love to singing
এই বিচার আওয়ামীলীগের জন্যই মরণ ফাঁদ হতে পারে
ঢাকা, ৬ মার্চ (শীর্ষ নিউজ ডেস্ক): ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময়ে এসে একদল সশস্ত্র লোক চক্ষু সার্জন ও স্বাধীনতা কর্মী ডা. আলীম চৌধুরীকে অপহরণ করে। অপহরণের কয়েকদিন পর একটি গণকবরে ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় ড. চৌধুরীর দেহ পাওয়া যায়। তার চোখগুলো তুলে নেয়া হয়েছিল।
তার হত্যাকারীরা পাকিস্তানের সমর্থক মিলিশিয়া বাহিনীর সদস্য ছিল। যাদের কখনো শাস্তি দেয়া হয়নি।
তাদের মধ্যে একজন মাওলানা আবদুল মান্নান। সরকারের তদন্ত অনুসারে জানা যায়, মাওলানা মান্নান এ ধরণের হত্যায় সহায়তার কথা স্বীকার করেছেন। একসময় তিনি বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীও হয়েছিলেন। মাওলানা মান্নান ২০০৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
বর্তমানে সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ৪০ বছর পরে মানবতা বিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিচার করতে চাচ্ছে।
বিচারের এ উদ্যোগ আন্তার্জাতিক আইনের একটি ধাঁধা সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে একটি নতুন ও দুর্বল দেশ কি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য এর নিজস্ব নাগরিকদের বিচার করতে পারবে?
মানবতা বিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের অনেকেই এখনো শুধু জীবিতই নয় বরং তারা দু'টি প্রধান বিরোধী দলের নেতা পর্যায়ের সদস্য এবং তারা দীর্ঘ সময় ক্ষমতায়ও ছিল।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বিভিন্ন ধরণের অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে যে ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে তারা প্রত্যেকেই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। সরকার তাদের নিজস্ব তৈরিকৃত ট্রাইব্যুনালে আগামী কয়েকমাসের মধ্যেই তাদের বিচার করার প্রত্যাশা করছে।
বাংলাদেশের ট্রাইব্যুনাল খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে এবং হয়ত এর ব্যাপক উপলক্ষ থাকবে।
সুদান থেকে শুরু করে শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত যেসব উন্নয়নশীল দেশের সরকারকে মানবতা বিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছে তারা যুক্তি দেখিয়েছেন যে, আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল শুধু বেছে বেছে দুর্বল দেশগুলোর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় এবং এটাও নতুন এক ধরণের সাম্রাজ্যবাদ। বাংলাদেশে একটি সফল, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ বিচার গুরুত্বপূর্ণ মডেল হতে পারবে বলে বিচার বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেছেন।
কিন্তু এটা খুব সহজ হবে না। অবশ্য, আন্তর্জাতিক বিচারের সম্পূর্ণ ধারণাটি এ বাস্তবতার উপর নির্ভর করে যে, তীব্র দ্বন্দ্বের পরিণামে জাতীয় আদালতগুলোকে সম্ভবত পক্ষপাতদুষ্ট বিচার প্রদান করার জন্য রাজনৈতিকিকরণ করা হবে।
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের আন্তর্জাতিক বিচার বিষয়ক বিশেষজ্ঞ রিচার্ড ডিকার বলেন, মানবাধিকারের প্রেক্ষিতে আপনি জাতীয় কর্তৃপক্ষের নিকট এসব অপরাধের বিচার চাইতে পারেন।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আদেশসহ চিন্তার বিষয় রয়েছে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার অনিশ্চিত। যেখানে রাজনীতিকে খুব গভীরভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক করা হয়, রাজনীতি মেরুকরণের ব্যবসায় নিমজ্জিত। এখানে যাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে তাদের প্রায় সকলেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক শত্রু।
সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও এ বিচার সম্পন্ন করা দরকার ।
আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেন, একটি সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে মানবতা বিরোধী অপরাধের যারা শিকার তারা ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা করছেন।
তবে হেনরী কিসিঞ্জার এ ইস্যুটিকে বছরের পর বছর অবজ্ঞার ছলে পড়ে থাকা ইস্যু আখ্যায়িত করে মন্তব্য করেন, বাংলাদেশ এখন স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির যুগ অতিবাহিত করছে। পুরাতন ইস্যুকে সামনে নিয়ে আসাটা তার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের জন্য সুখকর নয়। বর্তমান সরকার ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিপুল বিজয় অর্জন করে এবং দেশ সেনা সমর্থিত সরকারের কবল থেকে মুক্ত হয়ে পুনরায় গণতন্ত্রে ফিরে আসে। সরকারের কর্মকর্তারা বলছেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের ক্ষত শুকানো একটি সংকটপূর্ণ পদক্ষেপ হবে।
বাংলাদেশের সরকার সুষ্ঠু বিচারের অঙ্গীকার করেছে এবং স্বাধীনভাবে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য পশ্চিমা সরকার ও যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত স্টিফেন র্যাপসহ আন্তর্জাতিক কর্মকর্তাদের সহায়তা চেয়েছে। জানুয়ারিতে মি. র্যাপ সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে বলেন, স্থানীয় সেটিংয়ে কীভাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ নিয়ে কাজ করতে হয় সে ব্যাপারে বাংলাদেশ মডেল হতে পারে।
