নাজমুল ইসলাম মকবুল
ফ্যাসিবাদ প্রতিহত করার লড়াইয়ে বিলম্ব : দেশকে অকার্যকারিতার দিকে নিয়ে যাবে
মা হ মু দু র র হ মা ন
স্বাধীনতার দীর্ঘ পথ
এখন আর গারদে বসে অপেক্ষা করতে তেমন একটা কষ্ট হয় না। জেল থেকেই একটা বই আর পুরনো খবরের কাগজ সঙ্গে নিয়ে যাই। বইও আবার মাঝে-মধ্যে সিপাই-সেন্ট্রিকুল পরীক্ষার নামে উল্টে-পাল্টে দেখে। একদিন বিরক্ত হয়ে বলেই উঠেছিলাম, এই যে পাতা ওল্টাচ্ছেন, কিছু বুঝতে পারছেন আপনারা? বইটা ছিল নেলসন ম্যান্ডেলার ২৭ বছর কারাভোগের অসাধারণ কাহিনী Long walk to Freedom .......
(গত ১৪ এপ্রিলের পর)
তিনটে দিন শুয়ে-বসে আর গল্প করে কেটে গেল। মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার জয়নাল ভাই ও মার্কিন নাগরিক ফয়সাল আনসারীর সঙ্গে বন্ধুত্ব ক্রমেই গাঢ় হচ্ছে।
মেজর (অব.) জয়নাল আবেদিন অত্যন্ত ধার্মিক মানুষ, প্রতি সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজের পর দীর্ঘক্ষণ ধরে জিকির করেন। সারারাত না ঘুমিয়ে ইংরেজিতে কোরআন শরীফের তফসির লিখছেন। এর মধ্যে তার একটা তফসির পড়েও ফেলেছি। ধর্ম বিষয়ে আমার এত জ্ঞান নেই যে, সেই তফসিরের মান সম্পর্কে মন্তব্য করতে পারি। তবে তফসির পড়তে আমার ভালোই লেগেছে।
কোর্টে হাজিরা না থাকলে ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমাতে যান এবং ওঠেন প্রায় দ্বিপ্রহরে। জয়নাল ভাই ঘুমাতে যাওয়ার খানিক আগে আমার দিন শুরু হয়। জেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমার একটা রফাও হয়েছে। অন্য বন্দিদের সেলের তালা সকাল ছ’টার পর খোলা হলেও আমারটা খুলে দেয়া হয় তার ঘণ্টাখানেক আগে। ফজরের নামাজ শেষ করে সেই সময় পর্যন্ত কারারক্ষীর আগমনের অপেক্ষায় থাকি।
তালা খোলা হলে প্রাতঃকর্ম এবং গোসল শেষ করে সেলের সামনের টানা বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে গরম হরলিক্সের মগে আমি যখন চুমুক দিই, তখন সাত নম্বর সেলের অপর বন্দিরা এক এক করে তাদের সেল থেকে বেরোতে থাকে। ফয়সাল আনসারীর অভ্যাস অনেকটা আমার মতোই। সেও বেশ সকালেই গোসলের ঝামেলা মিটিয়ে ফেলে। অবশ্য স্বাস্থ্য রক্ষার্থে গোসলের আগে আধঘণ্টাখানেক হাঁটাহাঁটি করে নেয়। আমার আবার ওই অভ্যাস কস্মিনকালেও ছিল না।
এই বয়সে নতুন করে শুরু করতেও ইচ্ছে হয় না। তবে, আল্লাহ তাঁর অপার করুণা দিয়ে আমাকে যথেষ্ট সুস্থ রেখেছেন। সাড়ে সাতটায় ফয়সালের সঙ্গে দিনের প্রথম দফার আড্ডা শুরু হয়। এই ক’দিনে দুই বাবুই আমার রুটিন জেনে গেছে। ওরা ঘুম থেকে উঠে প্রথমে আমাদের জন্য গরম চা বানায়।
আমবন্দির এই জেলজীবন একেবারে মন্দ কাটছে না।
আধঘণ্টা আড্ডা দিয়ে ফিরে যাই লেখার টেবিলে। ন’টার মধ্যে চম্পাকলি সেল থেকে সেবক নাস্তা নিয়ে আসে। জেলজীবনের প্রথম তিনদিন উপরের নির্দেশে আমাকে শায়েস্তা করার জন্যে ভাতে ও পানিতে মারার ব্যর্থ চেষ্টার পর জেল কর্তৃপক্ষ রণে ভঙ্গ দিয়েছে। এখন তিনবেলার আহারই ডিভিশন বন্দিদের হেঁসেল থেকে আসছে।
