Life is a Target.... Life is a Mission...
বিশ্বায়নের অন্যতম একটি মাধ্যম হলো টেলিভিশন বা স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল। আর এই টিভি মাধ্যমের আধেয়’র মধ্যে একটি বিশেষ জায়গা দখল করে আছে রিয়েলিটি টিভি শো। এসব টিভি শো’র মাধ্যমে বিনোদনের নামে চলে ব্র্যান্ডিং, করপোরেটবাজি, পণ্যকরণ ও ভোক্তা উৎপাদন। বাস্তবতাকে কেটে-ছিঁড়ে অমূলকভাবে করপোরেটীয় কায়দায় চলে বাস্তবতার পোস্টমর্টেম। এ যেন এক হাস্যকর মর্মান্তিক বাস্তবতার কৃত্রিম রূপায়ণের অবাস্তব চিত্রায়ন।
আর এভাবেই বিশ্বায়নের ধারাবাহিকতায় ক্রমশই অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে এ পৃথিবী, পৃথিবীর মানুষের মনন-মানসিকতা।
রিয়েলিটি শো হচ্ছে টেলিভিশনে প্রচারিত অনুষ্ঠানমালার অন্যতম একটি শাখা। যদিও আজকাল আমরা টেলিভিশনের ক্ষেত্রে এটা বেশি দেখে থাকি। তবে রিয়েলিটি শো’র যাত্রা শুরু হয়েছিলো রেডিওতে। এ ধরনের অনুষ্ঠানের জন্য আগে থেকে কোন পান্ডুলিপি তৈরি করা হয় না।
রসবোধ-জারিত এ আয়োজনে থাকে সাধারণ অডিয়েন্সের সাবলীল অংশগ্রহণ। বিষয়গুলো নির্বাচন করা হয় দৈনন্দিন জীবন থেকে। টেলিভিশনের শুরু থেকে পশ্চিমা বিশ্বে এ ধরনের অনুষ্ঠানের প্রচার ঘটে নানা প্রকারের ‘গেম শো’ হিসেবে। পরে পরিপক্কতা অর্জনের মাধ্যমে এটি আলাদা অনুষ্ঠান প্রকরণ হিসেবে স্বীকৃত হয়। উইকিপিডিয়ার হিসেবে প্রায় ৭০টি দেশে এ অনুষ্ঠান চলছে জনপ্রিয়তা ধরে রেখে।
বর্তমানে বাংলাদেশে টিভি চ্যানেলের সংখ্যা ১২টি । আর এর প্রায় সবগুলো চ্যানেলেই প্রাইমটাইমে প্রচারিত হচ্ছে রিয়েলিটি শো । আজ থেকে ৫/৭ বছর আগেও আমাদের দেশের চ্যানেলগুলোতে রিয়েলিটি শোর প্রচার ছিল না বললেই চলে। কিন্তু বর্তমানে রিয়েলিটি শো বিস্তার করছে মাকড়সার জালের মতো । বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোতে যে রিয়েলিটি শোগুলো প্রচারিত হচ্ছে তার আধেয় কি মৌলিক, না কি ধার করা।
যদি ধার করা হয়ে থাকে তাহলে তার কারন কি বিশ্বায়ন?
১৯৪০ এর দশকে প্রথমে রিয়েলিটি শো’র প্রচলন শুরু হয়। প্রথম দিকে রিয়েলিটি শো’র ধরন ছিল নকশা জাতীয়। ঠাট্টা-তামাশার মাধ্যমে আনন্দ দান করাই ছিল রিয়েলিটি শো’র মূখ্য উদ্দেশ্য। ১৯৪৮ সালে প্রতিভা খোঁজার বিষয়টি রিয়েলিটি শো’র সাথে যুক্ত হয়। ‘Ted Mack’s Original Amateur Hour and Arthur Godfrey’s Talent Scouts’ নামে প্রতিভা খোঁজার বিষয়টি শুরু হয়।
১৯৫৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারে মত ‘মিস আমেরিকা’ সম্প্রচার শুরু করে । ঠিক এই সময়েই (১৯৫৪-৫৫) আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের কালভার সিটির পুলিশ সদস্যদের রাত্রিকালিন দায়িত্ব পালনের ওপর প্রচার করা হতো ‘নাইটওয়াচ’ শিরোনামে রিয়েলিটি শো। এটি তখন ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো। এর আগে ১৯৪৭ সালে অ্যালেন ফান্ট ‘ক্যানডিড মাইক্রোফোন‘ অনুষ্ঠানে সাফল্য অর্জনের পর চালু করেন ‘ক্যানডিড ক্যামেরা’।
অন্যদিকে, ১৯৬৪ সালে যুক্তরাজ্যে যেসব রিয়েলিটি শো চালু হয় তার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য ছিল ‘Granda Television’, সিরিজ ‘Seven Up’।
এসব রিয়েলিটি শো কিছুটা ভিন্ন মাত্রার ছিল। ৭-১২ বছর বয়সী ব্যক্তিরা এই শোতে অংশগ্রহণ করে এবং এটি ছিল সাক্ষাৎকারমূলক। পরবর্তীতে `The Dating Game', `The Newlywed Game', `The Gong Show’-ইত্যাদি রিয়েলিটি শো’র প্রচলন হয়।
