সম্প্রতি জেলা প্রশাসকদের তিন দিনব্যাপী সম্মেলন সমাপ্ত হলো ঢাকায়। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র, বাণিজ্য, কৃষি, শিল্প, যোগাযোগ এমনকি শিক্ষামন্ত্রীও শিক্ষা দিয়ে দিয়েছেন ডিসিদের। বর্তমান মেয়াদ শেষ পর্বে ডিসিদের নিয়ে নিয়মিত বৈঠকের সময়সূচি এগিয়ে আনা হয়েছে। নসিহত করেছেন বড় বড় মন্ত্রীরা, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, কৃষি থেকে পররাষ্ট্র, শিল্প থেকে স্বরাষ্ট্র সব মহোদয় ডিসিদের হাতে বিস্তর দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছেন বক্তৃতার কথামালা দিয়ে। এর ফাঁকে একাধিক জেলা প্রশাসককে ব্যস্ত সময় কাটাতে দেখা গেল ঈদবাজারেও।
সে যাই হোক, যার যেমন খুশি বাজার-সদাই করুক ব্যক্তিস্বাধীনতা নিয়ে।
কিন্তু স্থানীয় সরকার প্রধান যদি জাতীয় সরকারপ্রধান হতে চান ব্যক্তি স্বাধীনতা নিয়ে তাহলে তো দুইখান কথা আছে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা নিয়ে। তারপর যদি তা আবার হয় ব্যক্তি স্বাধীনতার চিরন্তন মাধুর্য লঙ্ঘন করে। এক লাফে দুই-তিন সিঁড়ি ডিঙানো যায় মাঝেমধ্যে; কিন্তু একবারে ১০ সিঁড়ি লাফিয়ে পার হওয়ার চেষ্টা করলে তা হয় হাত-পা কিংবা শরীরের কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ভেঙে যাওয়ার এবং রক্তাক্ত অথবা কাটা-ছেঁড়া থেঁতলানো জখমের পরিণতি দিয়ে। ঠিক তেমনটিই করলেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।
তিনি স্থানীয় সীমা অতিক্রম করে জাতীয় নির্বাচনে ডিসিদের প্রস্তুতি নিতে বললেন সেনাবাহিনী ছাড়া সম্পন্ন করার জন্য। বিষয়টি যেন স্ব-রচিত এবং স্ব-সুরারোপিত রবীন্দ্রসংগীত কিংবা নজরুলগীতির মতো হয়ে গেল! অমাবস্যার রাতে পূর্ণ চন্দ্র দর্শনের ন্যায় অবাস্তব প্রস্তুতির প্রত্যাশায় যেন এক তড়িঘড়ি আয়োজন। বিষয়টি আর কারও বেলায় হলে এতটা বিরক্তি উৎপাদন করত না। কিন্তু কেন যেন আশরাফ সাহেবের বেলায় বড্ড বেমানান। অবশ্য উনি করবেনইবা কি, চোখের সামনে দেখেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে স্বরচিত ছড়া শুনিয়ে কেউ মন্ত্রী হন, রাষ্ট্রীয় সংবিধান লঙ্ঘন করে জনতার মঞ্চ তৈরি করে কেউ বড় মন্ত্রী হন, আবার লগি-বৈঠার হত্যাযজ্ঞ আয়োজন করে কেউ শুধু প্রভাবশালী প্রতিমন্ত্রীই নন, নানা সংকটকালে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শকও হন।
সরকারদলীয় উপদেষ্টা পরিষদের সভায় জোরেশোরে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে দলের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব ওঠে, বিপরীতে আন্তর্জাতিকভাবে মান-সম্মান খুইয়ে পদ্মাসেতু কেলেঙ্কারির নায়ক হন 'দেশপ্রেমিক'। কালো বিড়াল শিকারে নেমে নিজেই শিকার হয়ে যাওয়া ব্যক্তির মন্ত্রিত্ব বহাল থাকে; কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্তজনরা থাকেন অনাদর-অবহেলায়। শুধু কি তাই! সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত বিচারের দাবিতে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তায় ঐক্যবদ্ধ সাংবাদিক সমাজকে কৌশলে বিভ্রান্ত করে আন্দোলন থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় আপাতত