদি জারজ-পুত্র হয়, অসৎ পিতার সন্তানও তবে জারজ সুনিশ্চয়!

আমার নাম সারদা সুন্দরী মহাবিদ্যালয়। শহর থেকে ২৬ মাইল দূরে মহব্বতপুর গ্রামের মাঠের মধ্যে আমার অবস্থান। অতি নিকটেই অর্থাৎ দুই/তিন কিলোমিটারের মধ্যেই আমার আরও প্রতিবেশী কলেজ আছে। সবার মাঝে আমিও বীরদর্পে আমার সন্তানদের নিয়ে মাথা উঁচু করে আছি। গ্রামের মানুষেরা আমাকে নিয়ে বেশ গর্ব করে বলে, আমাদের নিজস্ব একটা কলেজ আছে।

এটা আরও ব্যাপক করে প্রচারের জন্য আমার প্রতিষ্ঠাতারা দিন রাত্রি পরিশ্রম করে চলেন। অবশ্য তারাই তো এ সমাজের হর্তাকর্তা। আমার উত্থানের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। আমি আজ যেখানে বসবাস করছি সেখানে অতি উর্বর ফসলের জমি ছিল। ধানের সময় ধান, পাটের সময় পাট ফলত আমার বুকে।

কৃষকরা অতি আনন্দে ফসল বুনত, নিয়োমিত দেখতে আসত এ ফসল। অতি যত্নে বড় করে তুলত আমার বুকের মানিকদের। একদিন শুনলাম পাশের গ্রামে সরকার দলীয় নেতারা একটি কলেজ নির্মাণ করেছে। এ কথা শুনে তো এ এলাকার রাজনৈতিক নেতাদের মাথা কাটার মত অবস্থা। এটা কি হয়! আমার এলাকায় আমাদের প্রভাবাধীন একটি কলেজ থাকবে না।

মুখ দেখাবো কি করে? গোপনে মিটিং বসল। সিদ্ধান্ত হল আমার গায়ের উপরই আপাতত চাটাইয়ের বেড়া দিয়ে নির্মান করা হবে আমাকে। নেতারা একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। যাক বাবা্, আপাতত মান সম্মান রক্ষার জন্য কিছু করা হল আর কি। তারা অবশ্য এটা যানে যে, এখানে এ সরকারের আমলে তেমন বিশেষ কিছু অনুদান পাবে না।

তবু ভয় কি? টাকা লাগে, দেবে গৌরী সেন। নেতাদের আত্মীয়স্বজন অনেকেই আছেন যারা মাষ্টার্স করে সদর্পে ঘুড়ে বেড়াচ্ছেন। এদের শিক্ষাজীবন অবশ্য বেশ পিক্যুইলিয়ার। কলেজে ক্লাস নেওয়া শেষে যখন আড্ডায় বসত তখন নিজেদের অতীত রোমন্থন করতে বেশ মজা পেত। জনৈক স্যার বললেন, ‘প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস ফাইভে ফার্স্ট বয়কে স্কেল দিয়ে মেরেছিলাম আমার বিরুদ্ধে আম চুরির অভিযোগ দেওয়ার জন্য।

তাকে মেরেছিলাম আমি নির্দোষ এ জন্য নয়, বরং আমার উপর মাতাব্বরী করার জন্য। এভাবে আর কখনও কাউকে পাত্তা দিইনি। হাই স্কুলে মেয়েদের নিয়ে আড্ডা ভালই জমত। এভাবে প্রেমে পড়ে গেলাম ক্লাস নাইনের এক মেয়ের সাথে। কিসের পড়াশোনা, মেয়েকে আজ এই চিঠিটা দিতেই হবে।

পরীক্ষা সামনে যখন এল, নকল করার উপায় ভালো করে আয়ত্ব করে পরীক্ষা দিতে চলে গেলাম। বিশেষ রাজনৈতিক আদর্শের বড় নেতার আত্মীয় হওয়াই পরীক্ষার হলে তেমন বিশেষ কোন অসুবিধা্ হল না। দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করে গেলাম। আর এই আদর্শ-এর সফল বাস্তবায়ন চালাতে থাকলাম পরবর্তী শিক্ষা জীবন ধরে। ” অন্যরা অবশ্য নিজেকে খাটো করার পক্ষপাতি নয়।

কেউ কেউ পড়াশুনা শেষ করে চাকরির জন্য চেষ্টা করেছে, কিন্তু চেষ্টা করে কি হবে? আমাদের তো আর মামা খালু নেই যে আমাদের চাকরি হবে। এরা অবশ্য রাজনৈতিক নেতাদের মাধ্যমে বিশেষ অংকের ডোনেশন দিয়ে এ কলেজে ঢুকেছে। তারা বলে, টাকা ছাড়া দেশের কোথাও চাকরি নেই। এলাকাই এদের গল্পের দাপটে বাঁচার উপায় নেই। সব জান্তা কিন্তু কোনটাতেই উস্তাদ নয়।

