জীবন একটাই; জীবনের জয় অনিবার্য..
স্বপ্ন..স্বপ্ন..স্বপ্ন: চোখ ড্যাবড্যাব করে না দ্বীন ইসলামের। নয়দিনের ক্ষুধার্ত চোখে আর কোন স্বপ্ন দেখে না সে। ব্যাপারটা যেন ফট করেই ঘটে গেল। এক স্বপ্নময় জীবনের হাতছানি। দ্বীনের আলো ছড়াবে বলেই হয়তো বাপের দেয়া নাম নিয়ে বেড়ে উঠছিল ইসলাম।
দারিদ্রতার এক ঘুষি তাকে নিয়ে ফেলল চট্টগ্রাম বন্দরে। রাতের পালায় মাল ওঠানো-নামানোর কাজে। একদিন সন্ধ্যা বা বিকেল, কিংবা যে কোন একটি সময় ধরে নিন। কাজের ফাঁকে ঝিমুনি। অস্বাভাবিক কিছু নয়।
খালি কনটেইনারে শুয়ে পড়লো। চোখে নেমে আসে রাজ্যের ঘুম। দ্বীনের চোখের ঘুম দ্বীন সেই ঘুমই শেষ পর্যন্ত কালঘুম হয়ে দাঁড়ায়। দ্বীনের চোখে হয়তো তখন স্বপ্ন। স্বপ্ন ভেঙ্গে দ্বীনের চর্মচক্ষুতে নিকষ অন্ধকার! আটকা পড়েছে দ্বীন।
এক দুই.. করে নয় দিন পর সিঙ্গাপুরের বন্দরে যখন কনটেইনারটি খোলা হলো, তখন তাঁর ভেতরে পাওয়া গেল কোনো রকমে বেঁচে থাকা দ্বীন ইসলামকে। পাশে পড়ে ছিল আরেক শ্রমিক বন্ধু আলমগীরের গলিত লাশ।
চাকরি.. চাকরি.. স্বপ্ন: ডেনমার্কের সড়ক পথ ধরে ছুটছে সুইবাস এক্সপ্রেস সার্ভিসের দ্রুতযান। লক্ষ্য সুইডেন। মালমো জায়গাটা ডেনমার্ক সীমান্তের কাছেই।
বাসের যাত্রী এক তরুন যাবে মালমো। এবার সে তরুনের কথা বলি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স দিয়েছে তরুন। দুই হাজার সাতের দিকে পাশ করে তার স্বপ্ন দেখার শুরু। একদিন নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের হেলেদুলে চলা শাটলট্রেনের মতো নিজেকেও গতির দুনিয়ায় বড্ড স্লথ মনে হচ্ছিল তার।
মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে তাই হাজির হয়েছে ডেনমার্কে। কী চায় এই তরুন? চাকরি? তরুন চাকরি খুঁজছিল কেন? এখন আপনি ফট করেই বলে উঠবেন তরুন চাকরি খুজবে না তো কী কই মাছ খুঁজবে? উত্তর যদি চাকরি হয়, তাহলে বলি, না মশাাই। থামুন, ভুল করবেন না। আপনি নিশ্চিত হোন- তরুন স্বপ্ন দেখেছিল। জীবিকার স্বপ্ন।
বয়সে তিরিশের ছাপ। চট্টগ্রামের এই তরুন উন্নত দেশ থেকে তার দেশের বাড়িতে নগদ টাকা পাঠায়। ধীরগতির শাটলট্রেনকে নিজের জীবনের প্রতিবিম্ব মনে করে তিনি মুক্তি চেয়েছিলেন। দেশের মাটিতে খুঁেজছিলেন একটা চাকরি। শুরুর পথটা বৈরীই ছিল।
বউ, মেয়ে, মা আর বোনকে নিয়ে অভাবও ছিল তার নিত্যসঙ্গী। চাকরির ধান্দার সাথে ছিল স্বপ্ন। জীবিকার লড়াই। হ্যাঁ। তরুন স্বপ্ন দেখেছিল।
সেই স্বপ্নবাজ তরুনের পাশের সিটে চুপচাপ বসে আছি আমি। দূর মুলুকে অচেনা কারো কণ্ঠে বাংলা শুনলে অবাক হবো। কিন্তু আমি অবাক হলাম তরুনের কণ্ঠে চিটাগংয়ের চিরপরিচিত সুর। তরুন ফোনে অনর্গল কথা বলছে। ফোনের এপাশ ডেনমার্ক ওপাশ চট্টগ্রাম! ডেনমার্ক সীমান্ত ফেলতেই তরুনের ফোন করা শেষ।
