রং হারানো ক্যারিবীয় ক্রিকেটের গা থেকে এখনো ক্রিকেট রোমান্টিসিজমের মৃদু সৌরভ ছড়ায়। তাই বিসিবি একাডেমী মাঠে ক্রিস গেইলের ব্যাটে ভেসে একের পর এক বল মিরপুরের আবাসিক এলাকায় হারিয়ে যাওয়ায় বিস্মিত হন সাংবাদিকরা। অথচ যাঁর কাছে মেলবোর্নের ৭৫ গজের লং-অন লং-অফও কোনো দূরত্ব নয়, তাঁর কাছে একাডেমী মাঠের বড়জোর ৩০ গজের সীমানা তো কোনো বাধাই না! তবু ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের বিলুপ্তপ্রায় ক্রিকেট চরিত্রের সম্ভবত শেষ প্রতিনিধি ক্রিস গেইলের অনায়াসে তুলে মারাও আকর্ষক। সে আকর্ষণে গেইলের সঙ্গে ফ্রেমবন্দি হওয়াও বিচিত্র নয়। ঢাকায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের প্রথম বিশ্বকাপ সকালের বড় ছবি এটাই।
বাংলাদেশ দলের ম্যাচ পরিকল্পনার বড় অংশজুড়েও ক্রিস গেইল। পার্শ্বচরিত্র অনেক। তবে ক্রিস্টোফার হেনরি গেইল যে একজনই!
কাল আধাবেলা প্র্যাকটিসের পর সন্ধ্যায় হোটেলে ভিডিও সেশনে ক্রিস গেইলের শক্তি এবং দুর্বলতার ময়নাতদন্ত করেছে বাংলাদেশ দল। তবে ২২৫ ওয়ানডে খেলে ফেলা ক্যারিবীয় এ ওপেনারকে তো কম দেখেনি বাংলাদেশ। মেজাজটা ঠিকঠাক থাকলে একাই প্রতিপক্ষকে জেরবার করে দিতে পারেন দীর্ঘদেহী এ ব্যাটসম্যান।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক ড্যারেন স্যামির ভবিষ্যদ্বাণী, 'এটা হবে গেইলের বিশ্বকাপ। ' প্রসঙ্গটা অন্যভাবে উড়ে গিয়েছিল আবদুর রাজ্জাকের কাছে। আয়ারল্যান্ড ম্যাচে নতুন বলে হাত ঘুরিয়েছিলেন। বাঁহাতি গেইলের বিরুদ্ধেও যদি অধিনায়ক আপনাকে এটা করতে বলে? প্রশ্নের আড়ালে প্রচ্ছন্ন আশঙ্কা। বাঁহাতি স্পিনার পেয়ে না জানি কত নির্দয় হয়ে ওঠেন গেইল! ক্রিকেট মাঠে স্লেজিংয়ের জন্য রাজ্জাকের সুখ্যাতি কিংবা কুখ্যাতি নেই।
বরং ক্রিজে গার্ড নেওয়ার সময় 'এই বাউন্সার দে', 'পাঁজরে মার', মন্তব্যগুলো মুখ বুজে সহ্য করেন তিনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচেও নতুন বলে বোলিং করার ব্যাপারে একই রকম শান্ত কিন্তু দৃঢ় বাংলাদেশের রাজ্জাক, 'ক্রিকেটে পিছিয়ে যাওয়ার কোনো পথ নেই। আমি বিশ্বাস করি পেছনে হাঁটতে গেলে হোঁচট খাওয়ার ঝুঁকি প্রবল। তাই সামনে হাঁটি। যেকোনো কিছুর জন্য আমি তৈরি।
' বাংলাদেশ দলে তারুণ্যের ব্র্যান্ডটা যেন এমনই টেকসই হয়!
