বাংলাদেশকে একটি সৃজনশীল জাতি হিসাবে দেখতে চাই।
কী লিখব, ভেবে না পাই। কিন্তু খুব ইচ্ছে করছে কিছু একটা লেখার। আকাশে কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে। চাঁদের মায়াটা বড়ই মধুর।
চাঁদের আলোটা জানালা দিয়ে আমার পড়ার টেবিলের ওপর উঁকি দিচ্ছে। অন্যদিকে ঝিঁঝি পোকার ঝিঁঝিঁ শব্দে মুখরিত চারদিক।
গ্রামের নাম গোটকান্দি। তার পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে তিতাস নদী। নদীর চারপাশটা কাশফুলে ছেয়ে গেছে।
অদ্ভুত সুন্দর!
আমি আর খুকি দুজনে কত ঘুরেছি ওপথে। খুকি হচ্ছে আমার সবচেয়ে আদরের ছোট বোন। তেমন কিছু ও বুঝে না। আমতা আমতা করে কথা বলে। এক দিন বেরিয়ে পড়ি।
রাস্তাটা মাটির। শহরের মতো যানবাহন নেই। দু-একটা ভ্যানগাড়ি ছাড়া চোখে পড়ে না। মুক্ত বাতাসে আনন্দে নেচে বেড়ায় সাদা বলাকা।
হাঁটতে হাঁটতে খুকি বলে—ভাইয়া, ওই দেখো, পাখিটা ছোঁ মেরে একটা মাছ নিয়ে গেল।
ওই পাখির নাম কী জানো?
‘ওর নাম মাছরাঙা’—আমি বলি। খুকি হাঁটতে হাঁটতে আর হাঁটতে পারছে না। ক্লান্ত হয়ে গেছে তার শরীর। চলার শক্তি নেই। একসময় বলে ওঠে—ভাইয়া, আমি আর হাঁটতে পারছি না।
রাস্তার মাঝখানে একটা বিশাল আকৃতির বটগাছ। বটগাছের ছায়ায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিই। আমার কাঁধে ঝুলানো ব্যাগটাতে মা সাজিয়ে দিয়েছিল মুড়ি-মুড়কি। সঙ্গে কিছু নারকেলের পিঠাও। খুব মজা করে দুজনে খেয়ে বেরিয়ে পড়ি।
রাস্তায় চলতে চলতে চোখে পড়ে ছোট ছেলেমেয়েরা ঝুঁটি বেঁধে কাবাডি আর গোল্লাছুট খেলা করছে। সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলাম। রোদের চিকচিক আলো চোখে পড়ে। ঠিক দ্বিপ্রহর। নদীর ঘাটের কাছে আসি।
নৌকা নেই। ঘাটটা শূন্য হয়ে পড়ে রয়েছে। তাতে কি আসে-যায়। খুব ভালো একটা পরিবেশ যেন খুঁজে পাই। ঘাটের এক কোণে ছায়ার মতো এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা পুরোনো আমগাছ।
গাছের ছায়ায় নৌকার প্রতীক্ষায় কিছুক্ষণ বসি। হঠাত্ চোখে পড়ে দূর থেকে একটা নৌকা আসছে। মাঝি চমত্কার সুরে গান গেয়ে নৌকা বাইছে। মাঝির গানের সুরে যেন তিতাসের বুক আনন্দে ভরে ওঠে। মাঝি ধীরে ধীরে তার জীবনসঙ্গীকে নিয়ে নদীর ঘাটে ভেড়ায়।
তারপর দুজনে নৌকায় চড়ে রওনা হই। পানিতে ভাসছে পাতিহাঁস আর অনেক প্রজাতির ঘাস। চারদিকে সবুজের অরণ্য। ছোট ছোট ঘরবাড়ি চোখে পড়ে আর মনের ভেতর সৃষ্টি হয় অনেক রকমের কথার মালা। নৌকায় চড়ে দুপুরের খাবার খাই।
নদী পেরিয়ে ঘাটে নামি। ঘাটে কজন মহিলা কলসে করে পানি তুলছে। ছন্দের অপূর্ব দৃশ্য শোভা পায় তাদের মধ্যে। দারিদ্র্যের ভেতরও আরেক সৌন্দর্য।
কোনো একসময় খুকির চোখে পড়ে হেলাফুল (শাপলা)।
