স্বাধীনতার পথ, সমাজের নৈতিক মূল্যবোধ
ফকির ইলিয়াস
=================================
যে চেতনা, স্বপ্ন এবং প্রত্যাশার লক্ষ্যে স্বাধীন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির অভ্যুদয় হয়েছিল তা আজ কতোটা বাস্তবতার পরশ পেয়েছে, সে প্রশ্নটি উত্থাপিত হচ্ছে বারবার। চল্লিশ বছর একটি জাতি এবং রাষ্ট্র পুনর্গঠনে কম সময় নয়। রাষ্ট্রের রাজনীতিকরা চাইলে অনেক কিছুই হতে পারতেন। কিন্তু হয়নি। কেন হয়নি সে প্রশ্নের জবাব কারোই অজানা নয়।
বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির মৌলিক মূলনীতি ছিল গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদ। একটি দেশে গণতন্ত্রের পাশাপাশি সমাজতন্ত্র চলতে পারে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। তারপরও ঊনসত্তর-সত্তর-একাত্তরে জাতীয় রাজনৈতিক ঐকমত্যের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল ঐ চার মূলনীতির পক্ষে। যার ওপর ভিত্তি করে সংঘটিত হয়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধ। এটা খুবই হতাশা এবং দুঃখের কথা, যে চেতনা নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল, স্বাধীনতা অর্জনের পর সে চেতনা সর্বক্ষেত্রে সমুন্নত ছিল না।
তাছাড়া একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত রাষ্ট্রে এর কাঠামো পুনর্গঠনও সহজ কাজ ছিল না। তারপরও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হাল ধরেছিলেন খুব শক্ত হাতে। জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সমর্থন আদায়ে তিনি ছিলেন খুবই সক্রিয়। এই যে অগ্রসর ভাবনা-পরিকল্পনা, তা একাত্তরে পরাজিত হায়েনাদের অকেকেরই পছন্দ ছিল না। তাই এরা সেই পরাজয়ের শোধ নিতে নানাভাবে ছিল তৎপর।
যার ফলেই পরাজিত মধ্যস্বত্বভোগী গোষ্ঠীটি সুযোগমতো তাদের ছোবল দিতে তৎপর ছিল। এরা ১৫ আগস্টেও নির্মমতম হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে তাদের খায়েশ পূরণে অগ্রসর হয়। সামরিক জান্তাদের কারা, কিভাবে নেপথ্যে ছিল তা ক্রমশই বেরিয়ে আসছে আজকের ইতিহাসের আলোকে।
ওরা বলেছিল তারা পলিটিক্সকে পলিটিশিয়ানদের জন্য ডিফিকাল্ট বানাবে। উদ্দেশ্য কতোটা খারাপ হলে এমন বলা যায়, তাও বিবেচনার দাবি রাখে।
সেইসব সামরিক জান্তারা খেলেছিল টাকার খেলা। ছাত্রদের হাতে কাড়ি কাড়ি টাকা তুলে দিয়ে ভিড়িয়েছিল নিজ নিজ দলে।
