আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রতিদান

স্রোতস্বিনীর বয়ে চলা ঢেউয়ের মত হতে চাই,সৃষ্টিশীল স্রষ্টাদের মাঝে থাকতে ভাল লাগে,ভালবাসি মাকে,বাবাকে,আমার আদুরে বোনকে আর পাশে রাখি বই বন্ধুকে। হতে চাই অনেক কিছু,হতে পারি অল্পকিছু। চেষ্টাটাই বা কম কিসে !!! আমি নিলুপাগলা :D

অনেকদিন হয়ে গেল নতুন কিছু লিখছি না। তাই আজ আমার ডায়রী থেকে একটি ঘটনা ছোটগল্প রূপে দিলাম। কেমন লাগলো জানাতে ভুলবেন না।

*************************************************** ব্যাস্ততার এই নগরে সবাই ব্যাস্ত । সবাই নিজেকে নিয়েই বাস্ত, পাশে বসা মানুষটার প্রতিও কারও কোন কৌতুহল নেই। আমি নিজেও এর ব্যাতিক্রম নই। সারাদিন হাড় ভাঙ্গা খাটুনি খেটে এখন বাসে চড়ে বাসায় ফিরছি। বাসে ওঠাও এখন রীতিমত প্রতিযোগিতা, যে জয়ী তার জন্য রয়েছে পুরস্কার, বসার জন্য একটি সিট।

পুরস্কারটা তেমন আহামরী কিছু না হলেও সারাদিনের ক্লান্ত দেহে এই সিটটি পাওয়া বিশ্বকাপ পাওয়ার চাইতে কম আনন্দের নয়। এত কষ্টের পর পাওয়া সিটটি তাই কেউ হাত ছাড়া হতে দিতে চায় না। তাই বাসে হঠাৎ করে কোন মহিলা বা কোন বৃদ্ধ লোক উঠে পড়লে সবাই একটু সার্থপর হয়ে যায়, আর যদি সিটটি ছেড়ে দিতেই হয় তবে তার সারা দেহ থেকে নিংড়ে বেরিয়ে আসে রাজ্যের বিরক্তি। কেন বাবা মরতে এলি এই লোক ভরতি বাসে? আর এলি যদি তো এই বাসটাই কেন? রাস্তায় কি বাসের অভাব পরেছিল? সত্যি বলতে কি, আমি নিজেও এই উটকো ঝামেলা গুলোকে ঝামেলা বলেই মনে করি। সিটটি যেন ছেড়ে দিয়ে উঠে দাড়িয়ে থাকতে না হয় তাই চেষ্টা করি সবসময় জানালার দিকটায় বসতে।

সাধারনত মাঝের দিকে যারা বসে তাদেরই সিট ছেড়ে দিতে হয় বেশিরভাগ সময়। আমার অফিস বনানী, সূচনা বাসে চড়ে আসা-যাওয়া করি প্রতিদিন। আজ বাসটি বেশ খালি। ভাগ্য ভাল তাই উঠেই সামনের দিকেই একটি সিট পেয়ে বসে পরলাম। পাশের লোকটি নেমে গেল তাই ২টি সিটে এখন আমি একাই বসে আছি।

পরের কাউন্টার থেকে যাত্রী উঠল মাত্র একজন। মার্জিত পোষাকের এই সুদর্শন যুবকটিকে প্রথম দর্শনে বেশ ভদ্র বলেই মনে হল। যুবকটি আমার পাশের খালি সিটটায় বসে পড়লো। বাস চলতে শুরু করলো আর আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে রাতের ঢাকার রূপ উপভোগ করতে লাগলাম। বাসটি একটি কাউন্টারে থামলো, এক বৃদ্ধা মহিলা বাস এ উঠলেন।

এক ১৩-১৪ বছরের ছেলে বৃদ্ধাকে বাস এ উঠিয়ে দিয়েই টুপ করে বাস থেকে নেমে পড়লো। মহিলাকে দেখে ভালই বোঝা যাচ্ছিল মহিলা চোখে ভাল দেখতে পান না। আমি চোখ ফিরিয়ে আবার জানালার বাইরে মনোযোগ দিলাম। পাশের যুবকটি বৃদ্ধাকে দেখে একটু চঞ্ছল হয়ে উঠলো। সিট ছেড়ে উঠে গিয়ে বৃদ্ধা মহিলাটির হাত ধরে এনে নিজের সিটে বসিয়ে দিল।

