গল্পটি ২০৪৫ সালের প্রেক্ষাপটে :
গিগাবিটের মন আজ খুব ভাল, সকাল থেকেই ফুরফুরে মেজাজে খেলছে। মেইনবোর্ডের চিপ গুলো এক এক করে সাজাচ্ছে, আবার তুলে একটার জায়গায় অন্যটা বসাচ্ছে, আবার সেগুলো আগের জায়গায় রাখছে। এ এক অদ্ভুত খেলা। কিন্তু বিট সেটাকে এমনভাবে খেলছে, যেন কতগুলো মাটি টেনে দলা বানাচ্ছে, আবার সেটা ভেন্গে দিচ্ছে। বিট আমার ছেলে, এবং একমাত্র।
পুরো নাম গিগাবিট, আদর করে সবাই ডাকি বিট বলে। বয়স্কজনেরা এ ধরনের নাম নিয়ে আপত্তি তুললেও সেটা মাথায় নয়ার সময় আমার বা আমার স্ত্রীর কারোরই নেই। মানুষের নাম যুগে যুগে পরিবর্তন হয়েছে যুগের হাওয়ার বদলের সাথে সাথে। প্রযুক্তির যুগে তাই প্রযুক্তি সম্পর্কিত নামটাই যেন সবদিকেই বেশ বাজার পাচ্ছে। গিগাবিটের বন্ধু বান্ধবদের নামও এমন, এপোলো, এন্ড্রোমিডা আরও কত কত নাম।
মনে হয় চিপ দিয়ে পাজল বানানো খেলা শেষ, দৌড়ে এসে আমার কোলে ঝাপিয়ে পড়ল, আগে থেকে প্রস্তুত ছিলাম বলে সামলাতে পেরেছি নইলে ওর ঝাপ দেয়ার এত গতি ছিলো যে দুজনেই মাঝেতে লুটিয়ে পড়তাম। বললাম, কিরে ভালইতো খেলছিলি, হঠাৎ বাবার কোলে ঝাপিয়ে পড়ার কি হল? ছোট্ট বিটের আবদার, বাবা ডাইনী বুড়ির গল্প বলো, ছেলের কথা শুনেতো আমার আক্কেল গুড়ুম। বলে কি ছেলে? প্রযুক্তির এই যুগে বিটমাটির পুতুলের বদলে চিপ, ট্রান্সমিটার নিয়ে খেলছে, আর আমার কাছে এসে আবদার করছে ডাইনী বুড়ির গল্প শোনার জন্য? দীর্ঘ নিঃশাস ছাড়লাম, বুঝলাম, মানুষ যতই চাদ সূর্যকে জয়করুক, মহাকাশ চষে বেড়াক, ভূত-প্রেত আর ডাইনী বুড়ীরা তাদের পিছু ছাড়ছেনা। মুখমন্ডলে রাগের একটা ভাব এনে কড়া গলায় বললাম, তুমি কি মনে কর ডাইনী বুড়ী বলে কিছু আছে?? থাকলে বল তার অবস্থান কোথায়? তার আপেক্ষিক ভর কত, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু ছেলে আমার নাছোড় বান্দা, ডাইনী বুড়ী সে আজ শুনেই ছাড়বে।
বিগ্গ্যান মানুষকে আর কিছু না করুক, একগোয়ে বানিয়ে দিয়েছে, ফলাফল না মেলার আগ পর্যন্ত তার রক্ষা নেই। আমারো আজ মনে হয় রক্ষা নেই, ছেলে ডাইনী বুড়ী শুনেই ছাড়বে। আমিও নিরুপায় হয়ে শুরু করলাম আমার জানা ডাইনী বুড়ীর গল্প।
বহূ বছর আগের কথা। যখন মানুষরা শুধু চাদ, সূর্য আর মন্গল গ্রহ নিয়েই মেতেছিলো, তখনকার কথা।
সবুজ দেশ নামে এক দেশ ছিলো, সবুজ গাছপালা আর নির্মল বাতাসের কারনেই ওটার নাম ছিলো সবুজ দেশ। দেশের মানুষের বেশীর ভাগই ছিলো ক্ষেতে খামারে কাজ করে দুবেলা দুমুঠো ভাত খেত। সকালে গরু নিয়ে মাঠে চলে যেত, সন্ধায় হাট থেকে বাজার করে নিয়ে আসত। সারাদিন কাজ করে যা পেত, সন্ধা বেলা সেটা দিয়ে বাজার করে এনে রান্না করে খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ত, পরের দিন সকালবেলা আবার একিইভাবে কাজে যেত। একেক জন একেক ভাবে রোজগার করত।
