নাজমুল ইসলাম মকবুল
আড়িয়ল বিলে ধানের বাম্পার ফলন
ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের হাঁসাড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে পশ্চিমে বাড়ৈখাল-মদনখালী সড়কের দু’পাশে যেদিকে চোখ যায় দিগন্তজুড়ে শুধু ধান আর ধান। ক্ষেতগুলোতে সবুজ বদলে সোনালি রঙ আসতে শুরু করেছে। মৃদু বাতাসে ধানের শীষগুলো দুলে ওঠার সঙ্গে কৃষকের হৃদয়ও নেচে উঠছে খুশিতে। কৃষকরা বলছেন, এবার ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। একরপ্রতি প্রায় ১০০ মণ ধান পাওয়ার আশা করছেন তারা।
আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে সপ্তাহখানেকের মধ্যেই পুরোদমে শুরু হবে ধানকাটা। সারা বছরের খোরাকি রেখে বিক্রি করে দেবেন বাড়তি ধান।
হাঁসাড়া-বাড়ৈখালী সড়ক এলাকাটি আড়িয়ল বিল এলাকাভুক্ত। প্রায় ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কের দু’পাশে এখন সোনালি ধানের সম্ভার। মাইলের পর মাইল বিস্তৃত ফাঁকা মাঠে শুধু ধানক্ষেত।
এখানকার কৃষাণ-কৃষাণীরা রাতদিন ব্যস্ত। নিজের সন্তানের মতোই পরিচর্যা করছেন ধানক্ষেতগুলোর। কৃষকদের নিরলস পরিশ্রম আর অনুকূল আবহাওয়ার ফলে এবার ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে বিলজুড়ে। ধানের পাশাপাশি ভালো ফলন হয়েছে কুমড়া, লাউ, আলু, সরিষা, মাসকালাই, মটর, মরিচ, রসুন ও পেঁয়াজসহ অন্যান্য ফসলেরও। এ বিল একটি শস্যভাণ্ডার এবং জীববৈচিত্র্যের আধারও।
মদনখালী গ্রামের কৃষক শেখ কবির উদ্দিন, মমিন
আলী, মুজিবুর রহমান, আলী চাঁন, আওলাদ হোসেন জানান, চলতি মৌসুমে তারা প্রত্যেকে এক থেকে দেড় হাজার মণ করে ধান পাবেন। এর মধ্যে পরিবারের খোরাকির জন্য একশ’ মণের মতো এবং বীজের জন্য ৮-১০ মণ রেখে পুরোটাই বিক্রি করে দেবেন।
মদনখালী গ্রামের আবদুল জলিল বলেন, ৩৫ বিঘা জমিতে ইরিধান আবাদ করেছেন। এসব জমি থেকে দেড় হাজার মণের বেশি ধান পাবেন। তিনি আরও বলেন, পলিমাটির কারণে এখানকার জমিগুলো খুবই উর্বর।
মাটির বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে পানি দিতে হয় কম। সারও কম লাগে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের জমির তুলনায় তিন ভাগের এক ভাগ সার ও পানির প্রয়োজন হয় বিলের জমিতে। আর ফলন হয় অন্য এলাকার জমির দ্বিগুণ। ধানে চিটার পরিমাণ থাকে না বললেই চলে।
শ্রীনগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মকবুল আহমদও প্রায় একইরকম তথ্য জানান। আড়িয়ল বিলে বাম্পার ফলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শ্রীনগর উপজেলার আওতাভুক্ত প্রায় সাড়ে ৭ হাজার একর জমিতে ইরি ধান আবাদ হয়েছে। একরপ্রতি লক্ষ্যমাত্রা আড়াই টন। এবার ধানের ফলন ভালো হয়েছে। শিলাবৃষ্টি থেকে ফসল রক্ষা করা সম্ভব হলে এ লক্ষ্যমাত্রা ৩ টন (৮৫ মণ) ছাড়িয়ে যাবে বলে তিনি মত দেন।
তার দেয়া তথ্যমতে, এবার বিলে চিকন চালের ধান হিসেবে পরিচিত বাসমতি, বাংলামতি, বি-২৯, বি-২৮ জাতের ধান বেশি চাষ হয়েছে।
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, আড়িয়ল বিল এলাকার বেশিরভাগ চাষী প্রান্তিক ও বর্গাচাষী। শুধু শ্রীনগর উপজেলাতেই বর্গা ও প্রান্তিক চাষীর সংখ্যা প্রায় ৮ হাজার। তাদের অনেকে স্থানীয় হিসেবে এক গণ্ডা (প্রতি ৭ শতাংশ) জমি এক হাজার টাকায় লিজ নিয়ে ধান আবাদ করেছেন।
মদনখালী গ্রামের দরিদ্র বাসিন্দা মঞ্জু বেগম ও হাসিনা বেগম বলেন, প্রতি মৌসুমে কুড়িয়ে ৩০ থেকে ৪০ মণ করে ধান পান তারা।
এই ধান দিয়ে তাদের পরিবারের ৬-৭ মাসের খোরাকি হয়। বর্ষা মৌসুমে বিল থেকে শামুক সংগ্রহ করেন। কামারখোলা গ্রামের শিউলী বেগমের ভাষায়, ‘হামু টোগাই খাই (শামুক কুড়িয়ে খাই)। এক বস্তা হামু তিন থেকে চাইরশ’ টেহা। এই হামু চিটাগাং-কক্সবাজার যায়, ইছামাছেরে খাওয়ায়।