মনে মনে শান্তি পেলাম এই ভেবে যে সবাই আমার মত বিবেকহীন হয়ে যায়নি। আপনি কোথায় যাবেন নানী? বৃদ্ধা শাড়ীর আচল থেকে খুলে এক টুকরো মলিন কাগজ বার করে যূবকটির হাতে ধরিয়ে দিল। আচ্ছা, আপনি আসাদগেট যাবেন। কিন্তু নানী, এই বাসতো আড়ং থেকে ঘুরে যাবে, আসাদগেট দিয়া যাবে না। আপনাকে কিছুটা রাস্তা হেটে যেতে হবে।

আপনি কি পারবেন ? যুবকের প্রশ্নে বৃদ্ধা কোন উত্তর দিল না। আমার ও যুবকটির মত সেও জানে, অপরিচিত একটি জায়গায় একজন প্রায় অন্ধের একা একা হেটে কোথাও যাওয়া প্রায় অসম্ভব। একা একা কেন বের হলেন? পরিবারের কাউকে নিয়ে আসতেন পৌছে দেয়ার জন্য। বৃদ্ধা কিছুক্ষন চুপ করে থাকলেন। দাত দিয়া ঠোট কামড়ে ধরলেন, কে জানে, হয়ত কান্না আটকালেন !!! আমার দেখার ভুলও হতে পারে।

বড় ছেলের কাছে ছিলাম, এখন সে আমাকে ছোট ছেলের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। আমাকে নাকি সে আর রাখতে পারবে না। বৃদ্ধা এই টুকু বলে একটু দম নেবার জন্য থামলেন, তারপর নিচু স্বরে শাড়ীতে মুখ ঢেকে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলেন। বাবা, আমার চোখে ছানী পড়েছে, ছেলেরা নাকি কেউ আমার চিকিৎসা করাতে পারবে না। ওদের বাবা মারা যাওয়ার পর কত কষ্ট করে আমি ওদের মানুষ করলাম।

এখন তারা বড় বড় অফিসে চাকরি করে। আমি নিজেও শিক্ষিত, স্কুলে ও বাসায় ছাত্র পড়িয়ে কত কষ্ট করে ওদের বড় করেছি। আজ এই পেলাম তার প্রতিদান। বৃদ্ধা এই টুকু বলে দম নেবার জন্য আবার একটু থামলেন, তারপর আবার শুরু করলেন। বাবা, কখনো ওদের এমন শিক্ষা দেইনি আমি, তবে কোথায় পেল তারা এই শিক্ষা? বৃদ্ধার কথা শুনে মনে কষ্ট পেলাম।

যুবকটি বৃদ্ধাকে প্রশ্ন না করলে হয়তো নিজে থেকে কখনই বৃদ্ধাকে প্রশ্ন করতাম না, আর তাহলে বৃদ্ধার কষ্টের কথা কখনো জানাও হত না আমার। বৃদ্ধার ছেলেদের প্রতি ঘৃনা জন্মালো মনে। আমি হলে কি অমনটি করতাম? কে জানে? হ্য়তবা হ্যাঁ, হ্য়তবা না !!! বৃদ্ধা তার ছেলেদের বাবা-মাকে অবহেলার শিক্ষা দেননি, দিয়েছে আমাদের লোভী ও সার্থপর সমাজ। বৃদ্ধার মত মানুষগুলো আজ এই সমাজে জঞ্জাল। যত তারাতারি এই জঞ্জাল গুলো বিদায় হয় ততই যেন শান্তি এই সমাজের।

নানী, আড়ং এসে গেছে। এখন নেমে ডান দিকে কিছুদুর এগুলেই আসাদগেট। যুবকটি মহিলাকে নামিয়ে দিয়ে এসে বৃদ্ধার ছেড়ে যাওয়া সিটটায় বসে পড়ল। আমি আবার জানালা দিয়া বাইরে দেখায় মনযোগ দিলাম। আমাদের বাসটি সিগনালে আটকে আছে।

টায়ারের হঠাৎ শব্দ সাথে কোন এক নারীর চিৎকারে ভাবনার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে এলাম । পাশের যুবকটির মুখে কোন ভাবান্তর দেখা গেল না। কে জানে, হয়ত বৃদ্ধা মহিলাটির সন্তানদের জন্য আজ এক বড় সুসংবাদ অপেক্ষা করছে, যা তারা মনে-প্রানে চাইত এতদিন। আসলে কি ঘটেছে দেখার আগ্রহ মনে জাগলোনা আমার। ইট-লোহার এই শহরে আমি যেন নিজেও এক মষ্ত পাথরের পিরামিড।

হয়তবা আমি একাই নই, হয়তবা সবাই। সিগনাল ছেড়ে দিয়েছে, বাস চলতে শুরু করেছে, সাথে আমিও জানালার বাইরের লাল-নীল আলো গুলো দেখায় ব্যাস্ত হয়ে গেলাম। *************************************************

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।