বিজয়ী ব্যক্তি পুরস্কৃত হন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা পদ পেয়ে। মীমাংসিত জাতীয় নির্বাচন পদ্ধতিকে চরম বিতর্কিত করে অবসরগ্রহণের ১৬ মাস পর রায় প্রদান করে পুলকিত ব্যক্তি পুরস্কৃত হন প্রধান বিচারপতির পদমর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধায় আইন কমিশনের চেয়ারম্যান পদ পেয়ে। অথচ সজ্জন খ্যাতিপ্রাপ্ত শিষ্টাচার পালনকারী বিনয়ী ইমেজের ব্যক্তি থাকেন পদ হারানোর পরোক্ষ হুমকির মুখে।
তাই হয়তো সম্মানিত স্থানীয় সরকার মন্ত্রী 'কিছু বলে, কিছু করে' পুরস্কার না হোক অন্তত খেসারত প্রদানের ঝুঁকি এড়িয়ে যাবেন এটা কি খুব অস্বাভাবিক? তবে দুইখান কথা কিন্তু এখানেও আছে। দু-দ-ক এর সাবেক চেয়ারম্যানের বক্তব্য অনুযায়ী ওটা ছিল নখ-দাঁতবিহীন স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। কিন্তু প্রধান নির্বাচন কমিশনার তো এখনো সেভাবে বা অন্য ভাষায় নিজেদের অক্ষম বলেননি। তাহলে সৈয়দ সাহেব এতটা আগ বাড়িয়ে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব অতি আগাম মাত্রায় কাঁধে নিতে গেলেন কেন? বর্তমান সরকারের সময় কচিকাঁচার আসরের (সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ভাষায় বর্তমান মন্ত্রিসভা) তালিকা থেকে যারা বাদ পড়েছেন যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ব্যক্তিগত অপছন্দের কারণ হিসেবে, আবার অনেক পিছিয়ে থাকা যোগ্যতার মাপকাঠিও অতিক্রম করেছেন ব্যক্তিগত পছন্দের বিচারে সেই উদাহরণ দেখে কি তিনি পথ হারিয়ে ফেলেছেন? দ্রুত অনেক সিঁড়ি টপকানোর চেষ্টা যে ক্ষতিকর সেটা তো সৈয়দ সাহেব অবশ্যই বোঝেন বলে আমার বিশ্বাস। কিন্তু যেটা নির্বাচন কমিশনের পুরোপুরি এখতিয়ারভুক্ত এবং তাও যথাযথ সময়ে ও আনুপর্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করার পরের ব্যাপার সেটা এত আগ বাড়িয়ে বলা কি কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানোর মতো বিষয় হলো না।
অবশ্য আজকাল নাকি মজুতদাররা গরম লোহার শিক ঢুকিয়ে কাঁচা কাঁঠাল পাকিয়ে ফেলেন, সে রকম হলে তো বলার কিছু নেই। সে ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের উচিত হবে প্রতিষ্ঠানটির কিছু বিশ্বাসযোগ্যতাও যে আছে অবিলম্বে তা প্রমাণের পদক্ষেপ গ্রহণ করা। আর তা সম্ভব তাদের এখতিয়ারে অযাচিত হস্তক্ষেপের প্রতিবাদ করে নির্বাচকমণ্ডলী তথা সাধারণ ভোটারদের উদ্দেশ্যে বলা যে, আগামী জাতীয় সাংসদ নির্বাচনের সময় নির্ধারিত হওয়ার পর বিরাজমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সেনাবাহিনীকে ভোটের মাঠে দায়িত্ব দেওয়া হবে কি হবে না সেটা সিদ্ধান্ত হবে। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের প্রজ্ঞা ও মেধাকে শ্লেষ করার অধিকার কাউকে দেওয়া হয়নি এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রীকে তো নয়ই। পাত্রপাত্রী পছন্দ হওয়ার অনেক আগেই কখনো বিয়ের অনুষ্ঠানে অতিথি কে কে থাকবে কিংবা থাকবে না সেটা যথাযথ অভিভাবকরা কখনো ঠিক করেন না, আর অনাহুত অভিভাবক তো এক্ষেত্রে নাক গলাতেই পারেন না।