‘একশ এক’ টাকা কিংবা ‘এক হাজার এক’ টাকায় রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি কাউকে দান করে দেয়ার রেওয়াজ বিশ্বের অন্য কোনো দেশে আছে কিনা তা আমার জানা নেই। কিন্তু শুধুমাত্র বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিতেই অনেক মূল্যবান ভবন, হাজার হাজার একর পতিত জমি, খাসভূমি, উদ্যান, নামমাত্র মূল্যে বিলি-বণ্টন করে নিয়েছেন রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক-পরিচালকরা। কতোটা মগের মুল্লক মনে করলে এমনটি করা যেতে পারে তা ভাবলে গা শিউরে ওঠে।
কিন্তু জনগণ এতোই অসহায় যে তারা প্রতিবাদ তো দূরের কথা, ‘রা’ শব্দটি পর্যন্ত করেন না। কিংবা করতে পারেন না। ভেবে অবাক হতে হয় দেশের প্রায় প্রতিটি সরকারই স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতে মনোযোগী না হয়ে বরং চেপে গেছে। সন্ত্রাস, দুর্নীতি, রাজনৈতিক নিপীড়ন এগুলোর মতো বড় ইস্যুর কথা যদি বাদই দিই তবে তো রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো দায়িত্ব থাকে না। তারপরও আছে আরো অনেক ছোট ছোট জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যু।
বাংলাদেশে লঞ্চ-স্টিমারডুবির মতো একটা ভয়াবহ ঘটনা ঘটে প্রায় প্রতি বর্ষা মৌসুমে। পত্র-পত্রিকার ভাষ্য অনুযায়ী প্রায় প্রতি বছরই লঞ্চ-স্টিমারডুবির ঘটনা ঘটে বাংলাদেশে। সহস্র সহস্র লোকের প্রাণহানি ঘটে। সড়ক দুর্ঘটনা আরেকটি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। দেশের জনসংখ্যা পনেরো কোটির কাছাকাছি হলেও সড়ক ব্যবস্থার উন্নতি হয়নি আশানুরূপ।
সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, লঞ্চ-স্টিমার ডুবে, অত্যধিক যাত্রী বহন করে। পরিতাপের বিষয় এর কোনো তদন্ত হয় না। লঞ্চ-স্টিমার, জাহাজ নিয়ন্ত্রণ বিধি বলে কোনো নিয়ম-কানুন নেই। বাংলাদেশের প্রতিটি সেক্টরই এক একটি মিনি স্বৈরকেন্দ্র। চিকিৎসা, শিক্ষা, ব্যাংকিং, ডাক, তার-টেলি, সড়ক, পরিবহন সবকটি গণপ্রয়োজনীয় সেক্টরই নিয়ন্ত্রণ করছে এক একটি স্বৈর পেশিশক্তি।
কোনো রোগী হাসপাতালে ভর্তি হলে আগে তার পকেট গুনে দেখার চেষ্টা করা হয়। রোগীটি ধনী না গরিব। ধনী হলে তাকে চিকিৎসকদের পছন্দমতো (যেগুলো নেপথ্য পার্টনার তারা নিজেরাই) ক্লিনিকে ভর্তির উপদেশ (!) দেয়া হয়। আর রোগীটি গরিব হলে তার স্থান হয় হাসপাতালের বারান্দায়। একই অবস্থা শিক্ষা ক্ষেত্রেও।
মন্ত্রী-আমলা বড় কর্তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য পাঠানো হয় বিদেশে। আর গরিব মধ্যবিত্তদের সন্তানদের রাজনীতিকরা ব্যবহার করেন তাদের হাতিয়ার হিসেবে। শিক্ষকরা পরামর্শ দেন প্রাইভেট কোচিং সেন্টার, প্রাইভেট স্কুল-কলেজে ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি হওয়ার। বৈষম্য আর কতোটা নগ্ন হতে পারে?
বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরটিও এখন দখল হয়ে গেছে রাজনীতিকদের দ্বারা। বড় বড় সরকারি, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালক নিয়োগপ্রাপ্ত হন রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে।
ডাক ব্যবস্থার কাছে জিম্মি দেশের মানুষ। তার ও টেলিযোগাযোগের ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক আধিপত্য চরম অবস্থা বিরাজ করেছে সব সময়। এর মধ্যে ইন্টারনেট প্রায় বারোটা বাজাতে বসেছে চিঠিপত্রের। তাই ডাক বিভাগকে বাঁচাতে নতুন ভাবনা উৎপাদনশীল খাতের সন্ধান দিতে পারে। বাংলাদেশের সড়ক ব্যবস্থা, রেল যোগাযোগ এখনো ধারণ করে আছে শত বছরের দারিদ্র্য।
লোক দেখানো আইওয়াশের মতো কিছু উন্নয়ন হলেও এখনো বৃষ্টির পানিতে ডুবে যায় রাজধানী ঢাকা শহর। মন্ত্রীরা গাড়ি হাঁকাতে পারলেও জনসাধারণ হেঁটেও পথ চলতে পারেন না। তার ওপর অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে রাজনৈতিক নেতা ও তাদের দোসরদের ভবন-দালান। দখল হয়ে যাচ্ছে লেখ পার্ক, নদীর চর, এমনকি কখনো কখনো নদীও।
যারা ক্ষমতায় থাকছে তাদের নেতাকর্মীরাই ভোগ করছে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিকে।
অথচ পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী দেখা যায়, ঈদে পুজোয় বাংলাদেশে হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা বাণিজ্য হয়। তাহলে দেশটির গায়ে দারিদ্র্যের ছাপ কোথায়? কে বলবে বাংলাদেশ গরিব দেশ? হ্যাঁ, দারিদ্র্য জড়িয়ে আছে দেশের পাঁজরে, অস্থি, মজ্জায়। কয়েক হাজার পরিবার ধনাঢ্য ব্যক্তিত্বের উত্থান হলেও অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে দরিদ্র করে রাখা হয়েছে আপামর জনসাধারণকে। মৌলিক উন্নয়নের কোনো ছোঁয়া রাষ্ট্রের কাঠামোতে লাগেনি। ন্যায্য ইস্যু নিয়ে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে কিছু বললে তারা ধর্মঘটের হুমকি দেন।
শিক্ষক, বৈমানিক, ব্যাংকার, কর্মকর্তারা, শ্রমিকসহ প্রায় প্রতিটি সেক্টরের মানুষের এক অনন্য শক্তি হচ্ছে তারা কর্ম বয়কট করবেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে তারা নিজেরা নিজের আয়নায় নিজের চেহারা দেখেন না।
নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত না হলে দেশপ্রেম প্রতিষ্ঠা হয় না। আর দেশপ্রেম প্রতিষ্ঠিত না হলে দেশের কল্যাণে কাজ করার মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রতিটি জাতির প্রবাসীদের দেশপ্রেম অনন্য।
তার কারণে তারা দেশের বাইরে থেকেও দেশের প্রকৃত অবস্থা অনুধাবন করতে পারেন। বাংলাদেশের প্রবাসীরা কোটি কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠান। আর নিজেরা দেশে গিয়ে সামান্য সামাজিক নিরাপত্তাটুকুও পান না। বাঙালি জাতির স্বাধীনতার স্বপ্ন ছিল। স্বাধীনতা এসেছে।
কিন্তু পরাজয়ের মৌন ধারাবাহিকতায় ক্রমশ ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে সেই স্বপ্নসৌধ। বলতে দ্বিধা নেই যদি একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক নেতা কিংবা নেত্রী কঠোর হয়ে বাংলাদেশের হাল ধরতেন তবে আজকের প্রেক্ষাপট ভিন্ন রকম হতো। শেখ মুজিব সেই পথই দেখিয়েছিলেন জাতিকে। বাঙালির সামনে এখন আর বিশেষ কোনো স্বপ্ন গন্তব্য নেই। শুধু আছে একটি পরিশুদ্ধ, ইতিহাস অন্বেষী প্রজন্ম গঠনের প্রত্যয়।
যারা সত্যের ওপর শক্তিশালী বুক নিয়ে দাঁড়াবে। বাঙালি জাতি যদি এই স্বপ্নটি পূরণেও ব্যর্থ হয় তবে জাতির যাযাবরত্ব আরো দীর্ঘায়িত হতে পারে। স্বপ্ন এখন একটিই এই প্রজন্ম জাগবে। ভেঙে দেবে কালো আঁধারের লৌহ দরোজা।
নিউইয়র্ক /২২ মার্চ ২০১১
-------------------------------------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ/ ঢাকা/ ২৬ মার্চ ২০১১ শনিবার প্রকাশিত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।