সুইডেন সীমান্তে প্রবেশের আগেই অল্প টাকায় মোবাইলে ফোন করার সুযোগের ভালোই ব্যবহার করলো তরুন। ফোন করা শেষ। তরুন মোবাইলটি পকেটে পুরে ডানে ঘাড় ঘোরায়। গলা বাড়িয়ে পরিচয় দিলাম- আমি কিন্তু আপনার দেশের এবং চট্টগ্রামেরও। তরুন উত্তেজিত কণ্ঠে বলে চেহারায় অনুমেয় আপনি বাঙালি।
খোশ গল্প চলতে থাকে। ঠিক চার দিন পর এই আমি বাংলাদেশে ফেরত যাবো শুনতেই তরুনের মন আনচান হলো। আনচানের প্রকাশ ঘটিয়ে তরুন ফট করে বলে উঠে মেয়ের জন্য একটি পুতুল দিতে চাই ভাই। কিন্তু দ্রুতগতির সুইসার্ভিস পুতুল কেনার বিরতি দেয় না। বিদায় নিয়ে তরুন নেমে যায় মালমো।
আধা ঘন্টার আলাপে তরুনের একটি কথা আজও মনে পড়ছে- ‘ডেনমার্কে সাদা দেশের মানুষের মল পরিষ্কার করি। আব্বা-আম্মা জানলে কষ্ট পাবে। তাই সবাইকে একটি কম্পিউটার ফার্মে কাজ করি!’
স্বপ্ন.. স্বপ্ন... ভালোবাসা: তরুনীর নাম জানি না। জানলেও বলবো না। তরুনী চট্টগ্রাম কলেজের উচ্চমাধ্যমিকে পড়তো।
সহপাঠি বন্ধুদের সুন্দরী মেয়েদের তালিকায় প্রথম পর্বের হার্টথ্রব এই তরুনী। সুখে থাকার জন্য আরো দশজনের মতো এক তরুনকে ভালোবেসেছিল তরুনী। ফট করে শুনি ডিবি লটারিতে ‘ভাগ্য খুলে’ দুজনে মিলে মোরা আর জনমে হংস মিথুন ছিলাম গাইতে গাইতে একদিন পাড়ি দিল আমেরিকা! এই কিছুদিন আগে ফেসবুকে আবিষ্কার করি সেই প্রিয় বন্ধুর মুখটি, সুন্দরীর সেই চেহারা আরো নিখুত, আরো লাস্যময়ী। ফেসবুকে বসে বাংলায় দ্রুত গতিতে চ্যাট করতে গিয়ে তরুনীকে কাবু করি। আমি বুঝি, তরুনীর কলেজ পড়–য়া বন্ধু হিসেবে এই অধম এখনও বিরাজমান।
অতপর এক ক্লান্ত রাতে চ্যাট বক্সের অক্ষরে অক্ষরে তরুনী আমায় বলে ব্র“কলিন, সানফ্রান্সিসকো থেকে কাজের জন্য ওয়াশিংটনে যেতে চায় সবাই। কিসের আশায়? একটু সুখের আশায়। করবেটা কী? বাড়ি, লন পরিষ্কার, রেস্টুরেন্টের কাজ, শপিং মল দেখাশোনা করা আর বড়জোর অফিসের পিয়নের কাজ। তবুও ভাগ্যদেবী তাদের প্রতি প্রসন্ন নয়। অভাগাদের কপালে তাই লেখা আছে বিভিন্ন জায়গায় এলোমেলোভাবে ঘোরাঘুরি।
চ্যাট বক্সে বসে আমি রাতের আলাপ শেষ করি। মনে মনে ভাবি হায়, কোথায় আধুনিক চ্যাপলিন যিনি অমর করে রাখবেন ভবঘুরেদের দুর্দশা হাসির ছলে ও তলে? তরুনীকে বলি আমাদের এই প্রান্তীয় বঙ্গের সব মানুষ হুড়মুড় করে ঢুকছে আমাদের স্বপ্নের ঢাকায়। ঢাকায় আসতে না পারলে, ঢাকায় সানগ্লাস দিয়ে ছবি না তুললে, কেনাকাটা করতে না পারলে মায় ঢাকায় সন্তানকে পড়াতে না পারলে আমরা অনেকেই ভুগি ব্যর্থতার গ¬ানিতে। তরুনী জবাব দেয়, ‘একটা জব চাই জব!’