ফয়সালের কাছ থেকে শুনেছি, ডিভিশনের বন্দিদের দৈনিক খোরাকি ৮৬ টাকা। এই টাকার সঙ্গে আমাদের পিসির (Personal Cash) টাকা যোগ করে ডিভিশনে বাজার করা হয়। এতসব বন্দোবস্ত করে যে মানের খাওয়া আসে, তাতে মোটামুটি জীবন ধারণ চলে। এর বিপরীতে সাধারণ কয়েদিদের জন্যে সরকারি বরাদ্দ মাথাপিছু মাত্র চল্লিশ টাকা। সরকারি বরাদ্দের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ আবার চলে যায় জেল ও জেলের বাইরের ক্ষমতাবানদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারায়।
ফলে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলবন্দির যে খাদ্য দৈনিক সরবরাহ করা হয়, সেটা খেয়ে জীবন ধারণ কেবল এদেশের মানুষের পক্ষেই সম্ভব। এই অসহায়, দরিদ্র বন্দিদের ততোধিক দরিদ্র আত্মীয়-স্বজন মাঝে-মধ্যে দেখা করতে এলে পরম মমতাভরে তারা যে খাবারটুকু প্রিয়জনের জন্যে নিয়ে আসে, তারও অর্ধেক চলে যায় কারারক্ষী এবং নেতা কিসিমের কয়েদিদের উদরে। সেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে বিদ্রোহী কবি নজরুল লিখেছিলেন :
‘প্রার্থনা করো—যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ। ’
আমাদের জাতীয় কবি আজ বেঁচে থাকলে এ যুগের দেশি শাসকশ্রেণীকে অভিশাপ দেয়ার উপযুক্ত ভাষাই হয়তো খুঁজে পেতেন না।
অন্যান্য দিনের মতো নাস্তার পাট চুকিয়ে সবে কলম হাতে বসেছি, আর ছোট এক স্লিপ হাতে কারা অফিস থেকে রাইটার এসে হাজির।
আমাকে নাকি আজই গোপালগঞ্জ যেতে হবে। সেখানে কবে কার মানহানি করেছিলাম, স্মরণে না থাকলেও শুনলাম বাংলাদেশের অঘোষিত রাজধানী এবং বিশেষ কারণে পরম পবিত্র ‘তীর্থভূমি’তে তিন-তিনটে মানহানির মামলা দায়ের হয়েছে। আগামীকাল সেই মামলাত্রয়ের শুনানির দিন ধার্য করেছেন সেই জেলার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। অতএব, আসামি চলো এবার চালানে। চালানের গল্প এতদিন শুধু শুনেই এসেছি, এবার অভিজ্ঞতা অর্জিত হতে যাচ্ছে।
আমাকে নেয়ার পদ্ধতিটা কী হবে, তাও বুঝতে পারছিলাম না। প্রিজন ভ্যানের যে অভিজ্ঞতা গত চার সপ্তাহে অর্জন করেছি, তাতে ওই বাহনে চড়ে এত দূর যাওয়াটা সুখপ্রদ হবে না। তাছাড়া পদ্মা নদী পাড়ি দেয়ার সমস্যাও রয়েছে। এদিকে পয়লা জুলাই ঢাকার সিএমএম আদালতে অন্য মামলায় হাজিরার দিন ধার্য করা আছে আগে থেকেই। তিরিশে জুন গোপালগঞ্জ আদালতের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ঢাকায় ফিরতেও তো বেশ রাত হয়ে যাবে।
পুরো আয়োজনটি যে আমার হয়রানির জন্যেই বিশেষভাবে নেয়া হয়েছে, সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু অসহায় আসামির প্রতিবাদের কোনো সুযোগ নেই। জেল কর্তৃপক্ষের নির্দেশমত চটপট তৈরি হয়ে নিলাম। এসব প্রস্তুতিতে আমার সচরাচর পনেরো মিনিটের বেশি সময়ের প্রয়োজন হয় না। সমস্তটা দিন বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে অপেক্ষা করে রইলাম।