মিটিং, মিছিল, সভা-সমিতি করে যারা পড়ার টেবিলে বসার সময় পেল না, বিশেষ কায়দা করে একাডেমিক সার্টিফিকেট ম্যানেজ করে আনলেন, তারা আজ শেখাতে বসেছে। তথ্যের চাইতে গল্পই যাদের সার, তারা সেই একই মানের স্টুডেন্টস তৈরি করছে। আমার পিয়ন থেকে শুরু করে অতি উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা পর্যন্ত সকলের কাছ থেকে ক্ষেত্র মত বিশাল অঙ্কের টাকা আদায় করা হল আমাকে ভালোভাবে ডেকোরেট করার জন্য। বিশাল একটা ফান্ড রাখা হল আমার রাষ্ট্রীয় বৈধতা আনায়নের জন্য। সমমনা লোকজনদের নিয়োগ দেওয়া হল।

কোন ভালো ছেলে থাকলেও টাকার জোরে ঢুকে গেল বিশেষ ছাত্র সমাজ। এটা নিশ্চিত ছিল যে, এ সরকারের আমলে আমার এম,পিও করার ব্যবস্থা করা যাবে না। তাই বিশেষ চেষ্টা অব্যাহত থাকল ছাত্র ভর্তি সহ পড়াশোনার মানোন্নয়নের জন্য। বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিজ নিজ বিষয়ের ছাত্র/ছাত্রী যারা এসএসসি পাশ করল, তাদের আঁকড়ে ধরা হল। তাদেরই টার্গেট করা হল যারা অতি দরিদ্র।

আর রাজনৈতিক প্রভাব তো আছেই। স্ব রাজনৈতিক মতাদর্শের গার্ডিয়ানকে বোঝানো হল, কাউকে বিশেষ ভয় দেখানো হল যে এখানে ভর্তি না হলে কোন প্রকার সহায়তা করা হবে না। ছেলেমেয়ের পড়াশুনার আগ্রহ আছে কিন্তু পড়াশুনার খরচ দিতে পারছে না, তাদেরকে বই কিনে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হল। স্টুডেন্টসদের নিয়ে আসার জন্য অটোভ্যান ভাড়া করা হল। চারদিকে হৈহৈ রৈরৈ অবস্থা।

আমার সুনাম প্রচারে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল কারন এর উপরও নির্ভর করছে স্টুডেন্টস ভর্তির ব্যাপারটি। শেষ পর্যন্ত কেউ বা দারিদ্রে্র চাপে, কেউবা রাজনৈতিক চাপে, কেউবা বিশেষ বাকচাতুর্য্যের ধোকায় পড়ে এখানে আমার বুকে ভবিষ্যত স্বপ্নের শুরু করতে আসল। অবশেষে বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী জোগাড় হল। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা নিজেদের যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখতে পারেনি, তারা হলেন শিক্ষক। টার্গেট হল কোনরকমে বুঝিয়ে পাশ করানো।

একদিন দেখি আমার আঙ্গিনায় অনেক লোকের সমাগম। অনেক ছাত্রছাত্রীর উপস্থিতিতে উৎসব মূখর পরিবেশ। প্রিন্সিপ্যাল স্যার খুবই ব্যস্ত। বিভিন্ন শিক্ষককে বিভিন্ন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দেখাশুনা করার জন্য। রান্নার মিষ্টি গন্ধে আমার চারপাশ আবেশিত।

বুঝলাম আজ আমাকে রাষ্ট্রীয় ভাবে অনুমোদিত করার চেষ্টা চলছে। এরই মধ্যে নিজ দল ক্ষমতায় এসেছে। সব কিছুই যেন নিজের। স্থানীয় এমপি-এর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে টাকার বিশেষ খেলায় কেটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা উন্মত্ত খেলায় মেতে উঠলেন রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনের কাজে। কলেজের দুরত্ব, ছাত্রছাত্রীর অনুপাত, অবকাঠামো, টিচার স্টাফ সহ অন্যান্য সকল প্রয়োজনীয় তথ্য রাষ্ট্রের যেমন প্রয়োজন তেমনই লিখা হল, বাস্তবতার ফাঁকটুকো টাকার দ্বারা পূর্ণ হল।

কলেজ এমপিও হয়ে গেল। আমি আগেও বলেছি, আমার শিক্ষক কর্মচারীর প্রধান পরিচয় এরা কোন না কোন রাজনৈতিক দলের নেতা ও কর্মী। তারা বিভিন্ন রাজনৈতক কারনে ব্যস্ত থাকেন অথবা ব্যস্ত থাকেন নিজ নিজ ব্যবসা বানিজ্য নিয়ে। ঠিকমত ক্লাসে আসার সময় পান না তাঁরা। মাসে এক বা দুই দিন এসে উপস্থিতি খাতায় স্বাক্ষর করে মাসের বেতন নিয়ে যান।