১৯৮৯ সালে ১১ মার্চ আমেরিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় টিভি রিয়েলিটি শো হিসেবে সন্মাননা পায় COPS. যা এসেছিল ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারীতে প্রতিষ্ঠিত America’s Most Wanted থেকে। কিন্তু রিয়েলিটি শোর পূর্ণ বিকাশ ঘটে ২০০০ সালে।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘বিগ ব্রাদার’ ও ‘সার্ভাইভার’ এর জনপ্রিয়তা সারা বিশ্বে রিয়েলিটি শো প্রচারে গণমাধ্যমগুলোকে উদ্বুদ্ধ করে। ২০০১-০২ সালে ‘সার্ভাইভার’ এবং আমেরিকান আইডল ২০০৪-০৫ সালে থেকে শুরু হয়ে ২০০৯-১০ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এই সময়েই যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৫ সালে FOX রিয়েলিটি, ২০১০ সালে গ্লোবাল রিয়েলিটি চ্যানেল, ২০০২ সালে যুক্তরাজ্যে ‘জোন রিয়েলিটি’ সম্প্রচার শুরু হয়। ২০১০ এর মাঝামাঝিতে FOX রিয়েলিটি শো শেষ হলেও কানাডা ও যুক্তরাজ্যের শো এখনও চলছে।
২০০১ সালে রিয়েলিটি ‘গেম শো’র নতুন সংযোজন হিসেবে চালু করা হয় ‘এ্যামি আ্যওয়ার্ড’।
একাডেমী অব টেলিভিশন আর্টস্ এ্যান্ড সায়েন্সস এটি চালু করে। যেসব রিয়েলিটি প্রোগ্রাম জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছেছে সেসব প্রোগামকে বাছাই করে পুরস্কার প্রদান করা হয়।
বাংলাদেশে প্রচারিত রিয়েলিটি শো
১. ক্লোজআপ ওয়ান - তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ
২. চ্যানেল আই সেরা কন্ঠ
৩. মার্কস অলরাউন্ডার
৪. হরলিকস ফিউচার ফোর্স
৫. লাক্স-চ্যানেল আই সুপার স্টার
৬. ইউ গট দ্য লুক
৭. দ্য চ্যালেঞ্জ
৮. সুপার হিরো সুপার হিরোইন
৯. ক্যাম্পাস হিরো
১০. উত্তরাধিকার
১১. তিন চাকার তারকা
১২. লুমিক্স-ক্লিক টু ফেইম
১৩. কে হতে চাই কোটিপতি (আসছে)
১৪. প্রিমিয়ার ব্যাংক গর্ব
আজকের দিনে আধুনিকতার যুগে এসে বিশ্বায়ন নিয়ে আলোচনা একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র দখল করে আছে। বলতে গেলে ‘বিশ্বায়ন’ বিষয়টাই এখন একটা ভাবার বিষয়, জ্ঞানের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ যুগটাই তো বিশ্বায়নের।
আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটি অনন্য নাম বিশ্বায়ন। আর তাই বিশ্বায়ন এখন ভাবিয়ে তুলেছে বিশেষজ্ঞ, গবেষক, পন্ডিত, শিক্ষক, সুশীল সমাজ, শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষদের। এই বিশ্বায়ন নিয়ে ভাবনার মধ্যে একটি বিশেষ দিক হলো গণমাধ্যম ও সংস্কৃতি।
গণমাধ্যম বা মিডিয়া বলতে আমরা যা বুঝি, এই মিডিয়ার সাথেও বিশ্বায়নের সম্পর্ক গভীর। এ দুটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
একদিক থেকে বলা হয়, বিশ্বায়নের কল্যাণেই আমরা মিডিয়াকে পাচ্ছি। আবার অন্য আরেকদিক থেকে বলা হয়, আসলে মিডিয়াই এই বিশ্বায়নের বিষয়টাকে সামনে নিয়ে এসেছে। এখন আমরা কী বলব? মিডিয়া কি বিশ্বায়নকে ত্বরান্বিত করেছে না বিশ্বায়নই মিডিয়াকে নিয়ে এসেছে, নাকি দুটোই দুটোকে ত্বরান্বিত করছে। এসব বিষয় নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। এক্ষেত্রে দুটোই আমাদের বিবেচনায় আনতে হবে।
প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আসলে মিডিয়া ও বিশ্বায়ন একে অন্যের সাথে জড়িত। দুটোই এক অন্যকে ত্বরান্বিত করছে। মোটা দাগে বলা যায়, বিশ্বায়নকে ত্বরান্বিত করছে গ্লোবাল মিডিয়া। এক্ষেত্রে আমরা পশ্চিমা বিশ্বের প্রভাবশালী মিডিয়াগুলোর কথা ভাবতে পারি।
