লিবিয়ার পরিস্থিতি ভিন্নরূপ ধারণ করতে চলেছে। সেখানে অভ্যন্তরীণ জনবিক্ষোভের পাশাপাশি এবার বহিঃহস্তক্ষেপের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনসহ একাধিক দেশ এরই মধ্যে লিবিয়া অভিমুখে যুদ্ধজাহাজ প্রেরণ করেছে। এর মধ্যে কিছু কিছু সুয়েজ খাল অতিক্রম করেছে এবং লিবিয়ার সম্ভাব্য অভিযানে প্রস্তুতিও গ্রহণ করেছে। লিবিয়াকে ঘিরে এই যখন সর্বশেষ অবস্থা, তখন গাদ্দাফির কথা না হয় বাদ দেয়া যাক।
খোদ লিবিয়া পরিস্থিতি নিয়েই এখন এক মহা আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণ কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি এক জিনিস (তা সে যে কোনো ঘটনাই ঘটুক), আবার সেই পরিস্থিতিকে ঘিরে বা সেই পরিস্থিতির সুযোগে বাইরের হস্তক্ষেপ আরেক জিনিস। কারণ এসে সংশ্লিষ্ট দেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিতেও পারে। লিবিয়া কি এ মুহূর্তে সেই অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে? সেখানে এখন বাইরের হস্তক্ষেপের বা আক্রমণের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণ সেখানকার পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকলে এই বাইরের হস্তক্ষেপের কোনো আশঙ্কাই থাকত না বা সুযোগও থাকত না।
যেমন বলা যায়, গাদ্দাফির এতদিনকার রাজত্বকাল তা সে একনায়কতন্ত্র হোক আর যাই হোক, সেখানে পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকায় কেউ সেখানে হস্তক্ষেপের সুযোগ পায়নি। কিন্তু যেই না লিবিয়ায় জনবিক্ষোভ দেখা দিয়েছে, আর যায় কোথায়! এই তো সুযোগ, পাঠাও যুদ্ধজাহাজ লিবিয়া অভিমুখে। এতদিন পর তো সুযোগ পাওয়া গেছে। জনবিক্ষোভের সুযোগে এবার অতি সহজেই গাদ্দাফিকে কুপোকাত করা যাবে। সুতরাং আর দেরি নয়।
একথা সত্য যে, গাদ্দাফি দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে ক্ষমতায় আছেন। আমি যখন ছোট, সেই তখন থেকেই কর্নেল গাদ্দাফির কথা শুনে আসছি। সুদানের নিমেরি আর লিবিয়ার কর্নেল গাদ্দাফি। যাই হোক, গাদ্দাফি দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় আছেন। জনসমর্থন না থাকলে অবশ্যই থাকতে পারতেন না, এটাও ঠিক।
তাকে বহুবার ক্ষমতা থেকে সরানোর চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু পারেনি। তো এই ২০১১ সালে এসে তিনি আরও ক্ষমতায় থাকতে চান, এটা তো আর সবাই মানবে না। গাদ্দাফিকে সময়ের বাস্তবতাটা বুঝতে হবে। তিনি বলেছেন, জনগণ তাকে ভালোবাসে। এ কথাটাও একেবারে উড়িয়ে দেয়ার জো নেই।
আবার এতে অতি আবেগেরও কোনো স্থান নেই। কারণ আবেগ এক জিনিস আর বাস্তবতা এক জিনিস। গাদ্দাফি হয়তো তার স্মৃতিচারণে অতি আবেগের মধ্যেই বসবাস করছেন। যার জন্য বর্তমানে তার দেশে যে প্রচণ্ড জনবিক্ষোভ শুরু হয়েছে, তা তিনি বুঝতে পারছেন না। তিনি ভাবছেন জনগণ তাকে এখনও ভালোবাসে।
হয়তো ঠিক। আবার জনগণই হয়তো এখন আর তাকে চাচ্ছে না, এটাও তো সময়েরই বাস্তবতা। গাদ্দাফি হয়তো তা অনুধাবন করতে পারছেন না। আর পারছেন না বলেই হয়তো এই বিক্ষোভকে দমন করার জন্য তিনি বা তার অনুগত বাহিনী এখন লিবিয়ায় বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। এদিকে গাদ্দাফি নিজেও ক্ষমতা না ছাড়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন।