খুকি বলে, ‘ভাইয়া-ভাইয়া, ওই যে হেলাফুল। আমাকে কটা হেলাফুল এনে দাও না। ’ ছোট বোনের কথা কি কেউ ফেলতে পারে। প্যান্টটা মুড়িয়ে নিয়ে পানিতে নেমে পড়ি। আট-দশটা ফুল তুলে নিয়ে খুকির হাতে তুলে দিই।
খুকি হেলাফুল পেয়ে মহাখুশি। প্রশ্ন করি, ‘আরে খুকি, হেলাফুল দিয়ে তুই কী করবি রে। ’ উত্তরে খুকি বলে, ‘আমার পুতুলের বিয়েতে মালা গেঁথে পরিয়ে দেব। ইলিশ আর হেলাফুলের তরকারি রান্না করে খাওয়াব। আরও কত কি!’ বিকেল পেরিয়ে গোধূলি এসে যায়।
পশ্চিমের আকাশে লাল রঙের বেলা হেলে পড়ে। পাখিরা দলবেঁধে কিচিরমিচির করে আপন কুলায় ফেরে। গ্রামে লোকজন গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি ঘরে তোলে। কেউ কেউ রান্না-বান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। দাদিবাড়ির একটু আগে এক দূর-সম্পর্কের চাচার বাড়ি।
বাড়ির পাশে এসে আমি চিত্কার করে বলি—চাচি, চাচি, কী তরকারি? রাস্তা যে ঘ্রাণে ভরে যায়। চাচি আমার কণ্ঠ শুনে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। বলেন, ‘বাব্বা! কত দিন পর গ্রামে এলি। তোদের দেখে যেন বুকটা জুড়িয়ে গেল। তোর যখন ১৫-১৬ বছর বয়স, তখন তোকে দেখেছিলাম।
এখন তো ২৫ বছরের যুবক হয়েছিস। অনেক বড় হয়েছিস রে। আর এই পিচ্চিটাকে তো দেখিনি। শুনেছিলাম, ও তখন এক মাসের শিশু। চাচি খুকিকে বলে, ‘মা তোর নাম কী রে?’
‘আমার নাম খুকি।
’
কদিন গ্রামে থাকি। গ্রামটা ঘুরে-ফিরে দেখি। মানুষজনের দুঃখ-শোকের কথা শুনে মনটা বড়ই অবাক লাগে। মানুষের এত কষ্ট! তার মধ্যে তারা এত আনন্দে থাকে।
আনন্দেই দিনগুলো কাটছিল।
কাজের জন্য বাড়ির দিকে ফিরতে হবে। এ জন্য ঝলমল রোদ দেখে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ি। রাস্তায় শহরের মতো কোনো যানবাহন নেই, তাই হেঁটে যাত্রা শুরু করি। নদী পার হয়ে হঠাত্ আকাশ অন্ধকার হয়ে এল। চারদিকে মেঘের ছটায় ভরে ওঠে।
ঝরঝর করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। কিছুতেই বৃষ্টি কমছে না। খুকিকে নিয়ে একটা আমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অস্থির হয়ে উঠি। প্রায় তিন থেকে চার ঘণ্টা পর বৃষ্টি কমে। খুকি থরথর করে কাঁপতে লাগল।
আমি খুবই চিন্তিত হয়ে পড়ি। কোনোমতে ঢাকায় ফিরে আসি। সেই রাতে খুকির গায়ে প্রচণ্ড জ্বর। কত বড় বড় চিকিত্সক দেখাই, তাঁরা কিছুই করতে পারলেন না।
আমি আর ওর কথা বলতে পারছি না।
বুকটা কেমন জানি করছে। অস্থির হয়ে উঠছি। চোখ ছলছল করছে। আমি আর বসে থাকতে পারছি না। ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি।
বারান্দার বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে চেয়ে দেখি তারাগুলো মিটমিট করে জ্বলছে। মনে হচ্ছে তারার চোখে বুঝি খুকির ছবি ভাসছে। আর আমাকে ভাইয়া ভাইয়া বলে ডাকছে.
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।