Quazi Hassan’ World of Writings
সালটা ১৯৬২। ঢাকা স্টেডিয়ামে প্রথম ডিভিশানের ফুটবল খেলা। খেলছে ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং আর নারায়নগঞ্জের ঢাকেশ্বরী কটন মিল দল। মোহামেডান দলের জয়টা দরকার। শুধু পয়েন্টের জন্যে না।
এর সাথে সম্মানের প্রশ্ন জড়িত। ঢাকার বাইরের দল কটন মিল, প্রথম বছর তারা খেলেছে ঢাকায়। অখ্যাত নাম না জানা নতুন খেলোয়ারদের দিয়ে গড়া দলকে এখনো কেউ হারাতে পারে নি। বরং তারাই বেশ কিছু দলকে হারিয়েছে। সে জন্য চ্যাম্পপিওন দল মোহামেডান খেলার আগেই শপথ নিয়ে নেমেছে যে কোনো মূল্যে এ দলকে হারাতে হবে।
কিন্তু কি দুর্ভাগ্য। কটন মিল খেলা শুরু হওয়ার ঠিক তিন মিনিটের মাথায় একটা গোল দিয়ে দিল। লেফট আউট বাহাদুর গোলের সুযোগ করে দিল নুরুকে। সহজেই গোল হয়ে গেল। গোলরক্ষকের কিছুই করার ছিল না।
প্রচন্ড স্নায়ু চাপের মধ্যে পড়ল গফুর, সালাম, রহমানের মত মোহামেডানের সব তারকা খেলোয়াররা।
রক্ষনাত্মক খেলতে থাকলো মোহামেডান। তারা তছনছ হতে থাকলো। বাহাদুর বারে বারে গোলের সুযোগ তৈরী করতে থাকলো। মোহামেডানের কোচ তিন জন খেলোয়ারকে দায়িত্ব দিলেন বাহাদুরকে গার্ড দেয়ার জন্যে।
কিন্তু তার পরেও মাঠের সব খানেই যেন তার অবস্থান। তিরিশ মিনিটের মধ্যে আরেকটা গোল। জামান থেকে বল আবার বাহাদুরের পায়ে। গোলরক্ষকের মাথার উপর দিয়ে বল চলে গেল।
নারায়ানগঞ্জের বাহাদুর রীতি মত বিখ্যাত হয়ে গেল দেশ ব্যাপী।
পত্র পত্রিকায় তার ছবি, নাম আর ইন্টারভিউ ছাপা হলো। মানুষের মুখে মুখে তার খেলা নিয়ে কথা চলতে থাকলো। বাঙ্গালীরা মহা খুশী। সামাদের পরে এই বুঝি একজন খেলোয়ার আসলো যে বাঙালী জাতির নাম রাখবে।
বাহাদুর যেখানেই যায় মানুষ অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে।
কেও শুধু কথা বলতে চায়, কেও তার খেলার অভিজ্ঞতা জানতে চায়। আবার অনেকে বাড়িতে দাওয়াত দেয়, কিংবা রেস্টুরেন্টে নিয়ে একসাথে বসে গল্প করতে চায়। একেবারে তারকা খ্যাতি যাকে বলে। সাথে সাথে টাকা পয়সা মোটামুটি আসতে থাকলো। মাত্র ইন্টারমিডিয়েট পাস করা বাহাদুরকে, ফুটবল খেলোয়ার হিসেবে ঢাকেশ্বরী কটন মিল পারমানেন্ট চাকরি দিয়ে দেয়।
জীবনের সব প্রাপ্তি যেন ছোয়া হয়।
২
বাহাদুর নামে পরিচিত হলেও, তার বাসায় দেয়া নাম বিমল সাহা। হিন্দু পরিবারের ছেলে। নারায়ানগঞ্জে তাদেরকে সবাই চিনতো। ক্লাস নাইনে যখন ম্যাট্রিক পরীক্ষার রেজিসস্ট্রেশান হচ্ছিল, বজলুল সার বললেন, তুই তো বাহাদুরদের মত খুব ভালো ফুটবল খেলিস, গোল করিস , তাই তোর নাম দিয়ে দেই বাহাদুর সাহা।
আবার তিনিই হিসেব করে জন্ম তারিখও বসিয়ে দিলেন। আসলে স্কুল থেকেই বজলুল সারকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, সব ছেলেদের সারটিফিকেট নাম ঠিক করে দেয়া আর এমন ভাবে জন্ম তারিখ বের করা, যাতে ম্যাট্রিক পরীক্ষার সময় কারোর বয়স পনেরোর বেশী না হয়।
জন্ম আর বেড়ে উঠা দুই-ই তার ঢাকার অদূরে নারায়ানগঞ্জে। পলাশীর যুদ্ধের পর পরই, ১৭৬৬ সালে লক্ষী নারায়ন ঠাকুর নামের এক জন বিখ্যাত হিন্দু ধর্মীয় নেতা, ওই অঞ্চল , ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি থেকে ইজারা নেন। তিনি প্রচুর ভূমি, অর্থ দান করেছিলেন ভগবান নারায়নের পূজার খরচ যোগান দেয়ার জন্যে।
তার থেকেই জায়গাটার নাম হয়ে যায় নারায়ানগঞ্জ। বেশ বড় একটা হিন্দু বসতি গড়ে উঠে এই সুবাধে। যদিওবা, আশেপাশের অঞ্চলগুলিতে মুসলমানদের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। কিন্তু সংখ্যায় কম বেশি কোনো ব্যাপার ছিল না। সবারই ছিল সাধারণ একটা পরিচয়, ‘আমরা বাঙালী’।
মুসলমানরা নির্দ্ধিদায় চলে আসত হিন্দুদের সাথে পূজার আনন্দে ভাগিদার হতে। হিন্দুরা শরিক হতো রোজার মাসে ইফতারিতে আর ঈদের সময় একের বুকে আরেক জন বুক রেখে কোলাকুলি করত সাম্যের জয়গান গেতে গেতে।
