দু’হাজার চার সালে ‘জেন্ডার’ বিষয়ক একটি প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছিলাম, যাতে ‘জেন্ডার’ ও ‘সেক্স’ বিষয় দ’ুটো যে সম্পূর্ণ পৃথক প্রপঞ্চ, তা জীবনে প্রথমে বুঝতে পারি। বর্ণিত প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে জেন্ডার, সেক্স, নারীর অধিকার, ক্ষমতায়ন, পুরুষতন্ত্র, নারীর বঞ্চনা, নারীর প্রতি সামাজিক পারিবারিক রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বৈষম্য, লৈঙ্গিক রাজনীতি, পিতৃতন্ত্র, জেন্ডার লেন্স, জেন্ডার রিসার্স ইত্যাদি বিষয়ে প্রচলিত ধারণার বিপরীতে আমার এক নতুন চিন্তন জগত সৃষ্টি হয়, যা আমাকে মানুষ হিসেবে নারীর মর্যাদাকে সুষ্পষ্ট ও উন্নততর হিসেবে চিনতে সহায়তা করে। জ্ঞানমূলক আনন্দপূর্ণ বর্ণিত প্রশিক্ষণের একটি বিষয় ছিল ‘নারী হিসেবে জন্ম নেয়ার সুবিধা’। এতে নারী ও জেন্ডার বিশেষজ্ঞ তথা প্রশিক্ষকগণ বলতে চেয়েছেন যে, নারী হয়ে পৃথিবীতে জন্ম নিলে একজন মানুষ মা হতে পারে, বিভিন্ন সাজসজ্জা করতে পারে, সন্তান ধারণ করতে পারে, পুরুষের চোখে নিজেকে আকর্ষণীয় তথা মোহনীয় করে তুলতে পারে, পুরুষকে নাচাতে পারে, বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে নিজেকে তুলে ধরতে পারে ইত্যাদি ‘বহুবিধ সুবিধাদি’। যা একজন পুরুষ কখনোই পেতে পারেনা কিংবা কদাচিৎ পারে কেবল কিছুটা ‘বায়োলজিক্যাল ফ্যাক্টর’ ব্যতিত।
প্রশিক্ষণে অংশ গ্রহণ থেকে ফিরে আসার পর থেকেই আমার চিন্তনধারায় নতুন করে এদেশের বঞ্চিত নারীদের দেখতে থাকি। আমার ধারণা জন্মেছিল পুরুষতান্ত্রিক শোষক সমাজই নারীকে শৃঙ্খলিত করার অপমানসে ‘সেক্স’ আর ‘জেন্ডার’কে একাকার করে নারীকে বঞ্চিত করেছে ন্যায়ত ‘সপ্তপদী অধিকার’ থেকে। কিন্তু প্রকৃতির সৃষ্টিশীলতা আর নারীর প্রতি প্রকৃতিরও ‘বিমাতা-শুলভ’ আরচণ বিশ্লেষণে এখন দেখতে পাচ্ছি ও মনে হচ্ছে, নারীকে শুধু পুরুষই ঠকায়নি, প্রকৃতিও নানাভাবে তাকে ঠকিয়েছে যত্রতত্র। প্রকৃতির সৃষ্টিশীল ‘হারমোনি’তে শুধু ‘ফিমেল মানুষকে’ই প্রকৃতি ঠকায়নি, অন্যান্য প্রায় সকল প্রাণীর ‘ফিমেল’ গোত্রের প্রতিই প্রকৃতি কমবেশী ‘অবিচার’ তথা বৈষম্য করেছে হয় ইচ্ছেকৃত নতুবা নিজ খেয়ালের বসেই। কিন্তু যেভাবেই করুক কাজটি আলটিমেটলি গিয়েছে ‘ফিমেল গোত্রের বিপক্ষে’।