আমার কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ইতিহাস নিয়ে পড়াশুনা করেছেন। মাঝে কোথায় থেকে কম্পিউটারের একটা সার্টিফিকেট নিয়ে তিনি হয়ে গেলেন কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক। তিনি জানেন না ভাইরাস কি? সন্দেহ প্রকাশ করেন পকেটে থেকে পেন ড্রাইভের মাধ্যমে ভাইরাস কম্পিউটারে প্রবেশ করে। কম্পিউটার নিয়ে কি তাঁহার অধিক জ্ঞান! আমার এক ছাত্র বলছেন, তার বিভাগের এক সম্মানিত শিক্ষককে তিনি প্রথম বর্ষের উদ্বোধনী ক্লাসে একবার পেয়েছিলেন, আর একবার তাঁকে পাবার সৌভাগ্য হয়েছিল দ্বিতীয় বর্ষে উঠে। কলেজের ছাত্রছাত্রীদের কাছে নিজের মহত্ব জাহির করার চাইতে তাঁরা এলাকা গরম রাখতে বেশি আগ্রহ বোধ করেন।

যাহোক, আমার রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতির ষোলকলা পূর্ণ হওয়ার পর কলেজে তাদেঁর দায়দায়িত্ব শেষ। সকালে মটরসাইকেলে চেপে আধা কিলোমিটার বা তার চেয়েও কম পথ পাড়ি দিয়ে কলেজে এসে শুরু করে দেন আড্ডা। আমি সকালে ক্লাস হওয়ার কেন্দ্রস্থল-এর পরিবর্তে সকালের জমিয়ে আড্ডা, ব্যবসা-বাণিজ্যের আলোচনা আর দুপুর থেকে শুরু হল রমরমা কোচিং বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হলাম। এলাকার মেধাবী ছাত্রদের নিজেদের কলেজের শিক্ষকতার মূলধনটুকু ভাঙিয়ে বাগিয়ে নিলেন। এভাবে বিশাল একটা প্রভাব বলয়ের ভিত আরও শক্তিশালী করলেন।

আমার স্যারদের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে অসন্তুষ্টির শেষ নেই। তাঁরা নিজেদের এখন সমকক্ষ ভাবেন এ সকল মেধাবী ছাত্রের সাথে যারা সময়ের মূল্য দিয়ে অনেক চড়াই উৎরাই পাড়ি দিয়ে কোন এক সরকারী কলেজের শিক্ষক হয়েছেন। তাঁরা শুধুমাত্র বাড়ি ভাড়া নিয়ে যে যৌক্তিক বৈষম্য আছে তা মানতে রাজি নন। পূর্ণ বাড়ি ভাড়া তাদেঁর দরকার নিজ বাড়িতে বসে বৌয়ের হাতে গরম ভাত খেয়েও। এখন তাদের দ্রুত প্রমোশনও দরকার।

কথার ফুলঝুরিতে যারা প্রথম থেকেই দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন, তাঁরা কোয়ালিটি অব এডুকেশন নিয়ে কথা বলেন। এখন তাঁদের দাবি আমাকে একেবারে পূর্ণ জাতীয়করণ করে নিতে! সম্প্রতি এক বিশেষ রাজনৈতিক দলের সভানেত্রীর সমস্ত বেসরকারী কলেজ জাতীয়করণের আশা দেওয়ায় তাঁরা খুব জোরে সোরে জাতীয়করনের পক্ষে নিজেদের কথার অন্তসারহীন ফুলঝুরি ছড়াচ্ছেন। আমার তো আনন্দের শেষ নেই। আমার ধ্যান-ধারণা পাল্টে গেল। আমি বুঝতে শিখলাম।

কোথাকার কোন এক মূর্খ কৃষক আমার বুক চিরে হাল চাষ করে সামান্য শস্য ফলাতো। আজ কত ভালোই না হয়েছে। কত কত নামি দামি বিদ্বানরা এখন আমার উর্বর জমিনে পদধুলি দেন, ভাবতে আমার বেশ ভালো লাগে। ভালো লাগে এ ভেবে যে, ফ্রাসিলিটিস ডিপার্টমেন্টর বিশেষ অনুগ্রহে আমি এখন তিন তলা বিশিষ্ট একটা ভবন। আবার এখন আমার জাতীয়করনণর প্রক্রিয়া শুরু হবে।

আমার নাম পরিবর্তন করে রাখা হবে “সারদা সুন্দরী সরকারী মহাবিদ্যালয়” আমার উত্তরোত্তর বস্তুগত সমৃদ্ধি দেখে আমার প্রতিষ্ঠাতাদের রাজনৈতিক শক্তিশালী অবস্থান অণ্য অনেকের চক্ষুশূল হচ্ছে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.