আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সজাগ হওয়ার এখনই সময়

২৪ এপ্রিল সাভারে একটি বহুতল ভবন ভেঙে পড়ে। মৃতের সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে গেছে। আহত এক হাজারের অধিক। এঁরা সব পোশাকশিল্পের শ্রমিক এবং প্রায় সবাই নারী। ঘটনাটি পোশাকশিল্প খাতে এযাবৎকালের সবচেয়ে মর্মান্তিক প্রাণঘাতী বিয়োগাত্মক ঘটনা।

এখনো কিছু লোক আটকে আছেন। তাই হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। সরকারের পক্ষ থেকে উদ্ধার অভিযান চলছে। মূল দায়িত্বে সামরিক বাহিনী। অন্যান্য সংস্থাও সহায়তা দিচ্ছে।

এগিয়ে এসেছে সমাজের সব স্তরের মানুষ। বরাবরের মতো পালিয়ে গেছেন ভবনের মালিক। পরের দিনটি সরকার জাতীয় শোক দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। অর্ধনমিত ছিল জাতীয় পতাকা। এটা নিহত ব্যক্তিদের প্রতি জাতির আবেগাশ্রয়ী মর্যাদা প্রদর্শন।


উল্লেখ্য, যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এই ভবন নির্মাণ করলেন ক্ষমতাসীন দলটির স্থানীয় একজন নেতা। ফাটল চিহ্নিত হওয়ার পরও এটা পরিত্যক্ত হলো না। আর এসব জেনেশুনেই এখানে গার্মেন্টস কারখানা চালাচ্ছেন কিছু ব্যক্তি। তাঁরা কি ঘটনাটির জন্য সরাসরি দায়ী নন? দায়ী নন কি যাঁরা এসব বিষয় তদারকের দায়িত্বে রয়েছেন? তাই শোক দিবসে ক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা তাঁদের বিচারের দাবিতে রাস্তায় নেমে এসেছেন।
এমনিতে সহিংস রাজনৈতিক ছোবলে ৩২ লাখ শ্রমিকের সরাসরি কর্মসংস্থানের এ খাত বিপর্যস্ত।

হরতাল-অবরোধে বিদেশি ক্রেতারা মুখ ফেরাতে শুরু করেছেন। বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মধ্যে আমাদের পোশাকশিল্প খাতটি অগ্রসর হচ্ছে। যোগাযোগ অবকাঠামোর অপ্রতুলতা, গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট সত্ত্বেও এ খাতের প্রশংসনীয় প্রবৃদ্ধির কৃতিত্ব উদ্যোক্তা শ্রেণীর পাশাপাশি শ্রমিকদেরও। সম্প্রতি খবর এসেছে, মজুরি বেড়ে যাওয়ায় চীন ও ভারত থেকে ক্রেতারা বাংলাদেশের দিকে ঝুঁকছেন। এতে পোশাকশিল্প খাতে প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি কর্মসংস্থান, রপ্তানি আয়সহ অনেক ক্ষেত্রেই ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

কিন্তু সহিংস রাজনীতির পাশাপাশি এ ধরনের দুর্ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দায়মুক্তি পেতে থাকলে এর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে।
মাত্র কয়েক মাস আগে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশনস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারিয়েছেন ১১১ জন শ্রমিক। এ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। প্রতিক্রিয়া এসেছে বিভিন্ন মহল থেকে। এর মধ্যে দু-একটি প্রতিক্রিয়া যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।

আর তা হলো, এই মর্মান্তিক ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক কিছু না করা গেলে ক্রেতারা আস্থা হারাবেন—এ ধরনের সতর্কবার্তা বিজিএমইএর সঙ্গে এক বৈঠকে ক্রেতাদের প্রতিনিধিরা তাঁদের জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রতিক্রিয়াও অনুরূপ। এর সহজ অর্থ হচ্ছে, কিছু বিষয়ে সময়মতো ব্যবস্থা না নিলে অনেক বড় খেসারত দিতে হয়।
আমাদের তৈরি পোশাকের সিংহভাগ ক্রেতা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। যেমন ২০১১ থেকে ২০১২ সালে তৈরি পোশাক রপ্তানির যথাক্রমে ২৪ ও ৫৯ শতাংশ যায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে।