মনুষ্য প্রজাতির ‘ফিমেল বৈষম্য’ নিয়ে আলোচনার পূর্বে প্রাককথন হিসেবে দেখা যেতে পারে অন্য প্রাণীদের প্রতি প্রকৃতির ‘ফিমেল বৈষম্যটি’, যা তাদের সমাজ, ধর্ম বা রাষ্ট্রসৃষ্ট নয়, প্রকৃতিই তাদের প্রতি আরোপ করেছে বৈষম্যটি বিভিন্ন অনুসঙ্গে। যেমন হর্ন বা শিং হচ্ছে একটি প্রাণীর আত্মরক্ষার অন্যতম হাতিয়ার। একটি পুরুষ হরিণের আত্মরক্ষার হর্ন থাকলেও, একটি মহিলা হরিণ কিংবা হরিণীর আত্মরক্ষার হাতিয়ার থেকে তাকে বঞ্চিত করেছে প্রকৃতি নিতান্তই অবিবেচকের মত। প্রাণীকূলের মধ্যে প্রায় সকল শ্রেণীর পুরুষ প্রজাতির আত্মরক্ষার হর্ন-টি থাকলেও, অনেক মহিলা প্রজাতির মধ্যেই হর্ন-টি নেই। আবার পুরুষ ‘ওয়াইল্ডবিস্টের’ হর্ন-টির তুলনায় মহিলা ‘ওয়াইল্ডবিস্টের’ হর্ন-টির আকৃতি প্রায় ৫০% ছোট।
একটি সিংহের গড় ওজন ৪১৬ পাউন্ড হলেও, মহিলা সিংহটি তথা সিংহীর গড় ওজন হচ্ছে ২৭৭ পাউন্ড। পুরুষ ও মহিলা সিংহের আয়তনের অনুপাত হচ্ছে ৩ঃ২। একটি বাঘের গড় উচ্চতা ১২ ফুট হলেও, মহিলা বাঘ তথা বাঘিনীর গড় উচ্চতা সাধারণত ৮ ফুটের বেশী নয়। একটি পুরুষ কুকুরের তুলনায় মাদী কুকুর সব সময়ই সাইজে ছোট হয়ে থাকে। একটি পুরুষ ও মহিলা গরু-শিশুকে একই যতেœ ও পরিবেশে লালন পালন করলেও, যৌবনকালে ষাঁড়টি গাভীটির তুলনায় সাইজে বড়, শক্তিতে প্রবল, আক্রমনাত্মক, তেজী, মোটা ঘাড় ও চুট ইত্যাদিতে গাভীটিকে অবশ্যই হারিয়ে দেয়।
একটি পুরুষ হাতির গড় উচ্চতা ৩.২ মিটার হলেও, মহিলা প্রজাতির সবচেড়ে বড় আকৃতির হাতিটির উচ্চতা হয় সর্বোচ্চ ৩ মিটার। তা ছাড়া বুক, ঘাড়, পা ইত্যাদিও একটি মাদী পশুর তুলনায় একটি নর পশুর সাধারণত বড় হয়ে থাকে। শক্তিমত্ততায়ও একটি পুরুষ পশু তার সমগোত্রীয় নারী পশুর চেয়ে বেশী শক্তি ধারণ ও প্রকাশ করে, যদিও মানুষের মত শ্রেণী বৈষম্য, আভিজাত্য, শোষক ও শোষিত, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, সাম্প্রদায়িকতা, সন্ত্রাসবাদ, ভাষিক বৈষম্য, রাজনীতি ইত্যাদি ধারণাগুলো থেকে তারা নিতান্তই মুক্ত।
নারীবাদী তথা জেন্ডারবাদীগণ নারীর প্রতি নানাবিধ বঞ্চনা আর বৈষম্যকে কেবল পুরুষ আর ধর্ম শাসিত সমাজ কর্তৃক আরোপিত বলা হলেও, বিষয়টি কিন্তু পুরোপুরি তা নয়, যদিও পুরুষ শাসিত সমাজ আরোপিত নানাবিধ নিগড় চক্রে নারী নিতান্তই বন্ধী এদেশীয় অন্ধকার এবং পশ্চিমা আলোকিত সমাজেও! ‘শারিরীক শক্তিতে নারী দুর্বল’ একথা নারীবাদীরা মানতে না চাইলেও, একথা দৃঢ় এবং রূঢ়ভাবে সত্য যে, প্রকৃতিও নারীকে ‘ঠকিয়েছে’ নানা চক্রাবৃত্তে। ২০-বছর বয়সী একটি নারী ও পুরুষ শাপদ পরিবৃত্ত জঙ্গলে পাশাপাশি হাটার সময় কোন হিংস্র জন্তুর হঠাৎ আক্রমনে পুরুষটি যেভাবে দৌঁড়ে পালাতে পারবে কিংবা গাছে চড়ে করতে পারবে আত্মরক্ষা, নারীর ভারী বুক ও অন্যবিধ ‘জটিল’ শারীরিক গঠনের কারনে সেভাবে পালানো নারীর পক্ষে হবে কষ্টকর ও দুরূহ।
আত্মরক্ষার ঝঙঝ চিৎকারটি পুরুষটির ভরাট মোটা কণ্ঠে যতদূর থেকে সহজে শোনা যাবে, নারীর নিক্কন ধ্বনির সুরেলা কণ্ঠ ততদূর পৌঁছবে কি? পুরুষের শারিরীক গঠনের দৃঢ়তা এ ক্ষেত্রে পশুর সঙ্গে লড়াইয়ে যতটা সহায়ক হবে, নারীর শারিরীক কোমলতা ততই নারীর বাঁচার জন্যে হবে বিপদজনক। দৌঁড় ইত্যাদি প্রতিযোগিতায় নারীরা পুরুষের থেকে প্রাকৃতিক কারনেই পিছিয়ে বলে, আজকের একুশ শতকের নারী-সাম্যের এই ‘পিক সিজনেও’ বিশ্বকাপ ফুটবল, ক্রিকেট ইত্যাদি জাতীয় দলে কেবল পুরুষরাই প্রাধান্য বিস্তার করে খেলছে, নারীকে রাখা হয়নি। এমনকি অলিম্বিকেও দৌঁড় কিংবা ভারত্তোলনে নারী ও পুরুষের জন্যে আলাদা আলাদা ‘গ্র“প’ করা হয়েছে। পুরুষের তুলনায় নারীর হার্ট ও লাঞ্চ কৃপণ প্রকৃতি ছোট আকৃতির বানালেও নারীর ক্ষোভ তাতে কিছুটা কমতো, যদি নারীকে প্রায় ৯-মাসেরও বেশী সময় একটি ‘অন্য প্রাণী সৃষ্টির কষ্টকর কাজ’টির দায়িত্ব প্রদান না করা হত। সন্তান সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় নারী ও পুরুষ সমভাবে ‘কাচামাল’ প্রদানে অংশ গ্রহণ করলেও, পরবর্তী অত্যন্ত কষ্টকর জীবন সংহারী উৎপাদন প্রক্রিয়াটির দায়িত্ব এককভাবে প্রদান করা হয়েছে নারীর উপর।
সেক্ষেত্রে সন্তান ধারণের প্রাথমিক পর্যায়েই নারীকে খুদামন্দা, ধারাবাহিক ক্লান্তিকর বমন, গ্যাস উৎপাদন ও নির্গমন ইত্যাদি নানাবিধ কষ্টকর পথ পাড়ি দিয়ে সামনে এগুতে হয় তাকে। ৯-মাসে সন্তান পরিপক্ক হওয়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত নারীর পদে পদে অতিক্রম করতে হয় নানাবিধ পঙ্কিল পিচ্ছিল পথ। সকল বিপদসঙ্কুল উত্তাল সমুদ্র ‘সাফল্যের সঙ্গে’ পাড়ি দেয়ার পর হাজির হয় সবচেয়ে বিপদজনক কাজ মানে জঠরের সন্তানটিকে বাইরে আনা। বাইরে আনার প্রক্রিয়ায় পিতার ১% জীবনহানীর রিস্ক বা কষ্ট না থাকলেও, নারীর থাকে ১০০%, তা সেটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বের করা হোক কিংবা পেট কেটেই। জন্মের পরও রেহাই নেই নারীর এই চরম ‘দায়িত্ববোধ’ থেকে, এক্ষেত্রে পুরুষের বুকে স্তন্য থাকলেও, প্রকৃতি তাকে বন্ধ্যা রেখে নারীর বুকেই দিয়েছে জন্মনেয়া শিশুটির ‘পুষ্টিকর’ খাদ্য, যে খাদ্য থেকে নারী বঞ্চিত করতে পারেনা তারই জঠর থেকে জন্ম নেয়া অসহায় শিশুটিকে।