কেন জানি না, শেষ পর্যন্ত চালানে আর পাঠানো হলো না। জেল সুপার ও জেলারের সৌজন্যবোধের এতটাই অভাব যে, গোপালগঞ্জে চালান বাতিলের বিষয়টি তারা আমাকে সারাদিন জানানোর কোনো প্রয়োজন বোধ করলেন না। রাতে ঘুমানোর সময়ও জানি না যে রাত পোহালেই সরকার আমার জন্যে অপর একটি চমকের ব্যবস্থা করে রেখেছে। ভোরের প্রাত্যহিক গোসল শেষ করে সেলে ঢোকার আগেই নতুন একখানা স্লিপ এসে হাজির। গোপালগঞ্জের পরিবর্তে ঢাকা সিএমএম আদালতেই যেতে হবে, সেখানে নাকি নতুন একটি মামলা দায়ের হয়েছে।
চব্বিশ ঘণ্টা বাদে বুঝলাম, কেন কাল গোপালগঞ্জে যেতে হয়নি। ঢাকায় কে বাদী, কিসের মামলা—এসব বৃত্তান্ত সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্ধকারে থেকেই সকাল দশটার দিকে জনসন রোডের পরিচিত কোর্ট গারদে পৌঁছালাম। দুপুর দুটো পর্যন্ত সেখানেই বসিয়ে রাখা হলো।
অভিজ্ঞতার মূল্য আছে, এখন আর গারদে বসে অপেক্ষা করতে তেমন একটা কষ্ট হয় না। জেল থেকেই একটা বই আর পুরনো খবরের কাগজ সঙ্গে নিয়ে যাই।
সঙ্গের খবরের কাগজ নোংরা মেঝেতে পেতে তার ওপর শুয়ে শুয়ে বই পড়ি। আদালত থেকে ডাক এলে বই বগলে নিয়ে হাঁটা দিই। সেই বইও আবার মাঝে-মধ্যে সিপাই-সেন্ট্রিকুল পরীক্ষার নামে উল্টে-পাল্টে দেখে। একদিন বিরক্ত হয়ে বলেই উঠেছিলাম, এই যে পাতা ওল্টাচ্ছেন, কিছু বুঝতে পারছেন আপনারা? বইটা ছিল বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়কদের অন্যতম নেলসন ম্যান্ডেলার ২৭ বছর কারাভোগের অসাধারণ কাহিনী Long walk to Freedom। যা-ই হোক, কাঠগড়ায় ওঠার পর জানলাম, আজকের এই নতুন মামলার বাদী একজন ক্ষমতাবান ভিআইপি।
মামলার ধারা সেই অতি পরিচিত, মানহানি। তবে প্রকাশিত সংবাদটি প্রধানমন্ত্রীপুত্র সংক্রান্তের পরিবর্তে অসীম ক্ষমতাধর এক প্রতিমন্ত্রীর পরিবার সংক্রান্ত। আইন প্রতিমন্ত্রীর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা, প্রখ্যাত হাকিম হাফেজ আজিজুল ইসলাম ১৯৭১ সালে পাকিস্তান নেজামে ইসলামী দলের শীর্ষস্থানীয় নেতা ছিলেন। বলাই বাহুল্য, তিনি মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধপক্ষ ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় অন্যান্য রাজাকারের মতোই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। হাকিম আজিজুল ইসলাম ‘নেজামে ইসলাম’ নামে সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকও ছিলেন।
পত্রিকাটির উদ্দেশ্য ছিল অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে প্রচারণা চালানো। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পণ করার পর আইন প্রতিমন্ত্রীর বড় ভাই মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা অপহৃত হন। তাকে গুরুতর আহত এবং সংজ্ঞাহীন অবস্থায় একটি পরিত্যক্ত গর্ত থেকে আত্মীয়-স্বজনরা উদ্ধার করেন। আমার গ্রেফতারের আগে আমার দেশ পত্রিকায় এই বস্তুনিষ্ঠ সংবাদটি প্রকাশিত হওয়ার অপরাধে আইন প্রতিমন্ত্রীর ছোটভাই, বিশিষ্ট আঁতেল চিত্রপরিচালক মোরশেদুল ইসলাম আমিসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদকের বিরুদ্ধে মানহানি মামলা করেছেন।
