সাবধান! আপনার পাশেই আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড জালিয়াত চক্র। তাদের খপ্পরে পড়লে হঠাৎ করে শূন্যের কোটায় নেমে আসতে পারে আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারেন আপনি। ক্রেডিট কার্ড জালিয়াত চক্রের ফাঁদে পড়ে ইতোমধ্যেই নিঃস্ব হয়েছেন অসংখ্য লোক। কেবল তাই নয়, এই চক্রের কবলে পড়ে ইতোমধ্যেই একজন নারীর নির্মম মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।
তবে জালিয়াত চক্রের শিকার হয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে অভিযোগ করলেও ভুক্তভোগীদের অনেকেই কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না। উল্টো ব্যাংক কর্মকর্তাদের গালমন্দের শিকার হয়েছেন তাদের অনেকে।
সম্প্রতি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে গ্রেফতারকৃত ক্রেডিট কার্ড জালিয়াত চক্রের সদস্যদের কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়ার পর অনেকের চোখ কপালে উঠেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জালিয়াত চক্রের সদস্যরা তিনটি ডিজিটাল এবং একটি এনালগ পদ্ধতিতে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছে। প্রথমত, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কোনো আইটি (ইনফরমেশন টেকনোলজি) এক্সপার্ট কিংবা সিস্টেম এনালিস্টের ভুয়া পরিচয়পত্র তৈরি করে এটিএম বুথের নিরাপত্তা প্রহরীদের বোকা বানিয়ে একের পর এক টার্গেট পূরণ করে যাচ্ছে।
চক্রের সদস্যরা গ্রাহক ও এটিএম বুথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বলে বুথের দরজায় আঠা দিয়ে একটি বিশেষ ডিভাইস বা কার্ড রিডার (ম্যাগনেটিক) বসিয়ে দেন। ওই রিডার এটিএম কার্ডের সব তথ্য স্ক্যান করে ফেলে। আর যেখানে এটিএম বুথের বাটন থাকে ঠিক তার ওপরে একটি গোপন মুভি ভিডিও ক্যামেরা বসান। আর গ্রাহক যখন বুথ থেকে টাকা তুলতে গোপন পিন নম্বর চাপতে থাকে সেই দৃশ্য ভিডিও ক্যামেরায় ধারণ হয়ে যায়। নিরাপত্তা কর্মীকে বোঝানো হয়, যে কেউ বুথে প্রবেশ করলে তাকে ক্রেডিট বা এটিএম কার্ড বুথের দরজায় থাকা কার্ড রিডারে পাঞ্চ করতে হবে।
এতে করে গ্রাহক সম্পর্কে ব্যাংকে তথ্য থাকবে। যে তথ্য গ্রাহকের জন্য পরবর্তীতে বিভিন্ন প্রয়োজনে কাজে লাগবে।
দ্বিতীয়ত, চক্রের সদস্যরা এটিএম বুথে প্রবেশ করে ইনসার্ট মুখে আলাদা একটি ডিভাইস সংযুক্ত করে দেন। আবার কেউ কেউ এটিএম বুথের মেশিনে কার্ড প্রবেশ মুখের মতো একই ধরনের আরও একটি ইনসার্ট মুখ তৈরি করে তাতে আলাদা ডিভাইস বসিয়ে দেন। ওই ডিভাইসে এটিএম কার্ডের সব ধরনের তথ্য স্ক্যান হয়ে যায়।
এসব তথ্য চুরি করে মাত্র কয়েক মিনিটে এটিএম কার্ড বা ক্রেডিট কার্ড তৈরি করেন জালিয়াত চক্রের সদস্যরা।
গত মে মাসে মিরপুরের বাসিন্দা শাহিন আলম নামের একজন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তার অভিযোগের তদন্ত করতে গিয়ে এ বিষয়টি গোয়েন্দাদের গোচরীভ‚ত হয়। জালিয়াত চক্রের খপ্পরে ব্যাংকে তার অ্যাকাউন্টে থাকা ২৫ হাজার টাকা গায়েব হয়ে যায়। এ ব্যাপারে অভিযোগ করতে গেলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তা শুরুর দিকে তাকেই উল্টো গালমন্দ করেন।
পরবর্তীতে গত ১ জুন মিরপুর বেসরকারি ব্যাংকের একটি এটিএম বুথ থেকে গ্রেফতারকৃত মোশারফ হোসেন এবং শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ত্যাগের প্রাক্কালে শ্রীলঙ্কান বংশোদ্ভ‚ত ব্রিটিশ নাগরিক মহানাথাস পন্নুথারাই গোয়েন্দা জিজ্ঞাসাবাদের জানিয়েছেন, ক্রেডিট কার্ড তৈরির মাল এবং বিশেষ ধরনের যন্ত্র তারা বুলগেরিয়া এবং ইংল্যান্ড থেকে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে নিয়ে আসেন।
