আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শোষণের মুখোশ ও স্বাধীনতার শত্রু-মিত্র



শোষণের মুখোশ ও স্বাধীনতার শত্রু-মিত্র ফকির ইলিয়াস ================================= ‘আচ্ছা বাংলাদেশে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতিতে বয়সটা কী কোনো ফ্যাক্টর? তাহলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পেছনে এমনভাবে লাগা হচ্ছে কেন?’ তার প্রশ্নটি শুনে চমকে উঠি। তিনি নিউইয়র্ক নিউনিভার্সিটির একজন অর্থনীতির অধ্যাপক। ড. ইউনূসকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন। জানেন তার কর্মকাণ্ড বিষয়েও। আমি তার প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে পারি না।

কথাটাতো মিথ্যে নয়। বাংলাদেশে একজন রাজনীতিক আজীবনই রাজনীতিক। ক্ষমতাচ্যুত হলেই তারা ক্ষেপে উঠেন। কর্মসূচি দেন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। বলা দরকার, ড. ইউনূস এ সময়ে বহির্বিশ্বে নানাভাবে আলোচিত হচ্ছেন।

গ্রামীণ ব্যাংক থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়ার পর পশ্চিমা দেশগুলো ভ্রূ কুঁচকে তাকাচ্ছে বাংলাদেশের দিকে। ঢাকাস্থ দূতরা সদলবলে হাজির হয়েছেন প্রেসব্রিফিংয়ে। একটি জাতিসত্তার প্রতি একজন ব্যক্তি কিংবা কোনো গোষ্ঠী কতোটা অনুগত তা নির্ভর করে তার মৌলিক আচরণ প্রকাশের ওপর। আচরণটিও দুরকম হতে পারে। একটি লোক দেখানো, অন্যটি আত্মিক।

যারা মনেপ্রাণে কোনো জাতিসত্তাকে স্বীকার করে, কল্যাণ চায় এবং ভালোবাসে তাদের দেশপ্রেম নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকে না। প্রশ্ন ওঠে তাদের দেশপ্রেমের প্রতি, যারা মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে কিন্তু ভেতরে ভেতরে সুযোগ খোঁজে জাতিসত্তাকে ধ্বংস করে দেয়ার। মূলত এদের শ্রেণী চরিত্রটি হচ্ছে আত্মপ্রতারকের। তারা একটি দেশে অবস্থান করেও ব্যস্ত থাকে সে দেশের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রে। তারা রাষ্ট্র এবং জনগণের পিঠে ছুরি মেরে নিজেদের কায়েমি রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

গণতন্ত্রে বহুমতের সংজ্ঞা আছে অনেক। সেই সংজ্ঞারই একটি স্মরণ করে দিয়েছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ। বুশ বলেছিলেন, আমি জানি অনেকে আমার ভালো চান না। তারা যদি ক্ষোভে আমার কুশপুত্তলিকা কিংবা ছবি পোড়ান, তাতে আমার কিছুই যায় আসে না। কিন্তু আমি দুঃখ পাই যখন দেখি কোথাও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা পোড়ানো হচ্ছে।

মনে রাখা উচিত, মার্কিনি পতাকা কোনো দোষ করেনি। অন্যান্য দেশের পতাকার মতো মার্কিন পতাকারও নিজস্ব সম্মান রয়েছে। ইরাকে যুদ্ধ শুরুর তৃতীয় বর্ষপূর্তি উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট বুশ আরো বলেছিলেন, মনে রাখা উচিত যুক্তরাষ্ট্র যা করছে তা কংগ্রেস কিংবা সিনেটের অনুমোদন নিয়েই করছে। তা লুকানো কিছু নয়। কংগ্রেস এবং সিনেট থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ার পরই প্রেসিডেন্ট কোনো সিদ্ধান্ত নেন।