বিবেচনা করে দেখলাম, প্রকৃতপক্ষেই আমার অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সোল এজেন্সিপ্রাপ্ত দল আওয়ামী লীগে যোগদান করলে দেশের তাবত্ রাজাকার যে মহান মুক্তিযোদ্ধায় পরিণত হয়, এই চমত্কারিত্ব আমার বিস্মৃত হওয়া কোনোক্রমে উচিত হয়নি। আওয়ামী লীগ নামক পরশ পাথরকে চিনতে না পারার মাশুল তো এখন আমাকে গুনতেই হবে। মামলার ধারাই যেহেতু জামিনযোগ্য, কাজেই ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয় সরকারি চাপ সত্ত্বেও অসহায়। তবে আমি সরকারি উকিলের বক্তৃতা শুনে পেটে প্রচণ্ড খিদে সত্ত্বেও নির্মল কৌতুক বোধ করছিলাম। তিনি উচ্চকণ্ঠে বলে চলছিলেন, এই মামলার ভয়ঙ্কর আসামিকে জামিন দেয়া হলে তার পালিয়ে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা থাকায় জামিন আবেদন নাকচ করা হোক।
উত্তেজনার তোড়ে ভদ্রলোক বোধহয় ভুলে গিয়েছিলেন, গোটা চল্লিশেক মামলার বোঝা মাথায় নিয়ে আমি কারান্তরালেই রয়েছি। আইন প্রতিমন্ত্রীর ভাইয়ের দায়ের করা জামিনযোগ্য মামলায় ম্যাজিস্ট্রেট আইন অনুযায়ী আজ জামিন দিলেও আমাকে আদালত থেকে সেন্ট্রাল জেলেই ফিরতে হবে। পালিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগই নেই। আসলে পিপি বেচারাও অসহায়। এমন ক্ষমতাবান বাদীর মামলায় তার প্রাণপণ লাফালাফি করে হুঙ্কার না দিলে খবর আছে।
শুনানির আনুষ্ঠানিকতা শেষে জামিন মিলল, আমিও আদালতে উপস্থিত নানা পেশার বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে প্রিজন ভ্যানে উঠলাম।
আজ বন্দি জীবনের এক মাস পূর্ণ হলো। এই এক মাসে সরকারের ফ্যাসিবাদী চেহারা আরও উন্মোচিত হয়েছে। মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদ এবং দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মতো শীর্ষ নেতৃত্বসহ জামায়াতে ইসলামীর শত শত নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে জেলে পোরা হয়েছে। মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধে দেড় বছর পর ডাকা প্রথম হরতালের সহিংসতাকে কেন্দ্র করে মির্জা আব্বাস, শমসের মবিন চৌধুরী, সংসদ সদস্য শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানিসহ বিএনপিরও অসংখ্য নেতাকর্মীকে বিভিন্ন বানোয়াট মামলায় সরকার আটক করেছে।
সর্বাপেক্ষা উদ্বেগের এবং চরম নিন্দনীয় যে ঘটনাটি ঘটাচ্ছে, তা হলো বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত কাউন্সিলর চৌধুরী আলমকে হরতালের পূর্বরাত্রে সাদা পোশাকের পুলিশ উঠিয়ে নেয়ার পর থেকে তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ক্রসফায়ারের বিরুদ্ধে প্রবল জনমত গড়ে ওঠায় বিগত কয়েক মাস ধরে কথিত সন্ত্রাসী ও বিরুদ্ধ মতাবলম্বীদের বিনাবিচারে হত্যার জন্য মহাজোট প্রশাসন অধিকতর ভয়ঙ্কর গুম-খুন পদ্ধতি চালু করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে অধিক সংখ্যায় বেওয়ারিশ লাশের সন্ধান মিলছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দীর্ঘতর হচ্ছে চৌধুরী আলমের মতো নিখোঁজ ব্যক্তিদের মিছিলও। দেশের একজন নাগরিকের এভাবে গুম হয়ে যাওয়া একটি রাষ্ট্র কিংবা সমাজব্যবস্থার চূড়ান্ত অবক্ষয়ের প্রমাণ।