এখানে আরও স্মরণযোগ্য যে, জেলা প্রশাসকরা কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সরাসরি আওতাধীন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের নয়। আমরা অপেক্ষা করছি সৈয়দ আশরাফ সাহেবের এই অতি আগ্রহের জবাব নির্বাচন কমিশন অচিরেই দেবে। না হলে বর্তমান সরকারের ব্লু-প্রিন্ট অনুযায়ী ক্ষমতা প্রলম্বিত করার লোক দেখানো নির্বাচনের অপকীর্তির নোংরা আবর্জনা সব পড়বে নির্বাচন কমিশনের ঘাড়ে। সেটা কারও জন্য অভিপ্রেত হবে না। আর বর্তমান সরকারের বিভিন্ন অঙ্গপ্রতঙ্গ যেভাবে অহেতুক অস্থির নড়াচড়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে তাতে সরকারের পুরো অস্তিত্বই বড় দুর্ঘটনায় পড়তে পারে।
কারণ অতি তাড়াহুড়া অতিমাত্রার বিবাদ ডেকে আনতে পারে মুহূর্তের ভুলে। শ্রদ্ধেয় সর্বজন পরিচিত শফিক রেহমানকে সালাম করে একটি তাড়াহুড়া পূর্ণ দুর্ঘটনার কম্পিত পরিণতি বর্ণনা করছি। একটি ছোট্ট বিমানে চালকসহ মোট যাত্রী পাঁচজন। একজন মহাজোট সরকারের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, একজন ডাকসাইটে মন্ত্রী, একজন জাতীয়তাবাদী আদর্শে বিশ্বাসী শিক্ষক, আরেকজন স্কুলছাত্র। যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেওয়ায় তা সামলাতে না পেরে পাইলট জরুরি ঘোষণা দিয়ে বললেন_ আমরা দুর্ঘটনায় পড়তে যাচ্ছি, সবাই দ্রুত প্যারাসুট নিয়ে ইমার্জেন্সি এঙ্টি দিয়ে ঝাঁপ দিন।
আত্দরক্ষা করুন। কিন্তু বিভ্রাট দেখা দিল যাত্রী কেবিনে। চারজন যাত্রীর জন্য প্যারাস্যুট রয়েছে তিনটি। পাইলটের ঘোষণা মাত্রই সরকারের মন্ত্রী অতি দ্রুত তার ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটিয়ে সবার আগে একটি প্যারাস্যুট নিয়ে ঝাঁপ দিলেন। পর মুহূর্তেই মাননীয় উপদেষ্টা একটু সময় নষ্ট না করে আরেকটি প্যারাস্যুট নিয়ে ঝাঁপ দিলেন।
তখন যাত্রী বাকি সাধারণ দুজন নন-ভিআইপি।
শিক্ষকযাত্রী স্কুলছাত্রকে আদর্শ শিক্ষকের মতো বললেন, বাবা তোমরা দেশের ভবিষ্যৎ। আমার তো এখন শেষ সময়, কিন্তু দেশের জন্য তোমাদের প্রজন্ম প্রয়োজন। অতএব বাকি একটি প্যারাস্যুট নিয়ে তুমি ঝাঁপ দাও, আমার ভাগ্যে যা আছে হবে। স্কুলছাত্রটি মুচকি হেসে বলল_ আঙ্কেল, আপনি চিন্তা করবেন না, প্যারাস্যুট এখনো দুটি আছে।
শিক্ষকের প্রশ্ন কিভাবে? স্কুলছাত্র বলল, স্বার্থপরের মতো বেশি তাড়াহুড়া আর বেশি প্রাণের মায়ার মোহে পড়ে মন্ত্রী সাহেব অতি দ্রুত যেটি নিয়ে ঝাঁপ দিয়েছেন সেটা প্যারাস্যুট নয়, বরং ওরকম দেখতে, সেটা আমার স্কুলব্যাগ। বাকরুদ্ধ শিক্ষকের চোখে তখন অশ্রু। তাই বলব জুলুম, নিপীড়ন, অনাচার, ক্ষমতার দম্ভ, লুটপাট, দুর্নীতি করে তো বর্তমান সরকার বাংলাদেশ নামক বিমানটিতে ব্যাপক যান্ত্রিক ত্রুটির সৃষ্টি করেছে, যাতে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা অমুলক নয়। সেক্ষেত্রে পুনরায় উড্ডয়নের আগেই ত্রুটি সারানোর আন্তরিক চেষ্টা করুন, সবার জন্য মঙ্গল হবে। আর একগুয়েমী বহাল রেখে দুর্ঘটনার সুযোগ রেখে দিলে আপনাদের স্বভাবজাত তাড়াহুড়ার সময় প্যারাস্যুটের বদলে ভুল করে স্কুলব্যাগ নিয়ে বিপর্যয়ে পড়তে পারেন।
বিপর্যয়ে পড়তে পারে প্রিয় মাতৃভূমি। সেটা তো হতে দেওয়া যায় না।
লেখক : সাবেক সংসদ সদগজ্ঝ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।