কেউ ক্ষেতে, কেউ মিল কারখানায়, কেউ দোকান-বাজারে। এভাবেই সুখে শান্তিতে চলছিলো সবুজ দেশের মানুষের দিনকাল। হঠাৎ একদিন সেই দেশের উপরদিয়ে উড়ে যাচ্ছিলো ক্ষুধার্থ দুই ডাইনী বুড়ী। দুটোরই প্রচূর বয়স হয়ে গিয়েছিলো। এর মধ্যে একটা রুপ যৌবন কিছুটা তখনো ধরে রেখেছিলো, আর অন্যটা মোটামোটি বুড়ীই হয়ে গিয়েছিলো।
তারদের সাথে ছিলো তাদের সন্তানেরা। ছেলে সন্তান। বিট এমন সময় আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, বাবা ডাইনী বূড়ীর ছেলেরাতো নিশ্চই তাদের মায়ের মত ছিলো না, তাদের কি নামে ডাকা হত? আমি দীর্ঘশাঃস ছেড়ে বললাম, এই ডাইনী বুড়ীদের ছেলেরাও তাদের মায়ের মতই ছিলো, ওরা ছিলো বাটপার রাজপূত্র। তারপর আবার শুরু করলাম গল্প। তো ডাইনী বুড়ীরা ছানা-পানা সহ উড়ে যাওয়ার সময় দেখল নীচে সবুজ দেশে মানুষেরা কত সুখে শান্তিতে বসবাস করছে, দেখে বুড়ীদের ক্ষিদে লেগে উঠল উঠল, ছানাগুলোও কঁও কঁও করে উঠল।
তার মানে তাদের মনেও চেটেপুটে খাবার খায়েশ জাগল। কিন্তু তাজা রক্ত কিভাবে খাবে সেই চিন্তায় তারা পেরেশান হয়ে উঠল। কারন একজন দুজনকে না হয় ঘাড় মটকে খাওয়া যাবে, কিন্তু দুদিন পর আবার কোথায় পাবে রক্ত? কারন দু একজন মরলেইতো রাতারাতি পাহারা বসে যাবে রাস্তায় রাস্তায়, পরে সবাই মিলে ধরে তাদের মেরেও ফেলতে পারে। তো কিভাবে কি করা যায় তা নিয়ে ডাইনী বুড়ীরা চিন্তা করতে লাগল। অনেক চিন্তা করে এক বুদ্ধি তারা বের করল, তারা নিচে নেমে এসে সবুজ দেশের মানুষদের সাথে সাধারন মানুষের মত মিশে যাবে।
তারপর তারা দুইজন সেই সহজ সরল মানুষদের বিভিন্ন খারাপ বুদ্ধি দিয়ে দুদলে বিভক্ত করবে। তারপর দুদলে যুদ্ধ বাধিয়ে দেবে, দুদলে যখন নিজেরা নিজেরা যুদ্ধ করে রক্তপাত করবে তখন সেই রক্তে মোটামুটি নিজেদের এবং ছেলে সন্তানদের দুবেলা দুলিটার খাওয়ার বন্দোবস্ত হয়ে যাবে। সবুজ দেশে তারা নেমে এল এবং যথারিতী দুটো দল বানালো। একটা দলের নাম দিল আ, আরেকটার নাম দিল বি। তাদের বুদ্ধিমত সরল বেচারা সবুজ দেশের মানুষগুলো রাত দিন একে অপরের সাথে যুদ্ধে লেগে রইল, আর প্রতিদিনই একে অন্যের রক্তপাত করতে লাগল, আর ডাইনী বুড়ী আর তার ছানা গুলো খাবারের জন্য এ চিন্তা করার প্রয়োজন হলনা।
নিশ্চিন্তে তারা প্রাসাদে শুয়ে শুয়ে দেখতে লাগল কিভাবে একে অপরের রক্ত ঝরিয়ে তাদের জন্য নিয়ে আসছে।
গল্প শেষ করে দেখলাম বিট দৌড়ে আবার চিপগুলোর কাছে চলে গেছে, হয়ত সে ভালো করে বোঝেই নি আমার গল্পের সারমর্ম, তাই হয়ত তাকে সেভাবে ভাবায়নি। ছোট্ট বিট না বুঝলেও, অনেক বছর পর সেসব মনে করে আমার কিছু দীর্ঘশাঃসের অপচয় হল।
নারী দিবসে তাই সেইসব মা (যারা জীবনে অন্তত একটিবার হলেও সন্তান জন্ম দিয়েছেন), তাদের কাছে আর্জি। আপনারা কি দেখছেন না কিভাবে আপনাদের স্বার্থ চরিতার্থে কত মায়ের বুক খালি হয়ে যাচ্ছে? আপনাদের বাড়ী অথবা আত্মীয় হারালে আপনাদের চোখের পানি পড়ে, কিন্তু আপনাদের চোখের সামনে হাজার হাজার লাশের স্তুপে কি কখনো এক ফোটা চোখের পানি ফেলেছেন??
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।