You can do anything, but not everything.
... অতঃপর একটা ১৩ নাম্বার বাস সামনে এসে দাঁড়ায়। তিল ধারণের জায়গা নেই ভিতরে। তবুও হেল্পার দরজা ছেড়ে নেমে তারস্বরে চিৎকার করতে থাকে “এই গুলিস্তান;প্রেসক্লাব; মতিঝিল মতিঝিল মতিঝিল ”। ঠেলে ঠুলে উঠে পড়ি দরজা ধরে। এগুতে থাকে বাস।
আমার ঠিক সাম্নেই একটা বাচ্চা মায়ের কোলে বসে প্রকট শব্দে চিৎকার করতে থাকে; আর মা টা ধমক দিয়ে বাচ্চাকে শান্ত করতে ব্যাস্ত। আমি ডুবে যাই কল্পনায় !!! টুপ করে চলে যাই একেবারে শুরুতে; সে...ই ক্লাস শুরুর দ্বিতীয় দিনে; কলেজ শেষে যখন প্রবল বৃষ্টি; পুরো মতিঝিল যখন পানির নিচে !!! এক হাতে ছাতা; এক হাতে জুতো আর লম্বা হয়ে যাওয়া ব্যাগের রশি টেনে উপরে তুলতে তুলতে শার্ট প্যান্ট পুরোটাই ভেজা। ভিজে ভিজে শাপলা চত্বর এসে একটা বাসেও ওঠার উপায় নেই; কোন রিকশাও খালি নেই। যা পাই তাও প্রবল প্রতিযোগিতায় হারিয়ে যাই !!! কত যুদ্ধ করে যে একটা বাসে ঝুলে ঝুলে সেদিন বাড়ি ফিরেছিলাম !!! স্মৃতির রাজ্যে বোধহয় খারাপদের রাজত্বই বেশি; নয়ত প্রথমেই এইরকম একটা ছোটখাট বিভীষিকার কথা মনে আসবে কেন?!!
বাস ধুঁকতে ধুঁকতে শাহবাগ এসে পোঁছায়; আমিও কল্পনার রাজ্য হামাগুড়ি দিয়ে আর পদার্থবিদ্যার নীতি মেনে ধীরে ধীরে বাসের মাঝের দিকে পৌছে যাই। এর মধ্যে হেল্পার এসে ভাড়া নিয়ে গেছে।
আমার সাম্নেই এক বুড়ো চাচা মোবাইলে তার দেশে থাকা বউ এর সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছেন। তার গরুটার স্বাস্থ্য ঠিক আছে কি না; তাকে নিয়মিত খাবার দেওয়া হচ্ছে কি না – সেই খবর নিচ্ছেন সারা বাসকে জানিয়ে। আমি আবার ডুবে যাই কল্পনায়। বন্ধু সজীব একদিন দুষ্টুমি করে ব্যাগে নষ্ট কলম থেকে কালি লাগিয়ে দিয়েছিলো। প্লাস্টিকের ব্যাগ থেকে সেই দাগ শত চেষ্টাতেও পুরোপুরি তুলে ফেলা যায় নি।
গোটা ৬ মাস আমার সঙ্গী ছিল সেই দাগপড়া ব্যাগটা। রাগ করে সজীবের সাথে দুই সপ্তাহ কথাই বলি নি !!! কি ছেলেমানুষই না ছিলাম সে সময় !!! এখন আর ওর সাথে তেমন যোগাযোগ নেই। আমার কথা হয়ত ভুলেই গেছে; কিংবা মাঝে মাঝে হয়ত এমন করে মনে করে !!! মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে হয় সে সময়টা আমার নতুন করে শুরু করতে; এখন যা যা মিস করি সেগুলো শখ মিটিয়ে করে আসতে !!!