তিনি হয়তো নিজেও জানেন এটি একটি কঠিন পথ। কিন্তু তারপরও সিদ্ধান্তে অটল রয়েছেন। সর্বশেষ খবর অনুসারে রাজধানী ত্রিপোলি এখনও তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে রাজধানীর আশপাশের শহরগুলোতে সরকারি বাহিনী ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে প্রচণ্ড সংঘর্ষ চলছে। এখন পর্যন্ত লিবিয়ায় ৬০০ হাজার লোক নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে।
বিক্ষোভকারীরা কিছু কিছু শহরের নিয়ন্ত্রণ নিলেও সেখানে সরকারি বাহিনীর পাল্টা আক্রমণের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সরকারি বাহিনী বিক্ষোভকারীদের ওপর বিমান হামলাও চালিয়েছে। তবে পরিস্থিতি যেভাবে গড়াচ্ছে তাতে কর্নেল গাদ্দাফি অতি সহজেই ক্ষমতা ছাড়বেন বলে মনে হয় না। কারণ মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক কিছুটা ভীতু স্বভাবের হলেও লিবিয়ার কর্নেল গাদ্দাফি সম্পূর্ণ অন্য জিনিস। তিনি সামরিক বাহিনীর লোক।
কাজেই অতি সহজেই যে অন্তত ভয় পেয়ে ক্ষমতা ছাড়বেন বা দেশত্যাগ করবেন, তা মনে হয় না। মনে হচ্ছে, তিনি অন্তত বাইরের শক্তির সঙ্গে কিছুটা লড়বেন। সবাইকে একহাত দেখেই তবে হয়তো ছাড়বেন। বাকিটা ভবিষ্যতের হাতে।
আগেই বলেছি, লিবিয়ার পরিস্থিতি একান্তই সে দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।
সমগ্র উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইদানীং যে জনবিক্ষোভ শুরু হয়েছে, লিবিয়াও এর বাইরে নয়। কিন্তু কথা হলো অন্যখানে। আমরা মিসরের পরিস্থিতি দেখলাম। সেখানে হোসনি মোবারককে ক্ষমতা ছাড়ার জন্য শেষ মুহূর্তে বাইরে থেকে চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে। বলা যায় অনেকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও।
কিন্তু লিবিয়ার ব্যাপারে তা যেন অন্যরূপ। মোবারক ছিলেন পাশ্চাত্যের পছন্দের লোক। তাই তাকে পদত্যাগে বাধ্য করার জন্য কোনো যুদ্ধজাহাজ তো দূরের কথা, এক ফোঁটা বন্দুকের গুলিও পর্যন্ত বাইরে থেকে ছোড়া হয়নি। কিন্তু গাদ্দাফির ব্যাপারে একেবারে উল্টোটা। সেখানে এখন তাকে উত্খাতের জন্য বাইরে থেকে রীতিমত যুদ্ধজাহাজ পাঠানো হয়েছে।
কারণ একটাই। গাদ্দাফি পাশ্চাত্যের পছন্দের লোক নন। বরং বলা যায় এক নম্বর শত্রু। কাজেই তাকে উত্খাতের ব্যাপারে ভেতরের বিক্ষোভকারীদের তুলনায় বাইরের শক্তিগুলোরই আগ্রহটা যেন বেশি। কারণ তারা অনেকদিন থেকেই গাদ্দাফিকে উত্খাতের জন্য চেষ্টা করে আসছেন।
কিন্তু সফল হননি। এবারই প্রথম এসেছে একটা মোক্ষম সুযোগ। তাই এত তড়িঘড়ি করে শুরু হয়েছে লিবিয়া অভিমুখে যুদ্ধজাহাজ প্রেরণের প্রতিযোগিতা। ঘটনাবলি দেখে এখন পরিষ্কার মনে হচ্ছে, ভেতরের চেয়ে বাইরের আগ্রহটাই বেশি। তবে একথা ঠিক, এই বাইরের হস্তক্ষেপ বা আক্রমণ লিবিয়া পরিস্থিতির উন্নয়নে কতটুকু প্রভাব ফেলবে, তা আপাতত বলা মুশকিল।
বরং পুরো পরিস্থিতিটাই বুমেরাং হয়েও দেখা দিতে পারে। জনবিক্ষোভে গাদ্দাফির পতন যতটুকু দ্রুত হওয়ার কথা ছিল, তা না হয়ে বরং গাদ্দাফির হাতকেই শক্তিশালী করা হয়েছে। বাইরের হস্তক্ষেপের ফলে যখন যুদ্ধ লেগে যাবে, তখন সেটা অন্য রূপও ধারণ করতে পারে। লিবিয়া তার সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে উল্টো আন্তর্জাতিক সমর্থন চাইতে পারে। এরই মধ্যে বেশক’টি দেশ লিবিয়াকে তথা গাদ্দাফিকে সমর্থনও করেছে।
সুতরাং লিবিয়া আগামীতে গৃহযুদ্ধ নাকি সরাসরি বাইরের শক্তির সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হবে, তা এ মুহূর্তে মন্তব্য করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