তবে যাই হোক, প্রযুক্তির অভাবনীয় উদ্ভাবনের ফলে ক্রমেই বেড়ে চলছে মিডিয়ার সংখ্যা, ব্যপ্তি ও সীমানা।
আর মিডিয়া ভাসছে নাটক, গান, সিনেমা, বিজ্ঞাপন, সংবাদ, টকশো, রিয়েলিটি শো’সহ নানা ধরনের রংবাহারি, চাকচিক্যময় অনুষ্ঠানের জোয়ারে। চ্যানেলগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা লেগে যায়- কার আগে কে দর্শকপ্রিয়তা পাবে, কার অনুষ্ঠান দর্শক-সাধারণ বেশি খাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এজন্যই দর্শকের কথা ভেবে চ্যানেলগুলো ও অনুষ্ঠান নির্মাতারা ঝুঁকছে বিনোদনের দিকে। সেই সাথে ঝুঁকছে দর্শকরাও। তাছাড়া বিজ্ঞাপনদাতাদের চাপ, করপোরেটবাজদের ফরমায়েশ তো আছেই।
টিভি চ্যানেলগুলো জানে যে তাদের টিকে থাকতে হলে প্রতিযোগিতা করতে হবে। ব্যবসায়িক স্বার্থ ও লাভের লোভ ছেয়ে বসেছে মিডিয়াকে। মিডিয়া আর করপোরেট এখন মাসতুতো ভাই। মিডিয়া-করপোরেট আঁতাত, ব্যবসায়িক স্বার্থ ও মুনাফা, বিজ্ঞাপন, তীব্র প্রতিযোগিতার যুগে মূলধারার মিডিয়াগুলো এখন মানের দিকে না তাকিয়ে তাকাচ্ছে ছাঁইপাশযুক্ত, সস্তা, চাকচিক্যময় ও আনাড়ি অনুষ্ঠানের দিকে। এসব অসুস্থ প্রতিযোগিতার ভিড়ে কেউ টিকছে আর কেউ হারিয়েও যাচ্ছে।
আর এরই ধারাবাহিকতায় আমরা দেখছি মিডিয়াগুলোর বৈচিত্র্যহীন আধেয়। সবগুলো মিডিয়াতে একই বিষয় বারবার, ঘুরে-ফিরে চলে আসছে। যদিও এগুলোর মধ্যে নামেমাত্র পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। তেমনি একটা মিডিয়া-আধেয় হলো রিয়েলিটি শো। এখানে তাই বিশ্বায়ন ও রিয়েলিটি শো’র মধ্যে সম্পর্কটা আলোচনা করা হচ্ছে।
সেই সাথে থাকছে রিয়েলিটি শো’গুলো কেন্দ্র করে বাংলাদেশের মিডিয়াগুলোর অবস্থান।
তথ্য-প্রযুক্তির প্রচার-প্রসারের এই যুগে আমরা যখনই টিভি-সেটের সামনে বসছি তখনই সহজে দেখতে পাই বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন চ্যানেল। এসব চ্যানেল ঘুরালেই থাকছে ভিন্ন অনুষ্ঠানমালা। শত শত চ্যানেলর ভিড়ে শত শত অনুষ্ঠান। এটাও কিন্তু একটা বিশ্বায়ন।
যুগটা বিশ্বায়নের আর মিডিয়ার। আর মিডিয়াটা হচ্ছে রিয়েলিটি শো’র। স্যাটেলাইট টিভির কারণে আমরা পরিচিত হয়েছি ‘আমেরিকান আইডল’, ‘বিগ ব্রাদার’, ‘মাস্টার শেফ অব অস্ট্রেলিয়া’র সাথে। আর সেই সাথে এসব রিয়েলিটি শো’র প্রভাবে প্রভাবিত হচ্ছে আমাদের স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো। আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি ‘ক্লোজ-আপ ওয়ান: তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ’, ‘চ্যানেল আই লাক্স সুপার স্টার’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
যা আর কিছু নয়, বিশ্বায়নের ফলাফল। ‘আমেরিকান আইডল’ থেকে চীন বানালো ‘চাইনিজ আইডল’। তারপর ভারত বানালো ‘ইন্ডিয়ান আইডল’। এরপর আমাদের দেশে তৈরি হলো ‘ক্লোজ-আপ ওয়ান: তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ’। এভাবেই ঘটলো রিয়েলিটি শো’র বিশ্বায়ন।
এটাকে আমরা বিশ্বায়নের কালচারাল রেজাল্ট বা সাংস্কৃতিক ফলাফল হিসেবে।
বর্তমান সময়ে বিশ্বায়ন ও রিয়েলিটি শো মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। আমাদের প্রজন্ম যে কতটা বিশ্বায়ন প্রভাবিত তা দেখা যায় যখন আমরা টেলিভিশনের সময় দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হই। ক্লোজ-আপ ওয়ান কিংবা লাক্স চ্যানেল আই সুপার স্টার দেখার জন্য তড়িঘড়ি করে কোনোমতে কাজ শেষ করে বা শেষ না করেই টিভির সামনে বসে পড়ি। ফলে দেখা যাচ্ছে, টিভিই নিয়ন্ত্রণ করছে আমাদেরকে, আমাদের কাজকে, আমাদের জীবনকে।