এগিয়ে যায় বাস; এবং এক সময় থেমেও যায়; একেবারেই। শুরু হয় মৎস্য ভবনের জ্যাম। বাস একেবারে ইঞ্জিন বন্ধ করে ঠায় দাড়িয়ে যায়।
অনেকেই নেমে হাটা শুরু করে। আমিও ঠেলেঠুলে পৌছে যাই একেবারে শেষ মাথায়। জানালার পাশে একটা সিটও পেয়ে যাই সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যক্রমে। মাথার উপর প্রচন্ড রোদ নিয়ে চোখ বন্ধ করে ডুবে যাই স্মৃতির চোরাগলিতে !!!!
একে একে মনে পড়ে যায় ম্যাথ কুইজে জিরো পাওয়া বা হাফ ইয়ারলিতে ম্যাথে ফেল করে রিমেডিয়াল করার কথা !!! আমার জীবনে ওটাই ছিল প্রথম শুন্য পাওয়া; কিন্তু আশ্চর্য আমার মোটেও কষ্ট লাগে নি; খাতা পেয়ে নাম্বারটা দেখে আর বাকি খাতার দিকেও চোখ বুলাই নি; সুন্দর করে খাতা ভাজ করে ব্যাগে রেখে দিয়েছিলাম !!! আর রিমেডিয়াল তো ছিল জীবনের আরেকটা অধ্যায় !! সপ্তাহে ছয় দিন ক্লাস করার পর শুক্র শনি; সপ্তাহে ৭ দিনই কলেজে দৌড়ানো; আমার মতন নিতান্ত আলসে আর ঘরকুনো লোকের জন্য সে এক মহা শাস্তি !!!
ঘন্টাখানেকের বিরতির পর বাস চলা শুরু করে। একটু পর ধুকে ধুকে মৎস্য ভবনও পার হয়ে যায়।
আমার পাশে বসে থাকা লোকটাকে খুঁটিয়ে দেখি। মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক; মাথায় বেশ খানিক টাক; শার্টের বোতাম দুটো খোলা; হাতে একগুচ্ছ গোলাপ; হয়ত পরিবারের জন্য নিয়ে যাচ্ছেন। মানুষের বয়স বা অবস্থা যা-ই হোক; মনে ভালবাসা থাকলে সেটা যে কোন জায়গা থেকে যে কোনভাবেই প্রকাশ করা যায়। উনি জানালা দিয়ে বাইরে থাকিয়ে আছেন; দৃষ্টিতে কেমন একটা ব্যাকুলতা; হয়ত দ্রুত প্রিয়জনের কাছে পৌছানোর জন্য !!!
বাস চলতে থাকে; প্রেস ক্লাব পার হয়ে যায়। আমি মনে মনে অস্থির হয়ে উঠি; সবার সাথে দেখা করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে অল্প সময় আছে তা দ্রুত শেষ হয়ে আসছে।
ঘুরে ফিরে স্মৃতিতে ভাসতে থাকে সেই ইংলিশ ক্লাবের ক্লাবরুম; সেই বইগুলো; প্রতি সপ্তাহেই আমার একটা না একটা বই ইস্যু করা; সেই ক্লাবের এক্সিকিউটিভ কমিটির জন্য ইন্টারভিউ !!! কি অসাধারণ সময়ই না গিয়েছিল !!! কলেজের কিছু অনুস্থানে ক্লাবের স্টলরুমে বসে বিভিন্ন ভোকাবুলারি কার্ড; এই সেই বিক্রি করা; স্যার মেডামদের সাথে বন্ধুর মত আড্ডা দেওয়া – ঘুরে ফিরে কত কথাই মনে হতে থাকে !!!