’ কামারখোলা গ্রামের বৃদ্ধা সয়মন বানু বলেন, ‘বড়লোক গেরস্থরা ধান কাইটা নেওনের পর গরিব মাইনষে ধান টোগাই খায়, এই ধান খাইয়া হারা বছর বাঁচে। ’
বাড়ৈখালী গ্রামের বাসিন্দা খোকন মিয়া জানান, তাদের এলাকার মানুষ সাবান, লবণ, কাপড় ছাড়া অন্য কোনো কিছু কিনতে হয় না। মাছ, শাকসবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছুই উত্পাদন হয় তাদের জমিতে।
আড়িয়ল বিল রক্ষা কমিটি ও বিভিন্ন সংস্থার তথ্য-উপাত্ত ঢাকা ও মুন্সীগঞ্জ জেলা এবং পদ্মা নদীর মাঝখানে অবস্থিত আড়িয়ল বিলের দৈর্ঘ্য প্রায় ২৬ মাইল এবং প্রস্থ ১০ মাইল বা তারও বেশি। এর আয়তন প্রায় ২৬০ বর্গমাইল বা ১ লাখ ৬৬ হাজার ৬০০ একর।
মদনখালী, মুন্সীনগর, কালাইমারা, মরিচপট্টি, কামারখোলা, দুর্গাপুর, গোবিন্দপুর, ধুবলী, শতভোগ, মৌড়া, দীপপুর, নাড়ারটেক, পাইশা, মুসলিমহাটি, চুড়াইন, খাররা, বাড়ৈখালী, শিবরামপুর, শ্রীধরপুর, আলমপুর, তির্থীঘাট, শেখরনগর, লঙ্করপুর, হাঁসাড়া, বালাশুর, ঘনশ্যামপুর, পুঁটিমারা, কেয়টখালী, মুন্সীরহাট, উমপাড়া, শ্রীনগর, দয়াহাটা, আরদিপাড়া, কানাইনগর, মিরাবাড়ি, কৃষ্ণনগর, খৈয়াগাঁও, শনবাড়ি, আদমপাড়া, গাজীঘাট, শ্যামসিদ্ধি, উদরপাড়া, বালাপাড়া, মত্তপুরসহ আরও অনেকগুলো গ্রাম নিয়ে আড়িয়ল বিলের অবস্থান। সবকটি গ্রামেই এবার ধানের বেশ ভালো ফলন হয়েছে বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন। বিল এলাকা ঘুরে দেখা গেছে চারদিকে ধান কাটার প্রস্তুতি চলছে। এরই মধ্যে ময়মনসিংহ, গাইবান্ধাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কামলারা আসতে শুরু করেছেন ধান কাটার জন্য। কৃষাণীরা ধান শুকানোর খলা তৈরিতে ব্যস্ত।
প্রতিটি বাড়ির উঠানে নামানো হয়েছে ধান মাড়াইয়ের ডিজেলচালিত মেশিন।
বাড়ৈইখালী এলাকায় নতুন তৈরি করা টিনের চালার নিচে ২০-২৫ জন শ্রমিক। তারা জানান, ধান কাটার জন্য এসেছেন গাইবান্ধার সাঘাটা থেকে। প্রায় ২০ দিন কাজ করে আবার চলে যাবেন এলাকায়।
শ্রীনগর স্কুলের সাবেক শিক্ষক আবদুল জলিল মাস্টার বলেন, ‘আড়িয়ল বিল আল্লাহর নেয়ামত।
এই বিল আমাদের মা, আমাদের বাবা। এখানে বর্ষায় পাট, আমন ধান, ধইঞ্চা, শামুক, শাপলা-শালুক জন্মে। পানিতে প্রাকৃতিকভাবেই জন্ম নেয় হাজার হাজার মণ মাছ। রবি মৌসুমে কুমড়া, লাউ, হাজারও জাতের শাকসবজি আর লাখ লাখ মণ ইরি ধান হয়। ’ অর্থাত্ সম্পদের ভাণ্ডার এ বিল।
তিনি আরও বলেন, মাছের অবাধ বিচরণক্ষেত্র এই বিল। বিলের বড় বড় কয়েকটি ডাঙ্গা (বড় জলাশয়) শুকনো মৌসুমেও শুকায় না। ফলে প্রাকৃতিকভাবেই এখানে অনেক মাছ জন্মে। বিলে ধরা মাছ বাজারজাত করার জন্য এ এলাকায় প্রায় ৩০টি মাছের আড়ত আছে। এর মধ্যে মদনখালী, আলমপুর, চুড়াইন, ওমপারা, বালাশুর, ভাগ্যকুল, শ্রীনগর, হাঁসাড়া, ষোলঘর, আলআমিন বাজার, শিমুলিয়া, ছত্তভোগ, মরিচপট্টি, দুবলী ও ঝুড়িখালপাড় এলাকায় আড়ত রয়েছে।
বাড়ৈখালীর হোসেন আলী জানান, তাদের এলাকায় দেশের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ মিষ্টিকুমড়া জন্মে। বড় আকারের একেকটি কুমড়ার ওজন একশ’ কেজি পর্যন্ত হয়। মুন্সীনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক বলেন, পাখি আর মাছের অবাধ বিচরণক্ষেত্র এই বিল। জীববৈচিত্র্যের দিক থেকেও অত্যন্ত সমৃদ্ধ এই বিলটি।
উল্লেখ্য, সরকার গতবছর ৫০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও বঙ্গবন্ধু সিটি তৈরির জন্য আড়িয়ল বিলকে স্থান নির্ধারণ করে।
পরে স্থানীয় জনতার ব্যাপক প্রতিবাদ বিক্ষোভের মুখে বিমানবন্দর তৈরির পরিকল্পনা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছিল।
সুত্র: আমার দেশ
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।