তিনি বলেন, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এসব ঘটনা জাতীয় পর্যায়ে ঘটে, ভিকটিমের খুব নিকটে ঘটে। এতে যারা অভিযুক্ত তাদের পরিবারের সদস্যদেরও কাছ থেকে এটা ঘটে। তারা এ বিচার খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করতে পারে ।
মি. ডিকার বলেন লাতিন আমেরিকার কিছু দেশে যুদ্ধাপরাধের সফল বিচার সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় ট্রাইব্যুনালের ক্ষেত্রে যে বিপদ হয় তার উদাহরণ হলো ইরাকের সাদ্দাম হোসেন ও তার সহযোগীদের বিচার। সাদ্দামের বিচার থেকে শুরু করে ফাঁসি অবধি যে দৃশ্য সেলফোনের ভিডিওতে ধারণ ও প্রচার করা হয়েছিল সেখানে বিজেতার বিচারের প্রতিই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং শিয়াপন্থিদের ঘৃণা প্রকাশ পেয়েছে।
বাংলাদেশের বিরোধী দলের রাজনীতিবিদরা বলছেন, এ ধরণের বিচারের ফলাফল বিভক্তিকে আরো খারাপের দিকে নিয়ে যাবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেন, আমরা এখন বুঝতে পেরেছি যে, এ সরকারের পক্ষে পক্ষপাতহীন ও সুষ্ঠুভাবে যুদ্ধপরাধের বিচার করা সম্ভব হবে না।
তার দলের একজন প্রবীণ নেতাও মানবতা বিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত। বাকি অভিযুক্তরা সবাই জামায়াতে ইসলামীর নেতা। দলটি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানকে সমর্থন করেছে এবং মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করে। যে বাহিনী হাজার হাজার লোক হত্যার দায়ে অভিযুক্ত।
ব্রিটেন যখন ভারতকে বিভক্ত করে তখন মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তানের অধীনে দেয়া হয়।
এ অংশটি পাকিস্তান থেকে ১ হাজার মাইলেরও বেশি দুরত্বে অবস্থিত ও পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন একটি অঞ্চল ছিল। ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ সংখ্যক আসনে জয়লাভ করে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা বাঙালির নেতৃত্বে একটি দলকে সরকার গঠন থেকে বঞ্চিত করে। এ সংকট থেকেই ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরি হয়। সামরিক বাহিনী স্বাধীনতা আন্দোলনে নৃশংস হামলা চালায়।
যুদ্ধের মোট মৃতের সংখ্যা এখনো অজ্ঞাত। তবে লক্ষ লক্ষ বেসামরিক লোক নিহত হয়, হাজার হাজার নারী ধর্ষিত হয় এবং কয়েক মিলিয়ন লোক ভারতে পালিয়ে যায়।
ওই বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে এবং যারা পাকিস্তানিদের সহায়তা করেছে সরকার তাদের বিচারের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু অশান্ত নতুন দেশ বিশৃঙ্খলা ও স্বৈরতন্ত্রের কবলে পড়ে।
১৯৭৫ সালে সেনাবাহিনী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান প্রায় সপরিবারে নিহত হন।
নিঃস্ব প্রায় ও বারংবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ আক্রান্ত বাংলাদেশ সামরিক ও বেসামরিক শাসনে দোলায়িত হয় এবং অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
ফলশ্রুতিতে, বাংলাদেশ পাকিস্তানি অনুগত ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যকার বিরোধ মেটাতে পারেনি। জামায়াতে ইসলামীর একজন প্রবীণ নেতা ও আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেন, স্বাধীনতার বিরোধিতা করা কোন অপরাধ ছিল না। তিনি বলেন, এটা শতভাগ সত্য যে, তারা পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন, তারা আল্লাহর নিকট একটি অখ- পাকিস্তানের জন্য প্রার্থনা করেছেন। কিন্তু এটা শতভাগ অসত্য যে, তারা যুদ্ধাপরাধে জড়িত ছিল।
অন্যান্য বিরোধী নেতাদের মতো তিনিও বলেন, বাংলাদেশের নোংরা রাজনৈতিক পরিবেশে সুষ্ঠু বিচার অসম্ভব।
মানবতা বিরোধী অপরাধের ক্ষেত্রে আরেকটি জটিল ফ্যাক্টর হল-মৃত্যুদ-। আন্তর্জাতিক আদালত সবসময়ই এটাকে এড়িয়ে গেছে। অধিকাংশ পশ্চিমা দেশ মৃত্যুদ- সমর্থন করে না। যার কারণে অভিযুক্তদের মৃত্যুদ- প্রদানের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অন্যান্যদের নিকট থেকে সমর্থন পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে।
মানবতা বিরোধী অপরাধের যারা শিকার তারা বলছেন, অভিযুক্তদের মৃত্যুদ- দেয়া অপরিহার্য। যাতে পরবর্তী সরকার তাদেরকে আর মুক্তি দিতে না পারে।
এ প্রসঙ্গে শাহরিয়ার কবির বলেন, আপনি কি জানেন না খালেদা জিয়া পরবর্তীতে যখন ক্ষমতায় আসবেন তখন অভিযুক্তদের মুক্তি দিয়ে দিবেন? তারা সবসময় অপরাধীদের মানবাধিকারের জন্য কান্না করেছে। কিন্তু ভিকটিমদের মানবাধিকারের ব্যাপারে কী করেছে?
চক্ষু সার্জন ডা. আলীম চৌধুরীর মেয়ে নুজহাত চৌধুরী বলেন, আমার পিতার হত্যাকারী যদিও মৃত। তবু ১৯৭১ এর যুদ্ধাপরাধের জন্য কারো শাস্তি হচ্ছে এটা দেখে যেতে চাই।
নুজহাত চৌধুরী বলেন, আমার পিতার খুনিকে এ দেশের মন্ত্রী হতে দেখেছি। আমরা আলীম চৌধুরীর সন্তান হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতে ভয় পেতাম। এ কষ্ট লাঘব করার জন্য আমরা বিচার চাই।
(শীর্ষ নিউজ ডটকম / মাবি /এআইকে/ এসসি/২০.৪০ঘ.)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।