দেখতে দেখতে পল্টনে চলে আসি; রাস্তা আস্তে আস্তে ফাকা হতে থাকে। বাসের ভিতরটা ফাকা হতে থাকে। পরিবেশটাও বদলে যেতে সময় লাগে না। আমার সাম্নের সিটের ভদ্রলোক একটা শত ভাজ পড়া “বাংলাদেশ প্রতিদিন” মেলে ধরেন। একসাথে ৩ মাথা ১ মাথা হয়ে পত্রিকা পড়তে থাকেন উনার পাশের দুইজন।
খানিক পর শুরু হয় চিরাচরিত “এই দেশটা কোথায় যাচ্ছে” টপিক্স নিয়ে আলোচনা। সামনে এবং পিছন থেকে আরও তিন-চারজন যোগ দেন সেই আলোচনায়। রৌদ্র তপ্ত বাসের আবহাওয়া আরেকটু গরম হয়ে উঠে সরব আলোচনায়। কিন্তু সে সব শোনার আমার সময় কই !!! আমার মন চলে যায় সেই ক্যান্টিনে; যেখানে দুপুরে খাবার খেতে খেতে ম্যাথ ল্যাব অথবা বায়োলোজি ল্যাব বই এর বারোটা বাজিয়ে ছাপ দিয়ে ছবি আকার কাজ শেষ করতাম। পাশেই চলত ব্যাডমিন্টন খেলা।
খেলাটার প্রতি আমার কখনই তেমন আকর্ষণ ছিল না; খেলেও দেখা হয় নি তাই কখনও। শুনলাম ক্যান্টিনটা নাকি ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে; ভার্সিটি করার জন্য। মনটা কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে গেল !!!
বাস এগিয়ে যেতে থাকে; এবার খানিকটা দুর্বার গতিতে। ড্রাইভার দুই তিনবার দুর্ঘটনায় পড়তে পড়তে বেচে যায়। বাসের গতির সাথে কেমন যেন জীবনের গতির একটা মিল খুজে পাই; কিংবা হয়ত আমার ক্লান্ত শরীরে ততোধিক ক্লান্ত মস্তিষ্ক মিল খোজার চেষ্টা করে যায়।
ধীরে ধীরে লোক কমতে থাকে; আলোচনার তেজও স্তিমিত হয়ে আসে। আমার মন ঘুরতে থাকে সেই কেমিস্ট্রি ল্যাব এ; সেই পিছনের লেকে; সেই ক্রিকেট খেলার শর্ট পিচে; সেই ক্লাসরুমে; সেই ব্ল্যাকবোর্ডে। একজন একজন করে স্যার মেডামদের মুখ ভেসে ওঠে। আমি সিটে হেলান দিয়ে বসে থাকি।
একসময় শাপলা চত্তর চলে আসে।
বাস থেমে যায়। ফুল হাতে সেই লোকটা আর তার উদাস দৃষ্টিকে পিছনে ফেলে আমি নেমে হাটতে থাকি। আমার মধ্যবিত্ত স্মৃতিগুলো পিছু নিয়ে চলতে থাকে আমার সাথে...
( আজ কলেজের আমার গ্রুপের ইফতার পার্টি এবং রি-ইউনিওন ছিল; গত ৩ বছরেও হয়েছিল; কিন্তু এই সেই করে কেন যেন আমার কোনটাতেই যাওয়া হয় নি; কলেজ ছেড়ে চলে আসার পর তাই এটাই আমার প্রথম সবার সাথে দেখা। বাসে মোটামুটি ২ ঘন্টার কিছু বেশি সময় লেগেছে কলেজে পৌছাতে; সেই সময় নানা স্মৃতি মনে আসতেছিল। একজনের স্মৃতি আরেকজনের কাছে ভাল না লাগাটাই স্বাভাবিক; তবুও ভাবলাম নিজের জন্যই লিখে ফেলি।
প্রচন্ড কষ্ট করে পৌঁছালেও পরের তিনটা ঘন্টা যেই রকম ভাল কেটেছে তাতে সকল কষ্টই ভুলে গেছি। এই লেখাটা তাই আমার কলেজ লাইফের সেই সব বন্ধুকে উৎসর্গ করা... )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।