সৃষ্টি জগতকে বাঁচিয়ে রাখার ‘চমৎকার’ এই অর্কেষ্ট্রায় সন্তান জন্ম দেয়ার এই ‘অপকর্মটির’ কারনে সেনাবাহিনীসহ অনেক পেশায় আবার নারীর প্রবেশাধিকারও রাখেনি স্বার্থপর শক্তিধর প্রজাতিটি, রাখলেও তা সীমিত করা হয়েছে নানা রীতি নীতিতে। নারীকে এতো ‘শাস্তি’ দেয়ার পরও প্রকৃতি নারীকে পুরস্কৃত করেনি মোটেও, বরং শাস্তির ধারা রেখেছে অব্যাহত। একজন পুরুষ যৌবনপ্রাপ্ত হওয়ার পর আমৃত্যু তার যৌবন তথা ফার্টিলিটি ক্ষমতা ধরে রাখতে পারলেও, নারীর মাঝ বয়সেই তাকে প্রাকৃতিক নিয়মে ত্যাগ করতে হয় প্রজনন ক্ষমতা। একজন পুরুষকে প্রকৃতি দৈনিক ২০০,০০,০০০টি ‘স্টেমসেল’ নামক ‘জীবন’ উৎপাদনের ক্ষমতা দিলেও, নারীকে দিয়েছে মাসে মাত্র ১টি, তাও আবার ৪০-৪৫ বয়স পর্যন্তই। একটি পুরুষ চাইলে কোন রিক্স ব্যতিরেকে ১০০০ সন্তানের পিতা হতে পারলেও, একজন নারী সর্বোচ্চ ২০-৩০টি সন্তানের মা হলেই তার জীবন রক্ষা নারীটির জন্যেই হয় ভয়াবহ।
একজন ভার্জিন নারী ও পুরুষের একসঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর পর্যায়ক্রমে ঐ দম্পতি পর পর কয়েকটি সন্তান নিলে, পুরুষটি পিতা হওয়ার পরও তার শারিরীক গঠন প্রায় পূর্ববৎ থাকলেও, ৩/৪টি সন্তান ধারণে নারীর শরীরটি আর পূর্ববৎ নিখুঁত থাকেনা। তখন নারীটির চোখে স্বামীটি আগের মতই ‘নিখুঁত’ থাকলেও, পুরুষটির চোখে স্ত্রীটি আগেরমত ‘আনকোড়া’ না থেকে হয়ে পড়ে পুরনো। ব্যাপারটি সন্তান ধারণ প্রক্রিয়ার জটিলতায় ঘটে, যার প্রেক্ষিতে পরকীয়াসহ নানাবিধ সমস্যা দেয়া দেয়, ব্যাপারটি অনেক নারীর পক্ষেই সামলানো অসম্ভব হয়ে পড়ে এবং এ ঘটনাটির জন্যেও নারীর প্রতি প্রকৃতির বৈষম্যমূলক আচরণই মূলত দায়ী।
সুতরাং এটি ষ্পষ্ট যে, নারীর প্রতি বৈশ্বিক পুরুষতান্ত্রিক সমাজই কেবল বৈষম্যের বিষবৃক্ষ রোপন করেনি, করেছে প্রকৃতিও। যে কারণে বিশ্বে প্রকৃতপক্ষেই মনুষ্য এবং অমনুষ্য শ্রেণীর ‘নারী’ হাজার হাজার বছর ধরে বঞ্চিত আসলে উন্নত এবং অনুন্নত, অন্ধকার আর আলোকিত সমাজেও! এবং এই ন্যাক্কারজনক কাজটির মূল হোতা পুরুষের চেয়ে প্রকৃতিই বেশী।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।