এক বিশাল পরিবর্তন এনে দিচ্ছে আমাদের জীবনে, বদলে দিচ্ছে আমাদের জীবন-প্রণালী।
বিশ্বায়ন গিলে খাচ্ছে আমাদেরকে, সমাজকে। সাথে সাথে গিলে খাচ্ছে মিডিয়াকে, মিডিয়ার আধেয়কে। আর রিয়েলিটি শো তো মিডিয়ারই একটি আধেয়, একটি প্রচারনার ধরন বা জনপ্রিয়তার কূটকৌশল। এ যেন বড় দানবের ভিতরে অবস্থান নেয়া আরেকটি ছোট দানব।
বিশ্বায়ন ও রিয়েলিটি শো আলোচনায় বিশ্বায়ন যে রিয়েলিটি শো’কে গিলে খাচ্ছে তার কয়েকটি উদাহরণ নিচে দেয়া হলো।
রিয়েলিটি শো’র ক্ষেত্রে পথিকৃৎ ‘বিগ ব্রাদার’। ১৯৯৯ সালে এ অনুষ্ঠানটি প্রথম শুরু করে নেদারল্যান্ডসের ভেরোনিকা টিভি চ্যানেল। তারপর অল্পদিনের মধ্যেই জনপ্রিয়তা পেতে থাকে এ অনুষ্ঠানটি। ফলে অন্যান্য টিভি চ্যানেলগুলোতে এটা ছড়িয়ে পড়ে।
ঠিক এই অনুষ্ঠানের অনুকরণ করে একই ফরম্যাট, একই ধাঁচ ও একই আদলে বিভিন্ন দেশের মিডিয়াগুলোও ভিন্ন নামে তৈরি করে চলছে বিগ ব্রাদার। সেই সাথে থাকছে নিজ নিজ দেশের বাস্তবতার সম্মিলন। দৈনন্দিন জীবনের অনেক কিছুই কাঁট-ছাট (এডিট) করে দেখায় আমেরিকান চ্যানেল। অন্যদিকে ইউরোপের কিছু কিছু দেশ একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়গুলো সহসাই টেনে আনছে নির্দ্বিধায়।
অবাক হওয়ার বিষয়, ‘আমেরিকান আইডল’-এর বিচারক পলা আবদুল কিংবা ভারতীয় জনপ্রিয় রিয়েলিটি শো ‘বুগি-উগি’র বিচারক জাভেদ জাফরিকে অন্ধভাবে অনুকরণ করতে দেখা যাচ্ছে আমাদের দেশীয় রিয়েলিটি শো’র বিচারকদের।
বিচারক হলেই আমাকে অবদান রাখতে হবে, সেটা গলা ছেড়েই হোক আর নেচে-কুঁদেই হোক। ঠিক একই রকম ঘটনা ঘটছে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন রাজ্যে। বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের সত্তরটি দেশে প্রচারিত হচ্ছে অসংখ্য রিয়েলিটি শো। যেগুলোর ফরম্যাট, ধরন, উপস্থাপনা, পোশাক-সাজগোঁজ, বিচারকদের আচার-আচরণ, উপস্থাপনা, ভঙ্গিমা, বিচারপদ্ধতি- সবই একই ধরনের। তাছাড়া উপস্থাপকের বাহারি সাজ, আচরণ তো থাকছেই।
সেই সাথে আছে দুই মিনিট পর পর বিজ্ঞাপন-বিরতি, স্পন্সরদের নাম বলে বলে মুখে ফেনা তোলা। সবকিছু যে একেবারে কেমন জানি মিলে যাচ্ছে! কারণ আর কিছু নয়, বিশ্বায়ন।
আজকের দিনে ‘চ্যানেল আই সেরা কণ্ঠ’, ‘ক্লোজ-আপ ওয়ান- তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ’, ‘খুঁদে গানরাজ’, ‘তিন চাকার তারকা’, ‘লাক্স- চ্যানেল আই সুপার স্টার’, ‘সুপার হিরো সুপার হিরোইন’ কিংবা ‘দ্য চ্যালেঞ্জ’, ‘ইউ গট দ্য লুক’সহ ইত্যাদি নানা ধরনের রিয়েলিটি শো’র মধ্য দিয়ে দেখা যায়, মিডিয়া হঠাৎ করেই একজনকে স্টার বানিয়ে দিচ্ছে। কয়েকটা মুখস্থ করা গান গলা ছেড়ে গেয়ে কিংবা স্টেজে খানিকটা পারফর্ম করেই স্টারের খ্যাতি পাচ্ছেন প্রতিযোগিরা। তারপর দেশ-বিদেশের নানা স্টেজে পারফর্ম করে, দু’একটা গানের অ্যালবাম করেই দ্রুত বনে যাওয়া স্টারেরা হঠাৎ করেই যেন হারিয়ে যান কালের গর্ভে।
এর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো নোলক বাবু। আবার অনেকেই জড়িয়ে যায় নানা ধরনের কেলেঙ্কারিতে। কারণ এসব শো’র মাধ্যমে যারা উঠে আসছে তারা সাধারণতই অল্পশিক্ষিত থাকে। এরা গানের কথার অর্থ, মমার্থ না বুঝেই গান করে থাকে। যেমন- সালমা যখন ‘তুমি দিওনা গো বাসর ঘরের বাত্তি নিভাইয়্যা’- এই গানটি করে এবং এটি বাজারে আসার পর ব্যাপক সমালোচিত হয়।
