আর যারা পরকালে বিশ্বাস করে না তারা নিঃসন্দেহ পথ থেকে তো বিপথগামী। (২৩-৭৪)
দক্ষিণ সুদানের স্বাধীনতার প্রশ্নে গত নয়ই জানুয়ারি থেকে গণভোট শুরু হয়েছে। আগামী ১৫ই জানুয়ারি পর্যন্ত ভোট গ্রহণ চলবে। আগামী মাসে ফলাফল ঘোষণার কথা রয়েছে। দক্ষিণ সুদানের গণভোট ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের মাঝে বাড়তি আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দক্ষিণ সুদানের স্বাধীনতার প্রশ্নে চলমান গণভোট, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের সুদূর প্রসারী অশুভ পরিকল্পনারই অংশ। আজকের আসরে আমরা এ প্রসঙ্গেই আরো বিস্তারিত আলোচনার চেষ্টা করবো। আশাকরি শেষ পর্যন্ত আমাদের সঙ্গেই থাকবেন।
বিশ্বের সংবাদ ও রাজনৈতিক মহলের দৃষ্টি এখন দক্ষিণ সুদানে চলমান গণভোটের প্রতি। শুধু চর্মচক্ষু ও ক্যামেরার লেন্স নয় মহাকাশে স্থাপিত স্যাটেলাইটের সাহায্যেও সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ চলছে।
এই গণভোটের ফলাফল কেবল দক্ষিণ সুদানের ভাগ্যই নির্ধারণ করবে না, এর প্রভাব পড়বে গোটা আফ্রিকা মহাদেশের ওপর। কারণ সুদানের মতো আফ্রিকার আরও অনেক দেশেই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলছে। সুদানকে দ্বিখন্ডিত করার প্রশ্নে আয়োজিত এ গণভোটের ফলাফল ওই সব বিচ্ছিন্নতাবাদীর জন্যও একটি বার্তা হিসেবে কাজ করবে নি:সন্দেহে। এ কারণে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন, গণভোটের ফলাফল যদি সুদানকে দ্বিখণ্ডিত করার পক্ষে আসে, তাহলে আফ্রিকা মহাদেশ নতুন নতুন সংকটের মুখে পড়বে। আর যে কোনো নতুন সংকটেই ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র তথা গোটা পাশ্চাত্যের স্বার্থের অনুকূলে যাবে।
সুদানের কেন্দ্রীয় সরকার এবং দক্ষিণের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে ২০০৫ সালে স্বাক্ষরিত এক শান্তি চুক্তির ভিত্তিতে এ গণভোটের আয়োজন করা হয়েছে। এ চুক্তি ২২ বছরের গৃহযুদ্ধ অবসানে ইতিবাচক ভূমিকা রাখলেও মুসলমানদের শত্রুরা নতুন এক সুযোগ হাতে পেয়ে যায়। চুক্তির ভিত্তিতে দক্ষিণ সুদানে ছয় বছরের স্বায়ত্বশাসনের সূত্রপাত হয় এবং সাবেক গেরিলা সংগঠনগুলোকে ক্ষমতার অংশীদার করা হয়। গত ছয় বছর ধরে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা সালভা কায়ের দক্ষিণ সুদানের স্বায়ত্বশাসিত সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি কেন্দ্রে উপ-রাষ্ট্রপতির দায়িত্বও পালন করেন। কিন্তু এসবই মুদ্রার এক পীঠ মাত্র।
কারণ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, ২০০৫ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে ছয় বছরের স্বায়ত্বশাসন ও স্বাধীনতা প্রশ্নে গণভোট আয়োজনের মতো ধারাগুলো সুপরিকল্পিতভাবে দক্ষিণ সুদানকে আলাদা করার সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যে করা হয়েছে।
সুদানের ঘটনাবলিতে ইসরাইলের সম্পৃক্ততা এখন সবার কাছেই স্পষ্ট। ইসরাইলসহ আরও কয়েকটি দেশ গত ছয় বছরে শুধু যে সুদানকে খণ্ড-বিখণ্ড করার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরী করেছে তাই নয় বরং বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোকে ব্যাপক অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য দিয়ে ওই সব সংগঠনের শক্তি বাড়িয়ে তুলেছে। আফ্রিকায় মোসাদের ভূমিকা শীর্ষক বইয়ের লেখক কর্ণেল মুশে ফার্জি লিখেছেন, আফ্রিকার ৩২টি দেশে ইসরাইলের উপস্থিতি, বহু প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং অসংখ্য ইহুদিবাদী বিশেষজ্ঞের গোপন তৎপরতা, আফ্রিকা মহাদেশে ইসরাইলের বিভিন্ন ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরী করেছে। ইসরাইল গত কয়েক দশক ধরে সুদানের তিনটি প্রতিবেশী দেশ কংগো, ইথিওপিয়া ও উগান্ডার মাধ্যমে দক্ষিণ সুদানে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছে।
এই তিন দেশে নিযুক্ত মোসাদের কর্মকর্তাদের একটি বড় দায়িত্ব ছিলো, দক্ষিণ সুদানের গেরিলা ও বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ট যোগাযোগ রাখা। তাদেরকে অস্ত্র ও অর্থ সাহায্য প্রদান করা।