১৯৪৭ সালে পাক ভারত ভাগাভাগির পরে কিছু সন্দেহের বীজ ঢুকে পড়ে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কে। কিছু হিন্দু নাগরিক চলে যায় ভারতে। কিন্তু তার পরেও কোনো সমস্যা ছিল না।
শীতলক্ষা নদীর তীরে হওয়াতে শিল্প নগরী নারায়নগঞ্জের সমৃদ্ধি অভ্যাহত থাকে পাকিস্তান হওয়ার পরেও। পরিচিতি পায় প্রাচ্যের ডানডী হিসেবে। চিত্তরঞ্জন কটন মিল, ঢাকেশ্বরী কটন মিল তো আগের থেকেই ছিল। তার সাথে যোগ হয় বড় বড় সব পাট কল। আদমজী পরিবার ১৯৫১ সালে প্রতিষ্টা করে পৃথিবীর সব চেয়ে বড় পাট কল, আদমজী জুট মিল।
দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে হাজার হাজার মানুষ আসে নারায়নগঞ্জের মিলগুলোতে কাজ করতে। অনান্যদের সাথে চাকরি পায় ভারত থেকে আসা প্রচুর উর্দু ভাষী মুসলমান মানুষ। এক পর্যায়ে শুধু আদমজী জুট মিলেই শ্রমিক সংখ্যা যেয়ে দাড়ায় ২৬,০০০ এর উপরে। বাইরে থেকে আসা শ্রমিকদের প্রভাব যেয়ে পড়ে নারায়নগঞ্জের আদি বাসীদের উপরে। শত বছরের সাম্প্রযদায়িক সম্পর্কের শক্ত কাঠের খুটিতে উঁই পোকার আক্রমণ আরম্ভ হয়।
৩
বাহাদুরের কাছের দু জন খুবই ঘনিষ্ট বন্ধু ছিল। জব্বার আর ইসমাইল। একেবারে ছোট বেলা থেকে তারা একসাথে বড় হয়েছে। একই পাড়ায় আর একই ক্লাসের হওয়াতে দিনের বেশির ভাগ সময় কাটতো একসাথে। তারা অনেকটা তিন পরিবারের সন্তানের হিসেবে অবাধে একে অপরের বাসায় আসা যাওয়া করত।
খাবার সময় যেখানে হতো সেই বাসাতেই তারা খেয়ে নিতো। অনেক সময়ে একই থালা থেকে ভাগ ভাগি করে খেয়েছে। অভিভাবকরা তিন জনকে অনেকটা সমান ভাবে স্নেহ করতো।
ফুটবল খেলার পারদর্শিতায় বাহাদুরের খাতির সবার উপরে ছিল। জব্বার বিষয়টা সহজ ভাবেই নিয়েছিল।
সে মনোযোগী হয়ে, হয়েছিল গোলরক্ষক। মোটামুটি সুনাম হয়েছিল। ঢাকেশ্বরী কটন মিল দলের গোল রক্ষক সেও হয়েছিল বাহাদুরের মত একই সময়ে।
ইসমাইল ওদের মত খেলতে পারত না বলে প্রায় দুঃখ করতো। বাহাদুর আর জব্বার বলত, আরে দোস্ত তুই দেখবি আমাদের চেয়ে অনেক বেশি টাকা-পয়সা কামাবি।
তোর সব চেয়ে সুন্দরী বউ হবে। ইসমাইল ওদের কথায় কখনো পুলকিত হতো, আবার কখনো মনটা তার ভারাক্তান্ত হয়ে যেত। ঠিক বলা যেত না, তার মনে হিংসা ভাব কাজ করতো কিনা। একবার সে বলে ফেলল, আমি কেন তোমাদের মত ভালো ফুটবল খেলতে পারি না। আমাকে মানুষ তোদের মত সম্মান করে না।
ঢাকেশ্বরী কটন মিল দলে সুযোগ পাওয়ার পরে বাহাদুর আর জব্বার খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। চাকরী , প্র্যাকটিস আর ম্যাচ খেলার পরে আর সময় তেমন পাওয়া যেত না । যদিও জব্বার বাহাদুরের মত তখনো চাকরী পায় নি। কিন্তু তার পরেও দু জনের একজনও আগের মতো সময় কাটাতে পারত না ইসমাইলের সাথে। ওদের দুরত্ব বাড়তে থাকলো।
সরকারী তোলারাম কলেজে ইসমাইলের সাথে পরিচয় হয় সিদ্দিকের। সে বিহার থেকে বাবা মার সাথে ভারত ত্যাগ করে এসেছে। বাবা আদমজী জুট মিলে ভালো বেতনের চাকরী পেয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে দুজনের সম্পর্কে বেশ গাঢ় হয়ে গেল। ইসমাইল আর আগের মত বাহাদুর, জব্বারের জন্যে অপেক্ষা করে না।
সিদ্দিক তাকে শেখায় জীবনে দরকার ক্ষমতা আর টাকার। কিছুদিনের মধ্যে কিছু দুর্নামও ছড়িয়ে পরে ওদের নামে। তার বিভিন্ন জায়গায় মাস্তানি করে টাকা উঠাচ্ছে। ওদের কাছে নাকি অস্ত্র আছে। বেশ কিছু মানুষকে মারধর করেছে তাদের কথা মত কাজ না করার জন্যে।
নারায়ানগঞ্জ মিউনিসিপিলিটি হাসপাতালে অনেকটা কাকতলীয় ভাবে বাহাদুরের বেশী বেতনের চাকরী হয়ে যায়। হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ মনিরুল ইসলাম নিজে এসে তাকে চাকরীর প্রস্তাব দেন। ডাক্তার সাহেব বাহাদুরদের পাড়ায় থাকতেন। এক সময় তারও ফুটবল খেলোয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু যাই হোক তা হয়ে উঠে নি।