ওই সব দেশের ভোক্তা শ্রেণীর মানবাধিকারের প্রতি অবিচল আস্থা থাকায় তারা এ ধরনের প্রাণহানির ঘটনায় উদ্বিগ্ন ও বিচলিত হয়। যেসব দেশে অমানবিক পরিবেশে পণ্য উৎপাদন হয়, সেসব দেশে আমদানির বিরুদ্ধে সোচ্চার পশ্চিমা দেশগুলোর সব কটি শ্রমিক সংগঠন। এ ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকলে তারা একপর্যায়ে বিধিনিষেধ আরোপের ব্যবস্থাও নিতে পারে। যেমনটা আমরা বাধ্য হয়েছি তৈরি পোশাকশিল্প খাত থেকে শিশু শ্রমিকদের বাদ দিতে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে লক্ষণীয়, এ-জাতীয় দুর্ঘটনায় আজতক দৃষ্টান্তমূলক কোনো প্রতিকার হয়নি।

বিজিএমইএ বা সরকার—কেউই কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি।
উল্লেখ্য, গার্মেন্টস বা তৈরি পোশাক আমাদের প্রধান রপ্তানি পণ্য। ২০১১-১২ সালে এর পরিমাণ ছিল প্রায় ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তখন দেশের মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। শুধু তা-ই নয়, এই একক খাতটিতে কর্মরত রয়েছেন প্রায় ৩২ লাখ শ্রমিক, যাঁদের ৯৫ শতাংশই নারী।

গৃহায়ণ, পরিবহন, ব্যাংক, বিমাসহ অন্যান্য খাতে প্রবৃদ্ধিতেও এই পোশাকশিল্প প্রভূত অবদান রাখছে।
উদ্যোক্তা শ্রেণীটির যত সমালোচনাই আমরা করি না কেন, চাক্ষুষভাবে দেখতে পাওয়া যায়, মূলত তাদের প্রচেষ্টাতেই এই অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটে চলছে। রপ্তানি আয়ের স্ফীতির পাশাপাশি কর্মসংস্থান, নারীর ক্ষমতায়নসহ দেশের আর্থসামাজিক খাতে ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটে চলেছে। উদ্যোক্তারা মুনাফা করবেন, এটাই স্বাভাবিক। মানবিক দিকটি এখানে উপেক্ষিত হচ্ছে বড় রকমে, বিষয়টির প্রতি তাঁদের একটি অংশের নজরই নেই।

বেতনাদি শোচনীয়ভাবে কম এবং কিছু ক্ষেত্রে অনিয়মিত। এই ক্ষোভের সুযোগ নিয়ে কিছু বিপথগামী ব্যক্তির প্ররোচনায় শ্রমিকদের নিয়ে কারখানায় হামলা, ভাঙচুরসহ নাশকতামূলক কাজও হয়। এ সমস্যা সমাধানে বিজিএমইএ সাংগঠনিকভাবে কিছু উদ্যোগ নিলেও চাহিদার তুলনায় তা অপ্রতুল।
এসব ঘটনার পর একে অন্যকে দায়ী করে। কিন্তু পরে সবাই পার পেয়ে যায়, এমনটাই দেখা গেছে।

এ ধরনের ইচ্ছাকৃত অবহেলার ঘটনায় সবাইকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নেওয়ার আবশ্যকতা আলোচনার অপেক্ষা রাখে না। যথাযথ মানের ভবন নির্মাণ না করায় প্রাণহানি এত ব্যাপক। এর দায় মালিকের এবং যাঁরা কারখানা চালান, তাঁদের। তাঁদের সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে। ঘটনার কারণ ও অন্য বিষয়াদি নিয়ে নিশ্চয়ই তদন্ত হবে।

প্রতিবেদনও আসবে। তবে দায়ী ব্যক্তিরা চূড়ান্তভাবে সাজা পাবেন কি না, এটা নিয়ে সংশয় থাকছেই। কেননা, এ-জাতীয় দুর্ঘটনা অতীতেও ঘটেছে এবং ঘটে চলেছে। পত্রপত্রিকার হিসাবমতে, পোশাকশিল্পে ১৯৯০ সাল থেকে আগুনে পুড়ে মৃতের সংখ্যা তিন শতাধিক। আগুনের ঘটনা ছাড়াও ২০০৫ সালের এপ্রিলে সাভারের স্পেকট্রাম গার্মেন্টসের পুরো ভবনটি ধসে পড়ে নিহত হন ৬২ জন শ্রমিক।

বলা যায়, নির্মাণকাজে অমার্জনীয় অবহেলার কারণেই ভবন ধসে পড়েছিল। যতটুকু জানা যায়, কোনো ঘটনাতেই আজতক কারও সাজা হয়নি। এর মূল কারণ, নিহত ব্যক্তিরা শ্রমিক। হতদরিদ্র তাঁদের পরিবার। মামলায় লড়ার ক্ষমতা নেই।