ফলে কিছুদিনের জন্য সালমাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু পরিণতি কি এরকমই হওয়ার কথা ছিলো? অবশ্যই না। এদেরকে সাধনার সময় দেয়া হয়নি, পরিপক্ক হবার সুযোগ দেয়া হয়নি। সময় দেয়া হয়নি, সুযোগ করে দেয়া হয়নি পরিপূর্ণভাবে বেড়ে ওঠার। দেয়নি কারা? বিশ্বায়নের নিয়ন্ত্রণকর্তারা, করপোরেটবাজরা, বিজ্ঞাপনদাতারা কিংবা রিয়েলিটি শো’গুলোর মালিক-নির্মাতা, হর্তাকর্তারা।
অথচ তারা ঠিকই তাদের বানানো স্টারদের চেহারা ও সামজিক অবস্থাকে পুঁজি করে ব্যবসায়িক স্বার্থ, লাভ বা মূনাফা হাতিয়ে নিয়েছে। আর এভাবেই চলছে করপোরেটবাজদের দাপট।
এ তো গেল বাংলাদেশের কথা। এখন আমরা যদি বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই ব্রিটেনের জনপ্রিয় রিয়েলিটি শো ‘বিগ ব্রাদার’-এর মাধ্যমে উঠে আসা একজন স্টার হলেন জেড গুডি। গুডি ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন।
তার ইচ্ছা ছিলো ক্যামেরার সামনে তিনি মারা যাবেন। ‘বিগ ব্রাদার’ শেষ হয়ে যায়, কিন্তু জেড গুডির মৃত্যু নিয়ে জনমনে দেখা দেয় নানা জল্পনা-কল্পনা। এভাবে দেখা যায়, মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার তথা মৃত্যুকে নিয়ে মিডিয়াতে হৈ চৈ করা হচ্ছে। কেমন যেন অদ্ভূত সব ব্যাপার।
রিয়েলিটি শো বলুন, বিজ্ঞাপন, নাটক আর যা-ই বলুন না কেন সব জায়গাতেই দেখানো হয় নারীকে একটা পণ্যরূপে, হেঁশেলের কর্ত্রী হিসেবে।
রেজার-শেভিং লোশন বা ক্রিম থেকে শুরু করে ব্লেড, বডি-লোশন, স্প্রে, গাড়িসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্যে নারীকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সেই সাথে শিশুদেরকেও। এভাবে নারী ও শিশুর পণ্যায়ন, যার আরেক নাম বিশ্বায়ন!!! এভাবেই ব্যক্তিসত্তা বিক্রি হয়ে যাচ্ছে মিডিয়ার কাছে, করপোরেটদের কাছে, তাদের পণ্যের কাছে, লাভ, মুনাফা, পুঁজির কাছে, ব্যবসায়িক স্বার্থের কাছে। এটা হচ্ছে প্রতিনিয়তই, প্রতিদিন, প্রতিমুহুর্তে। এছাড়া এই অপব্যবহার চলে পুরুষের অন্তর্বাসকেও কেন্দ্র করে।
দেখা যায়, সিরিয়াস বিষয়গুলোতেও কীভাবে যেন রমণীর কমনীয়তা চলে আসে। নারী, শিশু কিংবা বৃদ্ধা নয়, বয়সটা যেন ওঠানামা করে বিশ থেকে চল্লিশের মাঝে। অর্থাৎ বিশ্বায়ন পুঁজি করছে তারুণ্যকে। রিয়্যালিটি শো’গুলোতে দেখা যায় যৈবতী কণ্যার স্নো, পাউডার, লিপস্টিক, বৃদ্ধার জরা নয়।
রিয়েলিটি শো যে মানুষের আবেগকে কত কৌশলে পুঁজি করে ব্যবসা করছে তার ইয়ত্তা নেই।
রিয়েলিটি শো’গুলোর মাধ্যমে এর হর্তাকর্তরা যেমন ফুলে-ফেঁপে উঠেছে, তেমনি ফুলে উঠেছে মোবাইল কোম্পানিগুলোও। এতে প্রতিযোগিদের পক্ষে মোবাইলে এসএমএস (শর্ট মেসেজ সার্ভিস) পাঠানোর জন্য তাদের আর্তি-অনুরোধ শুনলেই আমরা বুঝতে পারি যে, বিশ্বায়ন পুরোপুরিভাবে গ্রাস করেছে কোমলমতি মন, মনন ও চিন্তাধারাকে। সেটা হচ্ছে কখনও গোচরে কখনো বা অগোচরে। তাই দেখা যায় যে, বিশ্বায়ন প্রভাবে টিভি মিডিয়া তার আধেয় রিয়েলিটি শো’র মাধ্যমে ব্যক্তিকে ভাবতে শিখায় ‘রিয়েলিটি’ চিন্তাধারায়। যেখানে নেই কোনো স্বকীয়তা বা আত্ম-মর্যাদা।
বিশ্বায়নের ধারাবাহিকতায় রিয়েলিটি শো ব্যক্তিমানসে এতটাই প্রভাব ফেলেছে যে আজকের তরুণ-তরুণীরা শহরের উঁচু বিলবোর্ডে নিজেদের ছবি দেখতে যেকোনো কিছু করতে প্রস্তত। তবে সামগ্রিকভাবে এই কথাটা বলা সমীচীন নয়।