ফুটবলের জন্যে তার যার-পর-নাই দরদ। যখন পাড়ার ছেলে বাহাদুরের পরিচিতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল, তার বাহাদুরের জন্যে কিছু করতে ইচ্ছে হলো। কয়েকদিন আগে তার হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ঢাকায় চাকরি নিয়ে চলে গেছে। তিনি খুব সহজেই বাহাদুরকে শূন্য স্থানে বসিয়ে দিলেন।
দু জনের সখ্যতা হলো খুব তাড়াতারি।
যদিবা ডাক্তার সাহেবের বয়স বাহাদুর থেকে পচিশ বছরের বেশী। হাতের কাজ কমে আসলেই তাকে ছুটে আসতে হতো বাহাদুরের কাছে আগের দিনের খেলা আর প্রাকটিস নিয়ে গল্প শুনার জন্যে। ফুটবলের পাশাপাশি আরো অনেক কথা হতো। বাহাদুর বলতো, তার বন্ধুদের কথা। জব্বার আর ইসমাইলের কথা।
জানায় তার আগের চাকরিটা সে জব্বারকে দিয়ে এসেছে। এতে জব্বার আর তার পরিবার মহা খুশি। কিন্তু ইসমাইল যেন এখন কেমন হয়ে গেছে। ওদের এড়িয়ে চলে। উর্দু ভাষায় সে এখন বেশ পারদর্শী।
সব সময় সিদ্দিকের সাথে থাকে। অনেক চ্যালা চামুন্ডা হয়েছে। তার এখন বিভিন্ন ধরনের আয় রোজগার।
বাহাদুর দেরীতে হলেও, একদিন ডাঃ ইসলামকে বলল, তার পরিচিত আরেক জনের কথা। শুধু পরিচিত বললে কম হবে।
জানালো তার প্রেয়সীর একান্ত আপন কথাগুলো। তার নাম প্রমিলা গুপ্ত। পাশের উত্তর পাড়ায় থাকে। উকিল মানস গুপ্তের বড় মেয়ে। গত দুই বছর ধরে দেখাদেখি চলছে।
তাকে বিয়ে করতে হবেই। কিন্তু বাসায় এখন পর্যন্ত এ কথা কেও জানে না। ডাক্তার সাহেব অবাক হয়ে কথাগুলো শুনে বললনে, আরে হারামজাদা তুই প্রেমও করিস।
৪
আদমজী জুট মিল এলাকার মানুষদের একটা বিস্ময়ের বস্তু ছিল। অনেক বিদেশী কাজ করতো।
মেয়েরা স্বাধীন ভাবে হেটে বেড়াত। কিছু বিদেশী মেয়ে যখন টেনিস খেলতো, তাদের পরনে থাকত পা খোলা সব কাপড়। এলাকার যে সব মানুষ এ সব দৃশ্য দেখেছে, তারা নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে নি। তারা যেয়ে বলেছে অন্যদের, তাদের থেকে আরো অন্যরা এই ভাবে ছড়িয়ে পরেছে চারিদিকে। যতটুকু ঘটনা, তার থেকে অনেক বেশী মুখরোচক কথা ছড়িয়ে পড়ে।
বিশাল মিলের গেট, দেয়ালের পাশে প্রুচুর মানুষ ভিড় করতো। মিলের কর্তপক্ষ নেপালের গুর্খাদের আনালেন পাহারা দেয়ার জন্যে। সৈনিক হিসেবে গুর্খাদের নৃশংসতা আর সাহসিকতা কথা ছিল কিংবদন্তির মত।
মানিকগঞ্জের দু জন মানুষ এসেছিল মিল দেখতে। তাদের জানা ছিল অবাক সব গল্পগুলো।
মিলের দক্ষিন দেয়ালের পাশে বড় একটা বড়ই গাছ। তারা সেই গাছ থেকে অনেকক্ষণ মিলের ভিতরে তাকিয়ে দেখল। আরেকটু বেশী তাদের দেখতে ইচ্ছে হলো। তার লাফ দিয়ে পড়লো দেয়ালের উপরে আর সেখান থেকে মিলের ভিতরের আঙ্গিনায়। সাথে সাথে ছুটে আসে গুর্খা প্রহরীরা।
এসেই গুলি চালালো। ঢাকা মেডিকেল কলেজে যখন তাদের নেয়া হলো, তখন দুজন বাঙালী লাশ হয়ে গেছে। চোখের ক্ষুধা আর তাদের মিটে নি। বাসায় আর তাদের ফেরা হয় না, তাদের রাতের বিছানা খালি থেকে যায়।
খবর আসে নারায়ানগঞ্জে দু জন বাঙালী মেরে ফেলা হয়েছে।
সাথে সাথেই আরম্ভ হয়ে যায় মার মার কাট কাট। প্রথমে তো বোঝাই যায় নি, কে কাকে মারছে। পরে আবিষ্কার হলো, মুসলমান নাম ধারী কিছু মানুষ হিন্দু মানুষদের নিধন যজ্ঞে ঝাপিয়ে পড়েছে। হয়ত কিছু হিন্দু প্রতিরোধ করতে যেয়ে মুসলমান হতাহত করেছে। খবর ছড়িয়ে পড়লো আরো ব্যাপক ভাবে।
শত বছরের সাম্য ধুলোয় লুটোপুটি খেতে থাকলো। নিজেদের বাচাতে হিন্দুরা এসে এক জায়গায় এসে জড়ো হলো। যাদের মনে প্রতিহিংসা ছিল, তারা ঝাপিয়ে পড়লো হিংসার আগুন নেভাতে। পাক ভারত বিভক্তির পরে নারায়ানগঞ্জ দেখল , ধর্মের নামে ধর্মের সবচেয়ে বড় অপমান, সাম্প্রাযদায়িক দাঙ্গা।
পাকিস্তানের আয়ুব সরকার জনগণ, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের ঐক্য ভেঙ্গে দেয়ার জন্যে অনেক ধরনের চেষ্টা করে আসছিল।