বুশ বলেছিলেন, গণতন্ত্রের অন্যতম পরিপূরক হচ্ছে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে নিজের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্যই সংগ্রাম করছে এবং নিজেদের স্বার্থের পক্ষে কাজ করছে। এটা কে না জানে স্বাধীনতা হচ্ছে মানুষের অন্যতম জন্মগত অধিকার। কিন্তু সেই স্বাধীনতা যদি প্রতিনিয়ত কোনো অপশক্তি দ্বারা শাসিত হয় তবে তা কতোটা অর্থবহ হতে পারে? এ প্রসঙ্গে মহাত্মা মি. এডওয়ার্ড সাঈদকে আবারো স্মরণ করা যেতে পারে। সাঈদ বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতার শত্র“রা তৎপর থাকে দিনরাত।

আর স্বাধীনতাভোগীরা তৎপর থাকে শুধু দিনেরবেলা। তাই ওই শত্রুরা মাঝে মাঝে মহাপরাক্রমশালী হয়ে উঠতে পারে। ’ বাংলাদেশের আজকের অবস্থাটি হয়েছে ঠিক তাই। ভোগবাদী একটি চক্র দেশকে গ্রাস করতে চাইছে, যারা আদৌ এই দেশকে, এই মাটিকে ভালোবাসে না। তাদের যোগসূত্র অন্যদের সঙ্গে।

তারা চায় চল্লিশ বছরের এই স্বাধীন দেশটাকে ঔপনিবেশিক মৌলবাদীদের হাতে তুলে দিতে। আর এদের সঙ্গে আছেন আলখেল্লা পরা অনেক সুশীলও। দুই. নানা কারণেই দেশ গত কমাসে বারবার ফুঁসে উঠেছে। শেয়ারবাজারে ধস, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি অন্যতম ইস্যু। তার ওপর আবার ইউনূস অপসারণ বিষয়টি আলোচনায় আসছে বিভিন্নভাবে।

দেখা যাচ্ছে, এসব ইস্যুকে পুঁজি করে মাঠে নামছে একটি অশুভ চক্র। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র রেদওয়ান নিহত হওয়ার পর ঢাকায় ব্যাপক গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ, বাংলাদেশের সঙ্গে ক্রিকেটে জেতার পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলোয়াড়দেরকে বহনকারী বাস ইটপাটকেলের শিকার হয়েছে। এটা কেমন সভ্যতার নিদর্শন? কারা এটা করছে? এদের মতলব কী? এসব ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। বলেছেন, প্রতিবাদের ভাষা সংযত হওয়া দরকার।

এসব রাষ্ট্রীয় শত্রুদের চিহ্নিত করার প্রক্রিয়া এবং মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এদেরকে ‘রাষ্ট্রের শত্রু’ বলার হিম্মত দেশের সুশীল সমাজের কতোটা আছে সে বিষয়ে আমি কিছু প্রশ্ন তুলতে চাই। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে দুরকমের স্বার্থপরতা রয়েছে। একটি হচ্ছে তাৎক্ষণিক ভোগবাদিতা। আর অন্যটি হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদী ভোগবাদিতা। যারা চাঁদাবাজি, টেন্ডার টানাটানি করে দুপয়সা কামানোর ধান্ধা করছে এরা হচ্ছে তাৎক্ষণিক ভোগবাদী।

আর যারা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায় এগিয়ে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে এরা হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদী সুদূরপ্রসারী ভোগবাদী। ভাবতে অবাক লাগে এই ভোগবাদী শক্তির বিরুদ্ধে কেউই কিন্তু সোচ্চার হচ্ছেন না, যতোটুকু সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন। মনে পড়ছে, ‘যোগ্য প্রার্থী আন্দোলন’ নামে দেশের কৃতী ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূস কবছর আগে ঢাকার বিলাসবহুল হোটেল বলরুমে বেশকিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরেছিলেন। ড. ইউনূসের এই বক্তব্য তাৎক্ষণিক ধন্যবাদ পেয়েছিল। নোবেল লরিয়েট এই ব্যক্তিত্বের রাজনীতিতে আসার খায়েশ, কিংবা তার লেখা ২০১০ সালের বাংলাদেশের সম্ভাব্য চিত্রাবলি, সবই মানুষের নজর কেড়েছিলো।

কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংকের কাজকর্ম ছাড়া তিনি অন্যকোনো মাঠে কোনো সফলতাই দেখাতে পারেননি। বরং বিতর্কিত হয়েছেন, হচ্ছেন। শেষমেশ, একটি রাজনৈতিক দলের প্রতি তার আনুগত্য, সখ্য বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত হওয়ার পর, বর্তমান সরকার তার বিগত খতিয়ান খুঁড়ে দেখতে বেশ তৎপরই হয়েছে বলা যায়। যা এখন প্রধান বিরোধীদল ইস্যু বানিয়ে আন্দোলন করার পথ খুঁজছে। ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে তার এক সময়ের কিছু সহকর্মীও নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন, যারা একসময় বিভিন্ন মেয়াদে গ্রামীণ ব্যাংকের বিভিন্ন পদে ছিলেন।

এসব বিষয়গুলোরও সত্যতা আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার। যদি থাকে, তা হলে ইউনুস কেন এসব করেছেন তার জবাবও পাওয়া প্রয়োজন। তিন. দেশের বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ তথা প্রতিটি স্বাধীনতাকামী মানুষের একটি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব রয়েছে। আর তা হচ্ছে, আগে শত্রু পক্ষকে চিহ্নিত করা। স্বাধীনতার ৪০ বছর পর যারা তেল ও পানি একসঙ্গে মিশাতে চেয়েছিলেন তাদের তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

ভুল প্রমাণিত হওয়ায় ৬৪ জেলায় একযোগে হামলা করেছিল জঙ্গিরা। কারণ স্বাধীনতার মিত্ররা তাদেরকে ক্ষমা করে দিলেও শত্র“রা তাদের পরাজয়ের গ্লানি এখনো ভুলতে পারেনি। আমরা বাঙালিরা আসলেই আত্মভোলা জাতি! যদি না হতাম তবে অনেক ঐতিহাসিক সত্যই আমরা ভুলে যেতাম না। ২৬ মার্চ কিংবা ১৬ ডিসেম্বর আমাদেরকে সে সব সত্য বারবার মনে করিয়ে দেয়। ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গান গাইতে আমাদের বুক কাঁপে।

যে ভারতের ১০ হাজার মিত্রবাহিনীর সৈন্য তাদের প্রাণ দিয়েছিলেন আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে সেই ভারত আমাদের অনেকের গায়ের কাঁটা। যে ভারতের প্রতিটি নাগরিক কর দিয়ে আমাদের ১ কোটি শরণার্থীকে সাহায্য করেছিলেন সেই ভারতকে আমরা কথায় কথায় গালি দিই। কী আশ্চর্য জাতিসত্তা আমাদের। তাই বলে আমি বলছি না, ভারতের কোনো চোখ রাঙানি আমরা মেনে নিবো। অথচ বাংলাদেশের ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো চারদলীয় জোটের ব্যানারে যখন রাষ্টক্ষমতায় ছিল, তখন নেপথ্যে তারাও ভারত তোয়াজ কম করেনি।

ক্ষমতাচ্যুত হলেই ভারত তাদের শত্র“ হয়ে যায়। সত্যি কী সেলুকাস! বাংলাদেশের এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, ইউনূস ইস্যুতে বলেছেন, বয়স হলে যেতে হয়। তাকে প্রশ্ন করি, এই পরিশুদ্ধ রেওয়াজটা সর্বক্ষেত্রে গড়ে উঠছে না কেন? আমাদের চারপাশে শোষণের মুখোশ আগে ছিল। এখনো আছে। এর ছায়াতলেই বেড়ে উঠেছে আমাদের স্বাধীনতার শত্র“পক্ষ।

খবর বেরিয়েছে, ইসলামী ব্যাংক নাকি বাংলাদেশে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের জন্য মোটা অংকের টাকা ঢেলেছে। এই ব্যাংকটি কাদের? কারা আছেন এর পরিচালনা পর্ষদে। তা কি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অজানা? ভাবতে খুব অবাক লাগে, আমাদের প্রগতিশীলরা এভাবেই হারেন। আর জিতে যায় আমাদের স্বাধীনতার শত্রুপক্ষ। নিউইয়র্ক, ৯ মার্চ ২০১১ ---------------------------------------------------------------------- দৈনিক ভোরের কাগজ / ঢাকা / ১২ মার্চ ২০১১ শনিবার


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.