গ্লোবালাইজেশন বা বিশ্বায়নের প্রথম ও প্রাথমিক শর্ত হলো Freeness। এখানে Freeness বলতে মূলত বোঝানো হয়েছে অবাঁধ বাণিজ্য বা Free Trade and Commerce। এখানে সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ থাকবে না, শুল্ক থাকবে না, থাকবে না কোনো বর্ডার।
সবকিছু থাকবে উদার। বিশ্বায়নের প্রধান বৈশিষ্ঠ্য হলো প্রাইভেটাইজেশন। অর্থাৎ শুধু রাষ্ট্রায়ত্ব মালিকানাই থাকবে না সেই সাথে থাকবে ব্যক্তি মালিকানা। তাই দেখা যাচ্ছে যে, বিশ্বায়নের কথা হলো ব্যক্তিগত স্বার্থকে বাধাগ্রস্থ করা যাবে না, খোলা বাজার অর্থনীতি করতে হবে। আর বিশ্বায়নের এই ব্যাপারটিকে নিয়ে আসছে পশ্চিমারা।
পশ্বিমারা এই কাজটি করছে গ্লোবাল মিডিয়ার মাধ্যমে। সার্বিকভাবে এরা মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রন করছে। সেই সাথে নিয়ন্ত্রন করছে মিডিয়ার আধেয়। তাই দেখা যায় যে, বিশ্বায়নের সাথে মিডিয়ার ও মিডিয়ার আধেয়ের একটা গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান।
রিয়েলিটি শো যেহেতু বর্তমান মিডিয়াগুলোর একটি অন্যতম প্রধান আধেয় তাই আমরা এখানেও দেখতে পাই পুঁজিপতি, করপোরেট তথা বিজ্ঞাপনদাতাদের একক আধিপত্য।
মিডিয়াগুলোও এই পুঁজিপতিদের পক্ষ হয়ে কাজ করছে। কারণ বিশ্বায়নের সাথে পাল্লা দিয়ে যুগের সাথে তাল মিলাতে গিয়ে, পশ্চিমাদের সাথে প্রতিযোগিতা করতে গিয়েই আমরা নিজেরাই নিজেদের অজান্তেই এর মায়াজালে আবদ্ধ হচ্ছি। কিন্তু আমরা সহসাই ভুলে যাই আমার নিজস্ব সংস্কৃতির কথা, নিজ দেশের কথা। বারবারই অন্ধভাবে অনুকরণ করে যাচ্ছি পাশ্চাত্যকে। ‘ক্যাপিটালিজম’-এর যুগে মিডিয়া ও পুঁজিবাদ দুটো সরলরেখা, যে রেখাদ্বয় সমান্তরালভাবে অবস্থিত।
একদিকে করপোরেট মিডিয়াকে দিচ্ছে অর্থ বা টাকা (লাভ)। অন্যদিকে, মিডিয়া করপোরেটদের দিচ্ছে প্রচার-প্রচারণার সুযোগ। ফলে মিডিয়ার গেট-আপ, উপস্থাপনা ও আধেয়তে আসছে বিশাল পরিবর্তন। বিজ্ঞাপনের দাপট আর করপোরেট মাতব্বরিতে ছেয়ে গেছে মিডিয়া। মিডিয়ার মালিক ও করপোরেটদের চলছে গোপন আঁতাত।
মিডিয়া এখন আর সাধারণ জনসাধারণের কথা ভেবে কাজ করেনা। মিডিয়া ভাবে করপোরেটদের কথা, তাদের স্বার্থ আর ব্যবসায়িক লাভের কথা। আর তাই এখন অনেকেই করপোরেট ও মিডিয়াকে এক করে বলেন, করপোরেট-মিডিয়া। এবার নিচের কতগুলো বিষয়ের দিকে নজর দিলেই আমাদের আর বুঝতে বাকি থাকবে না যে, মিডিয়ার তৈরি রিয়্যালিটি শো কিভাবে দখল করে নিয়েছে ব্যবসায়িক স্বার্থপুষ্ট গোষ্ঠীরা।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের সত্তরটি দেশে এখন বেশ দাপটের সাথে চলছে নানা ধরনের রিয়েলিটি শো।
এগুলোর মধ্যে প্রায় সবগুলোরই ফরম্যাট এক। এগুলোর মধ্যে উপস্থাপক, বিচারক থেকে শুরু করে প্রতিযোগিদের পোশাক-আশাক, গহনা, সাজ-গোঁজসহ অন্যান্য কাজের স্পন্সর হয় নানা কোম্পানি। এসবের জন্য স্পন্সরের অভাব হয় না। অথচ গরিব, সাধারণ মানুষের কষ্টের অন্ত নেই। গরিব বাবা-মায়ের মেধাবী ছেলে কিংবা মেয়েটির লেখাপড়ার খরচ চালানোর স্পন্সরশীপ কেউ হয়না।
তার কারণ এখানে ব্রান্ডিং নেই। ব্রান্ডিং আছে ব্যবসায়, প্রচার-প্রচারণায়, মিডিয়াতে, রিয়েলিটি শো’তে। এখানে নাচে, গানে, চলনে-বলনে সবকিছুতেই রয়েছে ব্রান্ডিং। আর এই ব্রান্ডিংটাই চায় বিজ্ঞাপনদাতারা, করপোরেট-ব্যবসায়িকরা। অবাক হবার কথাই, যখন দেখা যায় রিয়েলিটি শো’র উপস্থাপক/উপস্থাপিকা নিজেই বলছেন যে, ‘আমার পোশাকের স্পন্সর করেছে অমুক কোম্পানি’, ‘আমার মেক-আপ করেছে পারসোনা’।