১৯৬৩ সালের শেষের দিকে একটা খবর খুব সযত্নে ছড়িয়ে দেয়া হয়। রটিয়ে দেয়া হয়, কাশ্মীরের এক মসজিদ থেকে নবী করিম হজরত মুহাম্মদের (দঃ) চুল চুরি হয়ে গেছে। উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। খুলনা, যশোর, রাজশাহী সহ দেশের অনেক জায়গায় শ্রমিকদের মধ্যে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। সরকার কবিরুদ্দিন পাকিস্তান রেডিওতে ঘোষনা দেন, চুল চুরির কথা মিথ্যা।
কিন্তু তারপরেও দাঙ্গা থামে না। বিহারী শ্রমিকরা আক্রমন করতে থাকে হিন্দুদের, বাঙ্গালীদের। তাদের হাতে অনেক মুসলমান বাঙালীও প্রাণ হারায়। দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি গড়ে তোলা হয়। দেরিতে হলেও, পাক সরকার সেনাবাহিনী দিয়ে পরিস্তিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার তা এর মধ্যে হয়ে গেছে। শুধু নারায়ানগঞ্জ আর আসে পাশের জায়গাতে দশ হাজারের বেশী মানুষ প্রাণ হারায়। খুন, লুট তারাজের সাথে সথে ধর্ষিতা হয় বাংলার শত শত নারী। বাংলার বাতাস প্রচন্ড ভারী হয়ে উটে।
৫
ডাক্তার ইসলাম হাপাতে হাপাতে ছুটে আসলেন বাহাদুরের অফিসের কামরায়।
চিৎকার করে বললেন, তুই এখনি দৌড় মার। হিন্দু -মুসলমানের দাঙ্গা আরম্ভ হয়ে গেছে। তোর এখানে থাকা একেবারেই নিরাপদ না। বাজার থেকে শুনে আসলাম ইসমাইল সিদ্দিকরা লিস্ট বানিয়েছে কোন কোন হিন্দুদের ওরা মারবে। তোর নাম ওখানে আছে।
বাহাদুর এই কথার জন্যে একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। তার মাথায় খেলছে না, এখন সে কি করতে পারে। তার ছোট বেলার প্রিয় বন্ধু তাকে মেরা ফেলার জন্যে লিস্টে নাম লেখাতে পারে। বলল, ইসলাম ভাই আপনি বলে দেন আমি কি করব।
ডাক্তার সাহেব বললেন, আপাতত বাড়িতে যেয়ে সবাইকে এক জায়গায় কর।
আমি জব্বার কে খবর দিয়ে এসেছি। সে কিছু মানুষ সাথে করে নিয়ে তোর বাসা পাহারা দিতে গেছে।
বাহাদুর চিন্তা করতে করতে বাসার দিকে ছুটল। এক মুসলমান বন্ধু তাকে মেরে ফেলার জন্যে লিস্টে নাম লিখেছে, আরেক বন্ধু তাকে রক্ষা করার জন্যে বাসা পাহারা দিতে গেছে। তারা তিনজন তো একই থালা থেকে ভাত খেয়েছে।
এক জন না খেলে অন্যরা না খেয়ে বসে থেকেছে।
উদাস হয়ে বাহাদুর ছুটতে লাগলো। কিছুদুর যেয়ে যা দেখল, তা ভাষায় প্রকাশ করার মত না। একদল বিহারী আক্রমন করেছে বাজারের পাশে কামার পাড়ায়। একের পর এক হিন্দু বাড়িতে আগুন দিছে।
এর মধ্যে অবশ্য বেশির ভাগ মানুষ পালিয়ে গেছে। ভীষণ বীভৎস একটা দৃশ্য এর পর দেখতে হলো। তারা সিদুর কপালে দেয়া এক মহিলার কোলের বাচ্চা কেড়ে জীবন্ত ছিড়ে দু ভাগ করে ফেলল। হামলাকারীদের কয়েক জন বাহাদুরকে যেতে দেখে জিজ্ঞাসা করলো, তুম কেয়া হিন্দু হ্যায়? বাহাদুর কোনো উত্তর দিল না। রাম দা হাতে দু জন তার পথ রুদ্দ করতে চাইল।
হাতা হাতি আরম্ভ হয়ে গেল। খেলোয়ার বাহাদুর সহজেই ওদের ধরাশাই করে ফেলল। তার পরেও পায়ের একটা কোপ খেলো। সময় মত পা সরিয়ে নেয়াতে কিছুটা রক্ষা। কিন্তু পায়ের গোড়ালির দিকে বড় ধরনের একটা জখম হলো।
রক্তাক্ত পা নিয়ে বাহাদুর ছুটে চলল বাসার দিকে।
বাসায় এসে দেখে আরেক দৃশ্য। বাহাদুরদের বাসায় সব হিন্দু পরিবারদের জড়ো করা হয়েছে। বাড়ির সামনে দেখা হলো, পাড়ার বেশির ভাগ পুরুষদের সাথে। রহিম চাচা, কুদ্দুস চাচা আর পাড়ার সব মুরুব্বিরা সেখানে।
কারো হাতে লাঠি, কারো হতে মাংস কাটার ছুরি। জব্বার কোথা থেকে একটা রাম দা জোগার করেছে তা বোঝা গেল না। বলল, আমাদের জান থাকতে একটা হিন্দুদের গায়ে আচর পড়তে দেব না। অন্যরা একই কথা বলে তাদের আশস্ত করতে চেষ্টা করলো। বাহাদুর খেয়াল করলো, সবারই চোয়াল কঠিন ভাবে শক্ত।
বুঝলো তারা যা বলছে, তা তারা যে কোনো মূল্যের বিনিময়ে করবে। এত বিপদের মধ্যেও গর্বে তার বুকটা বিশাল হলো। এক বাঙালী কি নিজের চোখের সামনে আরেক বাঙালীর ক্ষতি হতে দিতে পারে।