তারা ইতোমধ্যে শতাধিক লোকের এটিএম এবং ক্রেডিট কার্ড ক্লোন করে সব ধরনের তথ্য হাতিয়ে নিয়েছেন। শীঘ্রই তারা নকল কার্ড তৈরি করে ওই সব ব্যক্তিদের হিসাব অ্যাকাউন্টে হানা দিতেন। তাদের টার্গেট ছিল ১০ কোটি টাকা। এ চক্রের সঙ্গে ইংল্যান্ড, কানাডা এবং বুলগেরিয়ার জালিয়াত চক্রের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিভিন্ন সুপার শপের এনএফসি (নিয়ার ফিল্ড কমিউনিকেশন্স) মেশিনে বিশেষ ডিভাইস স্থাপন করেও এটিএম বুথের মতো করে কার্ড জালিয়াতি করার বিশাল সুযোগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সুপার শপের কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত লোককে ম্যানেজ করেই তা সম্ভব। পরবর্তীতে ওই তথ্য ক্লোন করে আলাদা আরেকটি কার্ড তৈরি করতে পারেন জালিয়াত চক্রের সদস্যরা। ইতোমধ্যেই ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি করে টাকা চুরির অভিযোগে রাজধানীতে একটি চেইন শপের এক কর্মচারীসহ দুজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তারা হলেন জুবায়ের হোসেন শাহেদ (২২) ও মো. খলিল (২৬)। পুলিশ দুজনের কাছ থেকে কয়েকটি ক্রেডিট কার্ড ও মোবাইলফোনের সিম উদ্ধার করে।
জানা গেছে, সাদেকুল ইসলাম নামের একজন ব্যবসায়ী গত ২২ এপ্রিল এক হাজার টাকার মালামাল কেনেন। এ সময় কর্মচারী শাহেদ তার কার্ড পাঞ্চ করতে গিয়ে কৌশলে ক্রেডিট কার্ডের কোনো একটি তথ্য নিয়ে পরে সেই তথ্য দিয়ে ইন্টারনেটে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে এক লাখ ৩৩ হাজার টাকার পণ্য কেনেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, বিভিন্ন সুপার শপের মালিকদের এবং সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সচেতন না হলে সাধারণ মানুষ আরও দুর্ভোগে পড়বেন। একই সঙ্গে সিকিউরিটি কোম্পানির সদস্যদের জন্য বিশেষ সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত।
র্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল কিসমত হায়াৎ জানান, রাজধানীতে অন্তত ছয়টি ক্রেডিট কার্ড ছিনতাইকারী চক্র সক্রিয় রয়েছে।
তারা মাইক্রোবাস এবং প্রাইভেটকারে চড়ে যাত্রীদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ক্রেডিট এবং ডেভিড কার্ড ছিনতাই করে তাদের সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে। সম্প্রতি র্যাডিসন হোটেলের কর্মচারী আলেয়া ফেরদৌসী হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে গিয়ে তারা এ বিষয়টি উদঘাটন করেছেন। একই সঙ্গে এ ধরনের আরেকটি চক্রের কিছু মহিলা বিদেশি নাগরিকদের ডেবিট কার্ড চুরি করে বিভিন্ন সুপার শপ থেকে মূল্যবান দ্রব্য কেনাকাটা করছেন।
ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার মশিউর রহমান জানান, ইতোমধ্যেই তারা বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে এসব বিষয় অবহিত করেছেন। দ্বিমাত্রিক এটিএম কার্ডের বদলে উন্নত দেশগুলোর মতো আরও নিরাপত্তা সংবলিত ত্রিমাত্রিক এটিএম কার্ড সংযোজন করার জন্য তারা সুপারিশ করেছেন।
তিনি আরও জানান, এ ধরনের প্রক্রিয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর প্রথম স্তরের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা। এটি কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। কারণ কোনো নিরাপত্তা কর্মী যদি ভুয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে নিরাপত্তা কর্মীর চাকরি নিয়ে থাকেন এবং তিনি যদি কোনো ক্রেডিট কার্ড জালিয়াত চক্রের সঙ্গে যোগ দিয়ে কাজ করেন, তাহলে তাকে ধরা সম্ভব নয়। এ জন্য এটিএম বুথে কর্মরত নিরাপত্তা কর্মীর সঠিক পরিচয় নিশ্চিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। এটি নিশ্চিত করতে প্রথমেই চাকরি দেওয়ার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা কর্মীর পুলিশ ভেরিফিকেশন হওয়া বাধ্যতামূলক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।