পুলিশের পক্ষ থেকে প্রতি ক্ষেত্রেই মামলা হলেও আদালতে চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় অপরাধীরা পার পেয়ে যায়।
উল্লেখ্য, কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি একেবারেই অস্বাভাবিক নয়। দেখার বিষয় থাকে, কারখানাটির সম্ভাব্য দুর্ঘটনা এড়াতে পর্যাপ্ত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না। পোশাকশিল্পের মালিকদের মধ্যে মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন সজ্জনও আছেন। তাঁরা কখনোই চান না এ ধরনের ঘটনা ঘটুক।

এর জন্য তাঁরা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেন নিজ নিজ কারখানায়। কিন্তু এরূপ ব্যবস্থা নেন না, এমন মালিকদের সংখ্যা নেহাতই কম নয়। এটা দেখবে কারা? একে অন্যের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
প্রকৃতপক্ষে সরকারের বেশ কয়েকটা সংস্থা এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। পাশাপাশি যারা ব্যাংক, বিমা-সুবিধা দিচ্ছে, তারাও দায়মুক্ত নয়।

অবশ্যই সরকারের এতদ্বিষয়ক নিয়ন্ত্রণমূলক কর্তৃপক্ষের ভূমিকাই এখানে মুখ্য। সেই কর্তৃপক্ষ হচ্ছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন পরিদপ্তর। ব্রিটিশ শাসনামলের ফ্যাক্টরি আইন, যা ২০০৬ সালে অন্য আইনের সঙ্গে সমন্বিত করে শ্রম আইন নামে নতুন একটি আইন বলবৎ হয়। এ আইন অনুসারে ওই পরিদপ্তরের সঙ্গে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক রয়েছে, যেখানে শ্রমিক-কর্মচারী নিয়োজিত আছেন, এমন সব কলকারখানা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে। শ্রমিকদের নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন সুবিধার বিচার-বিশ্লেষণ করে তারা এই নিবন্ধন দেওয়ার কথা।

কিন্তু জানা যায়, কোনো কোনো কারখানা বা প্রতিষ্ঠান এই নিবন্ধনই নেয় না। পরিদপ্তরটিও খবর রাখে না বা বলা যায় রাখতে পারে না এসব কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠানের। কেননা, ১৯৬২ সালে এই পরিদপ্তরের যে জনবলকাঠামো করা হয়েছিল, তা আজও অপরিবর্তিত। আরও বিস্ময়ের কথা, এর অর্ধেক পদ শূন্য পড়ে আছে। তাদের আওতায় পোশাকশিল্প ছাড়াও সব কলকারখানা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।

আর গত ৫০ বছরে বিভিন্ন শিল্প-কারখানা, দোকানপাট ও প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েক গুণ। এই জনবলকাঠামো দিয়ে প্রতিষ্ঠানের তদারককারী পরিদর্শকদের কারও কারও আখের গোছানোর কাজ চললেও শ্রমিক স্বার্থে কোনো অবদান রাখার সামর্থ্য নেই, এটা বিনা দ্বিধায় বলা চলে। তাই আজকের চাহিদার নিরিখে এর জনবলকাঠামোর ব্যাপক সম্প্রসারণ, শ্রম আইনের ঘাটতি দূর করে এ ধরনের অবহেলার জন্য অধিক শাস্তি এবং মান পরিপালনকারী না হলে তাৎক্ষণিক বন্ধ করার বিধান আবশ্যক।
এই শিল্পের উদ্যোক্তাদের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি জরুরি। নচেত গুরুতর বিপর্যয়কর পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়ে যায়।

বিদেশি ক্রেতাদের এই সতর্কতাকেও গুরুত্ব দিতে হবে। এ ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকলে পাশ্চাত্যের দেশগুলোর শ্রমিক সংগঠন চাপ বাড়াবে। সত্যিকারের গণতান্ত্রিক দেশ বলেই কোনো এক পর্যায়ে সেই চাপকে উপেক্ষা করতে পারবে না তাদের সরকারগুলো। তখন কিন্তু অনেক কাঠখড় পুড়িয়েও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে কি না, এ বিষয়ে সংশয় রয়েছে। তদুপরি আমাদের প্রতিযোগীরা তো বসে নেই।

আমরা আশা করতে থাকব, এমনটা কখনোই ঘটবে না। তবু সময় থাকতে সরকার ও তৈরি পোশাকশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সতর্ক হতে হবে। এর তেমন জোরালো উদ্যোগ কিন্তু এখনো লক্ষণীয় নয়। দার্শনিক সাধক লালন ফকির বহু আগেই বলে গেছেন, ‘সময় গেলে সাধন হবে না’।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।


majumder234@yahoo.com।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com     দেখা হয়েছে ২৩ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.