পরের দিন সকালেই ইসমাইল- সিদ্দিক তাদের দল নিয়ে হাজির। তাদের জন্যে বেশ কিছু অপেক্ষা করছিল।
প্রায় শ খানেক হিন্দুদের পাহারা দিচ্ছে পাড়ার প্রায় তিনশ মুসলমান বাঙালী। তার মধ্যে আছে ইসমাইলের বাবা আর ছোট ভাই। বাবা বললেন, খবরদার তোর দলের কেও যদি এই পাড়ার একটাও হিন্দুর গায়ে আচর দিয়েছে, তবে আমি নিজের হাতে রাম দা নিয়ে তোর মুন্ডু আলাদা করে ফেলবো। প্রায় পাচশ মানুষের দল নিয়ে তারা চলে গেল পাশের পাড়ায়। পরে শোনা গিয়েছি , এই দলই সারা নারায়ানগঞ্জে একটা বিরাট ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল।
তাদের হাতেই নির্বিচারে হাজার তিনেক হিন্দু খুন হয়।
বাহাদুরের বাবা বললেন, তুমি কলকাতা চলে যাও। তোমাকে যেহেতু অনেক মানুষ চিনে, সে জন্যে তোমার ঝুকি অন্যদের থেকে অনেক বেশি। সব আত্তীয় স্বজন, জব্বার আর ডাক্তার ইসলাম সাহেব এসে বিদায় দিলেন। জব্বার নিজে যেয়ে বাসে তুলে দিয়ে আসল।
বাসে করে ঢাকা আর সেখান থেকে বর্ডার হয়ে কলকাতা। কিন্তু সবাই খুবই সাবধান করে দিল। খবর আসত দাঙ্গা থেমে গেলেও, বিহারী আর তাদের দোসররা বাস, ট্রেন থামিয়ে হিন্দু খুঁজে খুঁজে মারছে। বাহাদুরের বাস কিছুদুর আসার পরে শসস্ত্র পাচ জন মানুষ বাস থামিয়ে উটলো হিন্দু সনাক্ত করতে। বাসের প্রথম দিকেই, দশ জনের একটা হিন্দু পরিবার তারা নামিয়ে নিল।
বাহাদুরের কলেজের আইডি কার্ড দেখল। নাম বাহাদুর সাহা। ধরে নিল মুসলমান। বাহাদুরের জীবন আরেক বার রক্ষা পেল। মনে মনে ভগবান আর বজলুর সারকে ধন্যবাদ দিল।
কিন্তু বাড়িতে খবর গেল, বাহাদুরকে বাস থেকে নামিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে।
৬
দাঙ্গা বন্ধের সাত দিনের মধ্যে বাহাদুর সাহা কলকাতায় চলে আসল। বাবার দূর সম্পর্কীয় এক ভাই দেশ ভাগ হওয়ার সময় কলকাতায় চলে এসেছিল। পরনের কয়টা কাপড়, সারে তিনশ টাকা আর বাবার লেখা চিঠি নিয়ে শক্তি কাকার বাসায় যেয়ে উঠলো। প্রথমে কাকা বললেন, তুমি ঢাকায় ভালো ফুটবল খেলতে দেখো কোনো বড় ক্লাবে সুযোগ পাও কিনা।
কিন্তু দাঙ্গায় জখম পা তখন ভালো হয় নি। ডাক্তার ইসলম এসে পায়ে ছয়টা স্টিচ দিয়ে যান। বলেছিলেন, এক্স রে করে দেখতে হবে জখম কত দূর পর্যন্ত হয়েছে। হয়ত অপারেশানের দরকার হতে পারে। বাহাদুরের হাটতে কষ্ট হত।
ভাবলো আগে চিকিৎসা করিয়ে, তার পরে খেলতে সুযোগ পাওয়া যায় কিনা, তা দেখতে হবে। সাথের টাকা গুলো খরচ করতে ইচ্ছে হলো না। ভাবলো আর কোনো চাকরি পাওয়া যায় কিনা দেখতে হবে। আর এর মধ্যে যদি পায়ের ব্যথা নিজের থেকে ঠিক হয়ে চায়, তা হলে তো সোনায় সোহাগা।
মনের মতো কোনো চাকরি খুঁজে পেল না।
একবার মোহন বাগান দলের মাঠে যেয়ে কথা বলল কয়েকজন খেলোয়ারের সাথে। কিন্তু তাদের সাথে বল নিয়ে দৌড়াতে পারল না। খুব ব্যথা আরম্ভ হয়ে গেল। বুঝলো ফুটবল থেকে তার বিদায় নিতে হবে।
মাস খানেক পরে শক্তি কাকা খবর দিলেন, পুলিশের চাকরির জন্যে লোক নিচ্ছে।
এর মধ্যে, এমন একটা অবস্থা দাড়ালো, বাহাদুর কাকার বাসা থেকে চলে গেলেই যেন কাকী যেন বেচে যান। কাকীমা একবারেই বাহাদুরকে বাসায় রাখতে চাচ্ছিলেন না। অল্প আয়ের সংসারে বাড়তি চাপের সৃষ্টি হচ্ছিল। যাই হোক, পুলিশের চাকরি হয়ে গেল। প্রথম ছয় মাস ট্রেনিং।
তার পরে সাব ইন্সপেক্টর। সবার আশির্বাদ নিয়ে বাহাদুর ট্রেনিং আরম্ভ করলো।
সব মিলিয়ে চল্লিশ জন ছিল এসেছিল ট্রেনিং নিতে। বাহাদুরের রুমমেট হলো আরো দুজন। তারা দুজন বাহাদুরকে নাজেহাল করতে সব চেষ্টাই করতো।
বাহাদুরের অপরাধ সে ওই বঙ্গের মানুষ। পুলিশ একাডেমিতে মাসে চল্লিশ টাকা এলাউন্স দিত। সে এই টাকা দিয়ে আলাদা করে ডিম, দুধ আর কলা কিনে খেত। প্রাক্তন খেলোয়ার বাহাদুর পুলিশী ট্রেনিং এ প্রতিটা বিষয়ে ছিল সবার থেকে এগিয়ে। দৌড়, ঝাপ আর পড়া লেখা সব বিষয়ে তার আশে পাশে কেও ভিড়তে পারত না।