শুধু তাই নয়, দর্শকদের পুরস্কার দেয়ার ঘোষণা করে বলা হয়, ‘উপহার হিসেবে আপনারা পাচ্ছেন অমুক কোম্পানির গিফট হেম্পার’। এছাড়াও পর্দার নিচে গ্রাফিক্স ডিজাইন করে লেখা থাকে স্পন্সরদের নাম। আর স্পন্সরদের নাম বারবার বলতে গিয়ে মুখে ফেনা তোলা তো আছেই। আর এসবই বিশ্বায়নের লীলা। এভাবেই মিডিয়াকে, মিডিয়ার রিয়েলিটি শো’গুলোকে পুঁজি করে বিশ্বায়নের হর্তাকর্তারা এগিয়ে যাচ্ছে।
আজকের দিনে আমাদের টিভি চ্যানেলগুলোর মূল কাজই হলো আইডল বা ফটো সুন্দরীর নামে ব্যবসার বিশাল মসৃণ পথ তৈরি করা। এখন একটি এসএমএস-ই ঠিক করে দিচ্ছে কার মেধা কেমন, কতটুকু। যার যত বেশি এসএমএস সে-ই চূড়ান্ত বিজয়ী। বিচারের একি অভিনব কায়দা! তাই দেখা যাচ্ছে যে, মেধা নির্বাচনেও রয়েছে মোবাইল কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক স্বার্থ অর্থাৎ লাভ।
বিজ্ঞাপনদাতারা তাদের লক্ষ্য পূরণের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে রিয়েলিটি শো’গুলোকে।
তার এর মধ্য দিয়ে ভোক্তাদের মধ্যে করপোরেট চরিত্র গড়ে তুলতে চায়, গড়ে তুলতে সমৃদ্ধ ভোক্তাশ্রেণী। নারীর বিলাসবহুল সাজ দিয়ে সাজিয়ে নারীকে করে তোলা হচ্ছে ভোগবাদী। শুধু নারীকেই নয়, পুরুষ, ছেলে, মেয়ে, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ, শিশুসহ সবাইকেই এদিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। নারীদের জন্য আজকে করা হচ্ছে ইজি শো। সনি টিভির ‘লেডিস স্পেশাল’-এর আদলে আমোদের দেশীয় চ্যানেল এনটিভি প্রচার করে ‘মেরিল বিভাইন বিজিদের ইজি শো’।
এখানে নারীর সাজ, ভোগবিলাস উপস্থাপনা ও করপোরেটীয় প্রশ্নের উত্তর- সবকিছুই উদ্দেশ্য প্রণোদিত। বিজ্ঞাপনদাতাদের জন্য সবচাইতে লাভজনক অনুষ্ঠান হিসেবে এটিএন বানলো ‘তারকা-তারকাদের তারকা’, চ্যানেল আই বানালো ‘সেরা কণ্ঠ’। এত দেখা যায় প্রতিযোগিরা স্পন্সরদের দেয়া টি-শার্ট পড়ে স্টেজে উঠে পারফর্ম করছেন। এভাবেই হচ্ছে পণ্যের প্রচার। আর এর সুযোগটা নিচ্ছে দেশি- বিদেশি নানা ধরনের মাল্টিন্যাশনাল কোস্পানিগুলো।
মিডিয়ার যেমন রাজনৈতিক অর্থনীতি আছে, তেমনি রিয়েলিটি শো’রও একটা রাজনৈতিক অর্থনীতি রয়েছে। আমরা আজকের দিনে রিয়েলিটি শো’গুলোতে দেখতে পাই বিজ্ঞাপনের বিশাল চাপ ও স্পন্সরদের আধিপত্য। বিভিন্ন কোম্পানি তাদের পণ্যের বাজার তৈরি করার জন্য এজেন্ডা সেট করে। আর এই এজেন্ডাতে রিয়েলিটি শো’গুলোকে ব্যবহার করা হচ্ছে প্রচারণামূলক অভিযানের হাতিয়ার হিসেবে। আর মিডিয়াও সানন্দে করপোরেটদের লাভের অংশীদার হচ্ছে, লুফে নিচ্ছে ব্যবসায়িক স্বার্থ।
সমালোচনাত্বক রাজনৈতিক অর্থনীতির অন্যতম দু’জন গবেষক পিটার গোল্ডিং ও গ্রাহাম মারডক মিডিয়া তথা সংস্কৃতির রাজনৈতিক অর্থনীতির কেন্দ্রভূমিতে চারটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার কথা বলেছেন- মিডিয়ার বৃদ্ধি, কর্পোরেট সম্পর্কের বর্ধন, পণ্যকরণ এবং রাষ্ট্র ও সরকারি হস্তক্ষেপের পরিবর্তনশীল ভূমিকা (গোল্ডিং ও মারডক, ২০০০: ৭৪)। তেমনি রিয়েলিটি শো’র ক্ষেত্রে আমরা ‘কর্পোরেট সম্পর্কের বর্ধন’ ও ‘পণ্যকরণ’-এ দুটোর প্রভাব দেখতে পাই।
মিডিয়ার রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অর্থনীতি ধারায় উল্লেখযোগ্য একজন হলেন ডালাস স্মাইদ যার বক্তব্যও আজকের রিয়েলিটি শো’গুলোর সাথে যায়। তিনি বলেন, টেলিভিশন-ইন্ডাস্ট্রির একজন বিশ্লেষক প্রথম এবং সবচেয়ে বড় যে গুরুতর ভুলটি করেন তা হলো তারা ধারণা করতে পারেন, অনুষ্ঠান সম্প্রচার করার ব্যবসাই বুঝি বিজ্ঞাপন-নির্ভর টিভি সম্প্রচারকর্তাদের আরাধ্য। আদতে তা নয়।