রাষ্ট্রব্যবস্থা ধ্বংস হওয়ার চূড়ান্ত প্রতিফলন ঘটছে এসব নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায়।
আমি গ্রেফতার হওয়ার আগে আমার দেশ পত্রিকায় গুম-খুন নিয়ে একাধিক প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছিল। শেখ হাসিনার এবারের প্রধানমন্ত্রিত্বে ফ্যাসিবাদের যে ভয়ঙ্কর উত্থান আমরা দেখতে পাচ্ছি, তাকে প্রতিহত করার লড়াই এ জনগণের বিলম্ব অথবা এক প্রকার অনীহা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে নিশ্চিতভাবে অকার্যকারিতার দিকে নিয়ে যাবে। দলমত নির্বিশেষে বিবেকবান প্রতিটি মানুষের তাই আজ মানবাধিকারের পক্ষে দাঁড়ানোটা অতীব জরুরি।
সারাদিন অনাহারে আদালতে কাটিয়ে বিষণ্ন মনেই জেলগেট থেকে আপন মনে সেলের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলাম।
এমন সময় কালো শ্মশ্রুমণ্ডিত মাঝবয়সী একজন জমাদার হাতের ইশারায় আমাকে থামিয়ে বেশ সংকোচ এবং সৌজন্যের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন, স্যার আপনিই কি সাংবাদিক মাহমুদুর রহমান? অনাবিল প্রশান্তিতে মনটা ভরে গেল। আমি জেলে আসার পর থেকে সরকারের তাঁবেদার সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ এবং বুদ্ধিজীবীরা অব্যাহতভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করে চলেছেন যে আমি সংবাদমাধ্যমের কেউ নই। আজই আদালতে আমার পক্ষের আইনজীবী এবং সহকর্মী সাংবাদিকদের কাছ থেকে শুনে এলাম টেলিভিশন টকশোতে আমার ইঞ্জিনিয়ারিং এবং এমবিএ ডিগ্রির ব্যাপারটি এমন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উল্লেখ করা হচ্ছে যেন এটা কোনো লেখাপড়াই নয়। এই যত্সামান্য লেখাপড়া নিয়ে সম্পাদক হওয়ার চেষ্টা করে আমি মহা অন্যায় করে ফেলেছি। আওয়ামী বুদ্ধিজীবীকুল এবং সরকারপন্থী সাংবাদিক শ্রেণী আমাকে সম্পাদক বলে স্বীকারই করেন না।
আর যেহেতু আমি সম্পাদক নই, তাই তাদের মতে রিমান্ডে নিয়ে আমাকে নির্যাতন করা অথবা টিএফআই সেলে চোখ বেঁধে, হাতকড়া লাগিয়ে গারদের শিকের সঙ্গে লটকে রাখা সরকারের গণতান্ত্রিক অধিকারের মধ্যেই পড়ে। অথচ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের এই বর্ষীয়ান জমাদারের কাছে আমি ইঞ্জিনিয়ার নই, সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা নই, বিনিয়োগ বোর্ডের চেয়ারম্যান নই—কেবলই আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক। মনে হলো, এর থেকে বড় সম্মান আমার ৫৭ বছরের দীর্ঘ জীবনে আর কখনও পাইনি। ঢাকা জেলের বন্দি এবং রক্ষী উত্ফুল্ল হয়ে পরস্পরের সঙ্গে কোলাকুলি করলাম। সেলে ফিরে ব্যাকুল হৃদয়ে আল্লাহকে বললাম, বাংলাদেশের একজন দেশপ্রেমিক সাধারণ নাগরিক তার অন্তরের সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে আমাকে যে স্বীকৃতি দিয়েছেন, আমি যেন তার যোগ্য হতে পারি।
(চলবে)
সুত্র: আমার দেশ।
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।