অন্যদের হিংসা এতে আরো বাড়তে লাগলো। রুমমেটরা সব ধরনের যন্ত্রনা করতে লাগলো। একদিন বাহাদুর এসে দেখল তার কাপড় চোপর জানালার বাইরে ফেলা। তার কেনা খাবার দাবার পর পর তিন দিন দেখল কেও মেঝেতে ফেলে রেখেছে। মেজাজটা তুমুল খারাপ হয়ে গেল।
সরাসরি রুমমেটদের জিজ্ঞাসা করলো তারা এ কাজ কেন করেছে। উত্তরে বলল, ওরা চায় যাতে সে ট্রেনিং ছেড়ে চলে যায়। এমনকি ভারত ছেড়ে নিজের দেশে চলে গেলে আরো ভালো। কথায় কথায় ঝগড়া আরম্ভ হয়ে গেল। তার পরে হাতা হাতি।
বাহাদুর দুই রুমমেটের নাক ফাটিয়ে দিল। ফলশ্রুতিতে, ওই দিনই বাহাদুরকে পুলিশের ট্রেনিং থেকে বাদ দিয়ে দেয়া হলো।
বাহাদুরের জীবনের আসল সংগ্রাম এখন আরম্ভ হলো। শিয়ালদাহ স্টেশানের পাশে একটা বস্তিতে যেয়ে উটলো। বাসের টিকেট বিক্রির চাকরি হলো।
একদিন পরিচয় হলো, মতি হালদার নামের একজনের সাথে। দু জনের বন্ধুত্ব হয়ে গেল অল্প কিছু দিনের। বাহাদুরের জীবন কাহিনী মতিকে খুবই বিমোহিত করলো। তার বাবার কন্ট্রাকটারী ব্যবসায় তিন শ টাকা বেতনের ইলিকট্রিশিয়ানের চাকরির ব্যবস্তা করে দিল। জীবনের কিছুটা স্বাচ্ছন্দ আসলো।
প্রথমে ইলেকট্রিকের কোনো কাজ তার জানা ছিল না। ধীরে ধীরে তার সব কাজই শেখা হয়ে গেল।
আসার তিন বছর, প্রমিলার সাথে কোনো যোগাযোগ ছিল না। হঠাৎ একদিন শক্তি কাকা খবর পাঠালেন দেখা করতে আসার জন্যে। কি অবাক কান্ড, শক্তি কাকার বাসায় প্রমিলা বসে আছে ।
সেও প্রথমে অন্যদের মত জানত, বাহাদুরকে মেরে ফেলা হয়েছে। বাহাদুরের নারায়ানগঞ্জ ছাড়ার প্রায় মাস চারেক পরে, জব্বার এসে বলে যায় আসলে সে মরে নি। কলকাতায় যেয়ে শক্তি কাকার বাসায় যেয়ে উঠেছে। জব্বারকে বাহাদুর চিঠি দিয়েছে। বলেছে এ খবর নারায়ানগঞ্জের অন্য সবার থেকে গোপন রাখতে।
সময় হলে সে নিজে এসে সবার সাথে দেখা করে যাবে।
তাকে খুজতেই প্রমিলা এসেছে। এর এক সপ্তাহের মধ্যে বাহাদুর প্রমিলাকে বিয়ে তার ছোট বাসায় নিয়ে তুলল। যে প্রেমের সূত্রপাত হয়েছিল ওই বঙ্গে, এই বঙ্গে তা আবার বহমান হয়।
এর পর জীবন বেশ স্বস্তিতে কাটতে লাগলো।
১৯৭০ সালে বাহাদুর ইলিকট্রিকাল বৈদ্যুতিক সুইচ বানানো আরম্ভ করলো। ছয় মাসের মধ্যেই টাটা কোম্পানির সাব কন্ট্রাক্ট পেয়ে গেল। অর্থনৈতিক কষ্টটা চলে গেল। কিন্তু মনটার মধ্যে একটা হাহাকার থেকেই গেল। তার তো আসলে একজন ফুটবল খেলোয়ার হয়ে থাকার ইচ্ছে ছিল।
৭
১৯৭১ সাল। মার্চ মাসের শেষের দিকে খবর আসল ঢাকায় পাক হানাদের বাহিনীর গণ হত্যার কথা আর মুক্তি যোদ্বাদের দেশকে স্বাধীন করার যুদ্ধ আরম্ভ করার কথা। কয়েক দিনে হাজার হাজার উদ্বাস্তু সীমানা অতিক্রম করে জান বাচাতে চলে আসে ভারতে। ভারতের জনগণ আর সরকার দ্বিধাহীনভাবে বাঙ্গালীদের পাশে এসে দাড়ায়। মুক্তি যোদ্ধাদের ট্রেনিং ক্যাম্প তৈরী হয়।
অস্ত্র, গোলা বারুদ আর নৈতিক সমর্থন সবই ভারত দেয়।
বাহাদুর সাহা তখন খুব ব্যস্ত মানুষ। কিন্তু তার দেশের মানুষ মারা যাচ্ছে, তারা যুদ্ধ করছে দেশ স্বাধীন করার জন্যে আর সে কি করে তাদের থেকে দূরে সরে থাকবে। ম্যানেজার রতন লালকে ডেকে বললো, আমাকে আমার দেশের মানুষকে সাহায্য করতে হবে। ওরাই একদিন আমাকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে অনেকবার বাচিয়েছে।
তুমি ব্যবসাটাকে ধরে রাখো। যুদ্ধ শেষ হলে আমি আবার তোমার সাথে যোগদান করব।
মুক্তি যুদ্ধের নয় মাস বাহাদুর সাহার প্রচন্ড ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে কাটল। এপ্রিল মাসেই তার বাসা ভরে গেল নারায়ানগঞ্জ থেকে আসা আত্তীয় স্বজনদের দিয়ে। প্রমিলা হাসি মুখে তাদের খাওয়া আর থাকার পূর্ণ দায়িত্ব নিল ।
বাহাদুর জায়গায় জায়গায় যেয়ে চাদা তুলতে লাগলো। বাংলাদেশের জন্যে মতামত তৈরী করার জন্য কাজ করতে থাকলো। বাংলাদেশের নেতা, শিল্পীদের পেলে তাদের আর ভারতীয়দের সামনে দাড় করাতে পারলে মানুষজনদের সমাগম বেশি হতো, চাদা একটু বেশীই উঠতো।
এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে জব্বার আর ইসমাইলের পরিবার তার বাসায় এসে হাজির। সাথে জব্বারের লেখা চিঠি।
বন্ধু আমরা বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে যুদ্ধে যোগদান করেছি। আমাদের দুজনের বউ আর আমাদের বাচ্চাগুলোকে, আমার দুই মেয়ে , আর ইসমাইলের দুই মেয়ে তোমার কাছে পাঠালাম । ওদেরকে তোমার কাছে রেখো। ওদের দেশে রাখা খুবই বিপজ্জনক, কারণ আমরা মুক্তি যোদ্ধা। যাই হোক, আরেকটা বিষয় পরিষ্কার করে রাখি।
১৯৬৪ দাঙ্গার পরে ইসমাইল তার ভুল বুঝতে পারে। তার কৃত কর্মের জন্যে সে প্রতিটা মুহুর্তে যন্ত্রনায় ভুগে। সে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে একেবারে সামনা সামনি যুদ্ধ করছে। পারলে তুইও ওকে ক্ষমা করে দিস। মানুষ তো ভুল করেই।
চিঠি পড়ে বাহাদুর কিছক্ষন নির্বাক হয়ে থাকে। যে একদিন তাকে মেরে ফেলার জন্যে দল বল নিয়ে এসেছিল, তার পরিবার এখন তার কাছে নিরাপত্তার জন্যে এসেছে। বিধাতার এ কি অপরূপ লীলা খেলা। বাহাদুর দুই পরিবারের থাকার জন্যে বাড়ি ভাড়া করে দেয়।
বাহাদুর সপ্তাহে কম পক্ষে দুই বার ক্যাম্পে যেয়ে বাঙ্গালীদের দেখে আসত।
চাদা আর সাহায্য পৌছিয়ে দিয়ে দিতো। বলত আমিও বাঙালী। এর মধ্যে চালু হলো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। নিজের ব্যবসা থেকে যত টুকু পারল যন্ত্র পাতি আর টাকা দিয়ে সাহায্য করে আসলো। আবার খবর আসলো, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল তৈরী হয়েছে।
বাহাদুর নিজে যেয়ে মোহন বাগানের সাথে খেলার আয়োজোন করে দিল। দলের খেলোয়ারদের সাথে আন্তরিকতার সৃষ্টি হয়ে গেল। তাদের কেউ কেউ বাহাদুরের সেই বিখ্যাত খেলা গুলোর কথা শুনেছে। সে ভাবে, তার প্রানের খেলা ফুলবল দিয়েও তারা পাক বাহিনীকে মোকাবেলা করছে। যে জাতি এত ভাবে যুদ্ধ করতে জানে, তার স্বাধীনতা আসবেই আসবে।
মতি হালদারের সাথে তার আগের মত দেখা হয় না। মতির ব্যবসা বানিজ্য আগের থেকে অনেক বেড়েছে। একদিন রাতে বড় একটা ভ্যান নিয়ে সে হাজির। বলল, বাহাদুর এক শ রেডিও কিনে নিয়ে এসেছি। এ গুলো বাংলাদেশের মানুষদের মধ্যে বিতরণ করে দিও।
সে দিন পত্রিকায় দেখলাম , স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালু হয়েছে। বাঙ্গালীরা খুব মনোযোগ দিয়ে অনুষ্টান শুনছে। তারা যুদ্ধের খবর শুনছে আকাশ বাণী আর বিবিসি থেকে। এই রেডিওগুলো তাদেরকে যুদ্ধের শরিক করে তুলবে। বাহাদুরের আরেকবার অবাক হওয়ার পালা আসল।
শুধু মতিকে বলল, ভাই তুমি আমাকে আবার কৃতজ্ঞতার জালে বেধে ফেললে। মানুষ তো মানুষের জন্যেই।
৮
১৬ ডিসেম্বর , ১৯৭১। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেল। নতুন সরকার ঘোষণা দিল, যারা মুক্তি যুদ্ধে যে কোনো ভাবেই সাহায্য কিংবা অংশগ্রহন করেছ, তারা সবাই মুক্তি যোদ্ধা।
বাহাদুর ভাবলো, তা হলে সেও একজন মুক্তি যোদ্ধা। সে হাতে বন্দুক তুলে নেয় নি, কিন্তু সহায়ক কত কাজ না করেছে। জব্বার খবর পাঠায়, পারলে স্বাধীন বাংলাদেশ একবার ঘুরে যা। বাংলার মাটিতে আর কখনো সাম্প্রযদায়িক দাঙ্গা হবে না। আর কাউকে জীবন বাচানোর জন্যে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে না।
কিন্তু আরেকটা মারাত্মক খবর দেই। । ইসমাইল যুদ্ধ শেষ হওয়ার কয়েক দিন আগে যশোর ক্যান্টনমেন্ট দখল করার সময় পাক হানাদারদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হয়েছে। বাহাদুরের দু চোখ ভিজে আসে। একটা মানুষ কি সংঘ দোষে দেশের বিরুদ্ধে ভুল করার প্রায়শ্চিত্ত এই ভাবেই দেয়।