ওখানে মানুষ নাকি সারা দিন কেবল খায়: বাংলাদেশের চিত্র কেমন? আয়ের ক্ষেত্রে? নিশ্চিত উত্তর- আঞ্চলিক বৈষম্য। বঙ্গের এই কূলে আজ তাই পূর্বাঞ্চলের ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট।
বিপরীতে পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর বরিশাল, খুলনা ও রাজশাহী। অভাব আর সম্পদের উচ্চতা দুই-ই বাড়ছে সমান তালে। ঠিক এরকমই একটি দৃশ্যের দেখা মেলে চিত্রপরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘উত্তরা’ ছবিতে। ছবির শেষাংশে আমরা দেখি পেটের ক্ষুধার তাড়নায় খ্রিস্ট ধর্মে দিক্ষিত চার বুড়োর সাথে যারা একদিন দুপুরে গির্জার দেয়া খাবার খেয়ে গাছ তলে মেতে উঠেছে আড্ডায়। এর মধ্যে একবুড়োর আক্ষেপ, ‘ভাবছি এইটা ছাইড়া চইলা যাবো’।
অন্যজন,‘কুথায় যাবি?’ উত্তর, ‘ঐ আমেরিকা নাকি! ওখানে সবাই খ্রিস্টান, আমরাও খ্রিস্টান- একই জাত!’ অন্যজনের আগবাড়িয়ে প্রশ্ন, ‘ওখানে মানুষ নাকি সারা দিন কেবল খায়? আমরাও খাব। ’ স্যামুয়েল নামের এক বুড়ো বলে উঠে, ‘নামটা যেন চিনা চিনা লাগছে, জায়গাটা কুথায় রে? মাইকেল বলে, ‘আছে রে বাপ, আমি কি গিয়েছি নাকি? আগে কইলকাত্তা, ঐখানে বিজলি টেরেন, তা বাদে সমুদ্র পারাইয়া চলা পথ.... আমেরিকা’।
উড়োজাহাজের চাকার খাপ কিংবা জাহাজের কন্টেইনার: চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে- 'সিঙ্গাপুরগামী জাহাজের কনটেইনারে লুকিয়ে নিজেদের পরিচয় গোপন করে সিঙ্গাপুর যেতে চেয়েছিল দুই বহিরাগত'। সেই তরুনের বিদেশযাত্রার গল্পটি মনে আছে? বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন ছিল যার একবুক। একদিন বিমানবন্দরের কড়া পাহারা পেরিয়ে উড়োজাহাজের চাকার খাপকে নিজের গন্তব্যের পুলসেরাত মনে করেছিল যে।
গন্তব্যে গিয়ে চাকার বাক্স খুলে পাওয়া গিয়েছিল সেই তরুনের হীম লাশ। আজ বহুবছর পর তার আরেক অভাবী ভাই জাহাজের কন্টেইনারে বন্দি অবস্থায় মারা পড়লো। অর্ধমৃত দ্বীন ইসলাম নয়দিনের ভুতুড়ে অন্ধকারে মরতে মরতে বেঁচে গেল।
আমার লেখা এখানেই শেষ। হায় আমেরিকা, হায় মধ্যপ্রাচ্য, হায় পরবাস! তোমরাই এই আশাহীন দেশের আশা, হৃদয়হীন শরীরের হৎপিণ্ড, জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্রের সাদাছড়ি।
ডেনমার্ক ফেরত তরুন, আমেরিকা প্রবাসী তরুনী কিংবা দ্বীন ইসলাম- এরা কারা? এরা কোন বাংলাদেশের জন্য পরবাসের ঘুম হারাম করে? হাগু পরিষ্কার করে? কোন দেশের জন্য বাড়ায় রেমিটেন্সের প্রবাহ? যদি বাংলাদেশের জন্য হয়, তবে সেই দেশের সংখ্যার গরিষ্ট অংশ হয়েও তারা এভাবে বেঘোরে মরে কেন? তাদের এসব মৃত্যু দুনিয়ার বুকে কোন বার্তা দিয়ে যাচ্ছে?
জাহাজের কন্টেইনার, উড়োজাহাজের চাকার খাপ, একটি নিশ্চিত চাকরি আর দুচোখ ভরা স্বপ্ন... অমীমাংসিত প্রশ্ন হয়ে এই শব্দগুলো মনের গহীনে মরণ কামড় দিয়ে যায়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।