ইসরাইলের পাশাপাশি আমেরিকাও দক্ষিণ সুদানকে আলাদা করার ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত। কোনো কোনো রাজনৈতিক মহল এটা বিশ্বাস করে যে, যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখেই ২০০৫ সালে সুদান সরকার ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এটা যদিও ঠিক যে, কেনিয়ায় স্বাক্ষরিত ওই চুক্তির ফলে দক্ষিণ সুদানে বিদ্রোহের অবসান ঘটেছিল, কিন্তু বাস্তবতা হলো, চুক্তির কোনো কোনো ধারা পুরোপুরি যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্যেই যুক্ত করা হয়েছিল।
১৯৮৯ সালে ওমর আল বাশিরের নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর যুক্তরাষ্ট্র দেশটির বিরুদ্ধে বিদ্বেষী নীতি গ্রহণ করে। যুক্তরাষ্ট্রের শত্রুতা আরও বৃদ্ধি পায় তখনই যখন ওমর আল বাশির ঘোষণা করেন যে, ইসলামী শরীয়াই হবে দেশটির আইনের প্রধান ভিত্তি।
গত দুই দশকে যুক্তরাষ্র্ি সুদানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের পাশাপাশি জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক আদালতসহ বিভিন্ন বিশ্বসংস্থার মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ করে এসেছে। ওয়াশিংটনের নীতি মেনে না চললে সুদানকে বিভক্ত করার ইঙ্গিতও বহুবার দেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ সুদানের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোকে খাতুর্মের ওপর চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে এসেছে।
সুদানে জ্বালানী তেলের সন্ধান লাভের পর থেকে দেশটির প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। সুদানের দক্ষিণাঞ্চলেই সবচেয়ে বেশি তেল মজুদ রয়েছে। বলা হয়ে থাকে, সুদানের ৮৫ শতাংশ তেলের মজুদই হলো দক্ষিণাঞ্চলে। আফ্রিকা মহাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম তেল সমৃদ্ধ দেশ হচ্ছে সুদান। বিশাল তেল সম্পদ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলকে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাবার ক্ষেত্রে আরও উৎসাহিত করেছে।
এসব নানা কারণে ওয়াশিংটন ও তেল আবিব যৌথভাবে সুদানকে বিভক্ত করার পরিকল্পনা হাতে নেয়।
ইসরাইল এখনও নীল নদ থেকে শুরু করে ফোরাত নদী পর্যন্ত বিশাল অঞ্চল নিয়ে 'মহা ইসরাইল' রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্রও গোটা আফ্রিকা মহাদেশ এবং রেড সি'র আন্তর্জাতিক জলপথ সংলগ্ন দেশগুলোতে পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। রেড সিতে চলাচলকারী জলযানগুলোর ওপর নজরদারি, উত্তর আফ্রিকা ও 'আফ্রিকা শৃঙ্গ' নামে পরিচিত অঞ্চলে অবস্থান শক্তিশালী করা এবং সুদানের ইউরেনিয়াম ও তেল সম্পদের ওপর প্রভাব বিস্তার করা যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। এ বাস্তবতার আলোকে অনেকেই দক্ষিণ সুদানে চলমান গণভোটকে ইসরাইলী ও মার্কিন ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে মনে করছেন।
যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ সুদানকে আলাদা করার জন্য সেখানকার স্থানীয় জনগণকে উৎসাহিত করতে হলিউডের তারকাদের পর্যন্ত ব্যবহার করেছে। এর মধ্যে মার্কিন অভিনেতা জর্জ ক্লোনি, গুগল ও জাতিসংঘের সহযোগিতায় সুদানের নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য গোয়েন্দা স্যাটেলাইট প্রকল্প পরিচালনা করছে। এই সব পদক্ষেপ প্রমাণ করে দক্ষিণ সুদানের গণভোট যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কত বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
দক্ষিণ সুদানের অধিবাসীরা কম শিক্ষিত হবার কারণে এক সপ্তা ধরে গণভোট চলছে। আগামী ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে গণভোটের ফলাফল ঘোষণা করা হবে।
সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল বাশির বলেছেন, গণভোটের ফলাফল যাই-ই হোক তিনি তা মেনে নেবেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল যে পরিকল্পনা ও স্বপ্ন নিয়ে এগোচ্ছে,তাতে গণভোটের ফলাফল পরবর্তী সম্ভাব্য ঘটনাবলী নিয়ে বিশেষজ্ঞরা খুবই উদ্বিগ্ন। যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় অবস্থিত মুসলিম ও আরব দেশগুলোর ভৌগোলিক অবস্থানে পরিবর্তন ঘটিয়ে "বৃহৎ মধ্যপ্রাচ্য" নামের যে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ঘোষণা অতীতে দিয়েছিল,সুদানকে দ্বিখন্ডিত করাও তারই অংশ কি না,সে প্রশ্নও অনেকের মনে উঁকি দিচ্ছে। #
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।