১৯৬৪ সালে দেশ ছাড়ার পর ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে বাহাদুর নারায়ানগঞ্জে ফিরে আসলো, সাথে প্রমিলা। নতুন দেশ বাংলাদেশে তখন সব ধরনের অরাজকতা। কে যে রাজাকার, কে যে মুক্তি যোদ্ধা, তা বলা খুব মুশকিল। সন্ধ্যা হলেই গোলা গুলি আর বোমার শব্দ শুনা যায়। সবাই এ সময়ে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে থাকে।
দরজায় শত শব্দ হলেও দরজা খোলা হয় না। প্রমিলার দু দিনের মাথায় আকাশ পাতাল জ্বর আসলো। একজন ডাক্তার দেখাতে না পারলে আজকে রাতেই তার মৃত্যু । স্বাধীন দেশে অনেক কিছুর সাথে বিভিন্ন ধরনের অসুখ বিসুখ ছড়িয়ে পড়েছিল। খুব সম্ভবত তার কলেরা হয়েছে।
রাত তখন দুইটা। হাসপাতালে যাওয়া যাবে না। কোনো ডাক্তার এই সময় বাসা থেকে বের হবে না। বাহাদুর বের হলো একজন ডাক্তার খুঁজে আনতে। মনে হলো সে তো এ দেশে বেড়াতে এসেছে, সে তো এখানে থাকে না।
সে কোথা থেকে ডাক্তার পাবে। যাই হোক অনেকটা আন্দাজের উপর ভরসা করে সে ডাক্তার মনিরুল ইসলামের বাসার সামনে যেয়ে দাড়ালো। আগে ছিল টিন ছাদের এক তালা বাসা। এখন পাকা দুই তালা বাসা। অনেক কষ্টে দারোয়ানকে রাজি করালো . ডাক্তার সাহেবকে একটা চিঠি পৌছিয়ে দিতে।
চিঠিতে লিখল, ইসলাম ভাই বাহাদুরকে আবার আপনার সাহায্য করতে হবে। তবে এবার বাহাদুরের বউ প্রমিলাকে বাচাতে হবে।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে শোনা গেল ডাক্তার মনিরুল ইসলামের চিৎকার, আরে হারামজাদা তুই এখনো বেঁচে আছিস……………….।
৯
বিমল সাহা সারা জীবন বাহাদুর সাহা নাম ব্যবহার করে এসেছে। বাহাদুর নামের মধ্যেই তার শিকড়ের সাথে যোগাযোগ, শিকড় কে নিয়ে বসবাস।
সে থাকে এখন কলকাতার অভিজাত সল্ট লেক এলাকায়। পার্ক স্ট্রীটে তার নিজস্ব অফিস। তার এক ছেলে , আর এক মেয়ে। ছেলে তার ব্যবসা দেখে আর মেয়ে থাকে সুদুর আমেরিকায়। ২০০৫ সালে তার একটা বড় ধরনের স্ট্রোক হয়।
এক মাস টাটা মেডিকেল সেন্টার আর তিন মাস থাকতে হয় এক নার্সিং হোমে। বাঁচার আশা একেবারে ছিল না। ডাক্তাররা অনেকটা হাল ছেড়ে দিয়েছিল। প্রথমে পুরো স্মৃতি শক্তি হারিয়ে গেলেও, পরে তার কিছুটা ফিরে আসে। কিন্তু চির তরে স্মৃতি থেকে হারিয়ে যায় তার জীবনের বিশ বছর।
১৯৮৫ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত জীবনের কোন ঘটনা মনে করতে পারে না। কিন্তু তার গর্বের শেষ থাকে না, তার ছোট বেলা , বাংলাদেশের জীবন আর বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতিটা দৃশ্য একেবারে জ্বল জ্বলে মনে থাকার জন্যে । তার অস্থিতে, মজ্জায়, হৃদয়ে সারাক্ষণ বাংলাদেশ। এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে, শীতলক্ষা নদীতে বন্ধুদের নিয়ে সাতার কাটার কথা, মানুষের গাছে উঠে ফল চুরি করে খাবার কথা, কুষ্টিয়ায় ফুটবল খেলতে যেয়ে পেয়াজ ছাড়া ইলিশ মাছ খাবার কথা, প্রমিলাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার কথা আর ঢাকা স্টেডিয়ামে বল নিয়ে দৌড়ানোর কথা। স্ত্রী প্রমিলাকে বলে, ওই স্মৃতি গুলো ছাড়া আমি বেচে থাকতে চাই না।
প্রত্যেক বছর তাকে অবশ্যই বাংলাদেশে যেতে হয়। অনেকটা তীর্থ যাত্রা থেকেও এটা জরুরি কাজ। দেশের প্রতিটা জিনিস, প্রতিটা মানুষ তার কাছে পরম আদরের। অবাক হয়ে চোখ ভরে শুধু দেখতে ইচ্ছে করে। এই দেশই তো তাকে লালন পালন করেছে, সম্মান দিয়েছে, আর বারে বারে রক্ষা করেছে।
এই দেশকে তো কোনো ভাবেই না ভালোবেসে পারা যায় না । এই জন্যই প্রাণ দিতে পেরেছে তার ছোট বেলার বন্ধু ইসমাইল, সালাম, বরকত আর তিরিশ লক্ষ বাঙালী। হৃদয়ের অন্তঃস্থল বেরিয়ে আসে দু লাইন, আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি ।
(কিছু সত্যি ঘটনার উপর ভিত্তি করে এই লেখা। তবে ঐতিহাসিক তথ্য একেবারে ঠিক নাও হতে পারে )
ফোর্ট ওয়ার্থ, টেক্সাস
ইউ ,এস.এ
ফেব্রুয়ারী ০৮, ২০১১
http://www.lekhalekhi.net
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।