কিন্তু ভয় ধরাচ্ছেন সৌরভ গাঙ্গুলী! বিখ্যাত কাভার ড্রাইভ, সাহসী অধিনায়কত্ব এবং লর্ডসের ব্যালকনিতে জার্সি ওড়ানোর মতো আরেকটি কারণে ক্রিকেট দুনিয়া আজীবন সেলাম জানাবে 'দাদা'কে। বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের সামনে বাঁহাতি স্পিনাররা স্রেফ পাড়ার বোলার; এ ধারণাকে প্রায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। তাই গেইল বনাম রাজ্জাকের দ্বৈরথ একপেশে হয়ে ওঠার আশঙ্কা করছেন মিরপুর স্টেডিয়াম থেকে বিশ্বকাপ উপলক্ষে বিতাড়িত ভেন্ডাররাও। আর বাংলাদেশ দলে তো ক্রিকেট মস্তিষ্কের অভাব নেই। বিকল্প হিসেবে তাই এসে যাচ্ছেন একজন অফস্পিনার।
যদি দক্ষিণ আফ্রিকার ইয়োহান বোথার মতো শুরুতেই অফস্পিনে গেইল বধ করা যায়! যেমনটা এক মৌসুম আগে প্রিমিয়ার লিগে সনাৎ জয়াসুরিয়াকে বলে-কয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন আবাহনীর অফস্পিনার নাসির হোসেন। কিন্তু গেইলকে পাওয়া যাবে ওয়ানডের সবচেয়ে বড় আসর বিশ্বকাপে। এ ম্যাচ হারলে মলিন হয়ে যাবে কোয়ার্টার ফাইনাল স্বপ্ন। এমন চাপের মুখে খণ্ডকালীন অফস্পিনে আয়ারল্যান্ড ম্যাচে চমক দেখানো মোহাম্মদ আশরাফুল কি সাহস করবেন গেইলকে বল করার? নাকি অফস্পিনার হিসেবে মাহমুদউল্লাহর চেয়ে অগ্রাধিকার পাওয়া নাঈম ইসলামকে 'ট্রাম্পকার্ড' হিসেবে ব্যবহার করবেন সাকিব আল হাসান? মুহুর্মুহু পরিবর্তনশীল বাংলাদেশ দলের ম্যাচ ভাবনায় শফিউল ইসলামের সঙ্গী বাছাইয়ে শেষমেশ রুবেল হোসেন কিংবা রাজ্জাকে আটকে পড়ার সম্ভাবনাই বেশি।
ক্রিস গেইল ফিকে হচ্ছেন তো সামনে এসে পড়ছেন কেমার রোচ।
২০০৯ সালে ঘরের মাঠে বাংলাদেশকে পেয়ে টেস্ট এবং ওয়ানডে সিরিজে ২৩ উইকেট নেওয়া এ ফাস্ট বোলার এখন বিশ্বকাপ হ্যাটট্রিকের স্বাদও পেয়েছেন। ঢাকায় প্রথম অনুশীলনে তাঁর গলার জোর আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন উপমহাদেশের এ মহা-আসরে পেসারদের অভাবিত সাফল্য দেখে, 'গতি থাকলে উইকেট কোনো বাধা নয়। ' লাসিথ মালিঙ্গা, মিচেল জনসনদের সাফল্য মনে করিয়ে দিয়েছেন রোচ। নিজে তো সামনে আছেনই! তাই 'চাবি' ঘুরিয়ে মিরপুরের কালো মাটির উইকেট যত ধীর গতিরই করা হোক না কেন, ৯০ মাইল বেগে বল করতে জানা রোচের তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। শুনে বাংলাদেশ দল সংশ্লিষ্ট একজন বাঁকা হাসলেন, 'দেখা যাবে! কোথায় বল ফেলে, দেখেছেন? হয় শর্ট বল নয়তো ওপরে।
' মিরপুরের উইকেটে খাটো লেন্থে বল করলে তার ঠিকানা মিড উইকেট। আর হাফভলির জন্য সোজা ব্যাটই যথেষ্ট। যদিও রোচের সঙ্গে বাংলাদেশের অতীত এবং রোচের বিশ্বকাপ সাফল্যের সঙ্গে এ মূল্যায়ন প্রতিবেদনের বিশেষ কোনো মিল নেই। ২০০৯ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে বিস্তর রান দিলেও তিন ওয়ানডেতে ১০ উইকেট নিয়েছিলেন রোচ। আর এই সেদিন নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে হ্যাটট্রিকসহ নিয়েছেন ৬ উইকেট।
তামিম ইকবাল-ইমরুল কায়েস উদ্বোধনী জুটির 'মধুচন্দ্রিমাই' রোচ সংহারে বাংলাদেশ দলের আস্থার জায়গা। বিশ্বকাপের দুই ম্যাচেও পঞ্চাশের বেশি রানের শুরু দিয়ে গেছেন এ দুজন। শুক্রবারের ম্যাচে রোচের সঙ্গে যাঁর প্রথম দেখা হবে, সেই তামিম ইকবাল আঙুলের চোট নিয়ে শেষ শঙ্কাটুকুও কাল নেট ব্যাটিংয়ে দূর করেছেন। ইমরুল কায়েস যথারীতি মনোযোগী ছাত্র। জুনায়েদ সিদ্দীক, মুশফিকুর রহিম, মোহাম্মদ আশরাফুলরাও অনুশীলনে একাগ্র।
ব্যাপারটা একসময় মৃদু আতঙ্কও ছড়াল! ইনডোরে সাইটস্ক্রিনের পেছনে বসা সাংবাদিককুল সন্ত্রস্ত, কখন কার গায়ে যে বল লাগে! উঁকি দিয়ে নিশ্চিত হওয়া গেল ব্যাটিং পাওয়ার প্লের মহড়া চলছে। তামিম-সাকিব কিংবা আশরাফুল নন, ব্যাটসম্যানটি রকিবুল হাসান! এটা বাংলাদেশ দলের বড় ছবি। গেইলকে প্রথম বল করার জন্য তৈরি রাজ্জাক। রোচ কি সুলেমান বেন, ব্যাটিং পাওয়ার প্লে পেলে মেরে ধুন তোলার মহড়া নিচ্ছেন রকিবুল। কাউন্টার অ্যাটাকের জন্য তো তামিম-সাকিব-আশরাফুলরা আছেনই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।