সম্প্রচারকারীদের মূল ব্যবসা হলো অডিয়েন্স উৎপাদন করা। দর্শকদের কাছে পৌঁছানোর রাস্তা করে দিয়ে, সেই দর্শদের বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে বিক্রি করে দেওয়াটাই হলো ব্যবসা (ওয়েন ও ওয়াইল্ডম্যান, ১৯৯২;৩; উদ্বৃত গ্যান্ডি, ২০০০: ৪৮)।
এখন প্রশ্ন ওঠে, রিয়েলিটি শো’গুলো কি আসলেই বাস্তবসম্মত বা বাস্তবের সাথে যায় কিনা?? থিওডর এর্ডোনো এবং হর্কহেমারের লেখা ‘দি কালচারাল ইন্ডাস্ট্রি: এনলাইটেনমেন্ট এজ ম্যাস ডিসিপশন’ গ্রন্থে যা বলেছেন, তাঁদের মতো করে আমরাও যদি মিডিয়াকে কালচারাল ইন্ডাস্ট্রি ধরি তাহলেই বুঝা যাবে যে, এই ইন্ডাস্ট্রি আসলেই রিয়েলিটি শো’র মাধ্যমে যা দেখায় তা আসলেই অস্তিত্বের প্রকৃত অবস্থা উপস্থাপনের ক্ষমতা হারিয়েছে। (উদ্বৃতি গায়েন, ১৯৯৭)।
বিশিষ্ট রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ রবার্ট ম্যাকচেজনির বক্তব্য এ প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য।
তিনি বলেন, ‘অধিকন্তু রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদরা মিডিয়া জনসেবার নামে কিভাবে খেলাধূলা, রাজনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জনমত, শপিং, সেলিব্রেটিদের সাক্ষাৎকার ইত্যাদি বিষয় প্রচারের মোড়কে বিজ্ঞাপন ও বাণিজ্যিকীকরণের মতাদর্শ-ভাবাদর্শের প্রচার ঘটায় তার মানচিত্র হাজির করেন’ (ম্যাকচেজনি, ২০০১; ৬)। তাঁর এ বক্তবব্যের মধ্য দিয়ে সরাসরি না হোক, ইঙ্গিতের মাধ্যমে আমাদের আর বুঝতে বাকি থাকেনা যে, সয়ংক্রিয়ভাবে রিয়েলিটি শো’ও এর আওতার মধ্যে এসে পড়েছে। এভাবেই রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ সমালোচনার দৃষ্টিভঙ্গিতে গভীর সূক্ষ্মতার সাথেই মিডিয়াকে, মিডিয়ার আধেয়কে বিশ্লেষণ করেছেন। তবে এর বিপরীতে অনেক মতবাদও আছে। তবে এখানে একটি কথা উল্লেখযোগ্য যে, সমালোচনাত্বক রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদগণ মার্কসের ধারা অনুসরণ করে মিডিয়া, মিডিয়ার আধেয় বিষয়ে মিডিয়ার সাথে সাথে কর্পোরেটেদের, পুঁজিবাদের কঠোর সমালোচনা করেছেন।
অনেকেই এটাকে একপেশে বলছেন।
রিয়েলিটি শো আসলে পরিণত হয়েছে গ্লোবাল প্রোডাক্টে। যার ভোক্তা হচ্ছি আমরা। বিশ্বায়নের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে বিশ্বদরবারে আমরা হয়ে পড়ছি শুধু গ্রহীতা। অনুষ্ঠান নির্মাণে আমাদের মৌলিকত্ব বলতে কিছু থাকছেনা।
এগিয়ে যেতে গিয়ে আমরা পেছনে ফেলে আসছি আমাদের সংস্কৃতি,ভাষা,নিজস্বতা। আমরা রিয়েলিটি শো-এর বিপক্ষে নই,আমরা বিশ্বায়নের ও বিপক্ষে নই। কারণ বিশ্বায়ন থেকে বের হয়ে বর্তমান যুগে জীবন-যাপন করা মুশকিল। কারণ আমরা যখন বিশ্বকে উপেক্ষা করবো তখন তারা আমাদের একঘরে করে রাখবে। বিশ্বায়ন কে উপেক্ষা করে হয়তো চীন, রাশিয়া, জাপান এবং কিছু ক্ষেত্রে চলতে পারে ভারত।
কিন্তু আমাদের মতো দেশের পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা এও বলছি না যে রিয়েলিটি শো নির্মাণ করা যাবেনা। আমরা বলতে চাই যে নির্মাতাদেরকে অনুকরণের এই বলয় থেকে বেরিয়ে এসে, নিজস্ব মৌলিকতা বজায় রেখে, বাস্তবতার আলোকে রিয়েলিটি শো নির্মাণ করা উচিত।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।