পরিশেষে আমরা আশা করব, লিবিয়ার পরিস্থিতি যেন কোনো সংঘাতের দিকে আর না যায়। দেশটিতে দ্রুত স্থিতিশীলতা ফিরে আসুক। দেশটির জনগণই সিদ্ধান্ত নিক গাদ্দাফি ক্ষমতায় থাকবেন কি থাকবেন না। এই সুযোগে লিবিয়ার সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে যেন কোনো আশঙ্কা না দেখা দেয় সেটাই কাম্য।
কারণ গাদ্দাফির চেয়ে লিবিয়ার সার্বভৌমত্বই লিবিয়ার জনগণের কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত। আর এই বিষয়টি লিবিয়ার জনগণ যত দ্রুত বুঝবেন ততই মঙ্গল। এর ব্যত্যয় ঘটলে লিবিয়ার জনগণেরই ভোগান্তি বাড়বে, অন্য কারও নয়। কাউকে নয়। এই উপলব্ধিটিই লিবিয়ায় এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
সূত্র : মাহ্মুদ ইলাহী মণ্ডল / আমার দেশ ৮/৩/২০১১
আরো একটি সংবাদ ----- আমাদের সময় ৮/৩/২০১১
লিবীয় বিদ্রোহীদের অস্ত্র দিতে সৌদি আরবকে বলেছে যুক্তরাষ্ট্র
মাহ্ফুজ রাহমান: লিবিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপের বিষয়টি নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকলেও বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ রয়েছে ওবামা প্রশাসনের। বিক্ষোভকারীদের অস্ত্র সরবরাহের জন্য সৌদি কর্তৃপক্ষকে অনুরোধও করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। ব্রিটিশ দৈনিক দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক প্রতিনিধি রবার্ট ফিস্ক এসব তথ্য জানিয়েছেন। ইন্ডিপেন্ডেন্টে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ফিস্ক এসব তথ্য জানান। প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, সৌদি কর্তৃপক্ষকে মার্কিন সামরিক বাহিনীর সঙ্গে এ বিষয়ে সহায়তা ও যোগাযোগ বাড়ানোর অনুরোধ করেছেন ওবামা।
রিপোর্টে বলা হয়, সৌদি বাদশা আব্দুল্লাহ নিজেও গাদ্দাফিকে অপছন্দ করেন। একবছর আগে তাকে গুপ্তহত্যার চেষ্টাও করেছিল সৌদি আরব। ফিস্ক জানান, লিবীয় বিদ্রোহীদের অস্ত্র সরবরাহে রাজি সৌদি আরব। উল্লেখ্য, প্রতিবেশী দেশগুলো মধ্যে একমাত্র সৌদি আরবের পক্ষেই লিবীয় বিদ্রোহীদের অস্ত্র সরবরাহ করা সবচে সোজা। এ অস্ত্র বিদ্রোহীদের দখলে থাকা বেনগাজিতে পাঠানো তাদের পক্ষে সহজ হবে।
তারা যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়েছেÑ বিরোধীদের এ মুহূর্তে ট্যাংক বিধ্বংসী রকেট মর্টার ও বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র দরকার। এদিকে বেশ কয়েকটি মার্কিন অ্যাওয়েকস গোয়েন্দা বিমান গত ৪৮ ঘণ্টা মাল্টার আশপাশে ঘোরাঘুরি করেছে। মাল্টার এয়ার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছে। গত ৪৮ ঘণ্টায় গাদ্দাফির ব্যক্তিগত বিমানের জর্ডান গমন এবং সেখান থেকে ফিরে আসার বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চেয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
ফিস্কের ধারণা, ওবামা প্রশাসনের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে সৌদি আরব যদি লিবীয় বিদ্রোহীদের অস্ত্র সরবরাহ করে তাহলে সৌদি আরবে বিক্ষোভের সমর্থন দেয়ার নৈতিক সমর্থন হারাবে যুক্তরাষ্ট্র।
এমনকি সৌদি আরবে বিক্ষোভের নিন্দা জানানোও অসম্ভব হয়ে পড়বে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য। এককথায় লিবীয় বিদ্রোহীদের পরোক্ষভাবে সামরিক সহায়তা করতে সৌদি সরকারের সহায়তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য, অন্যদিকে এ পথে এগুলে সৌদি বিক্ষোভের প্রতি সমর্থন দান থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হবে যুক্তরাষ্ট্র।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।