সেই দিন ট্রেনের শেষ কামরায় বসে ইউনিভার্সিটি যাচ্ছিলাম। জায়গা পেয়েছি বলা যাবে না, চার জনের সিটে ছয় জন বসে কষ্ট করে জায়গা করে নিলাম। ডেলিপ্যাসেঞ্জাররা এত জোরে জোরে চিৎকার করে গল্প করছে যে বোঝার উপায় নেই সেটা গল্প না ঝগড়া। রাজনীতি থেকে পর্ণো (ওদের ভাষায় পানু) কোনও কিছুই বাদ যাচ্ছে না ওদের আলোচনায়। আরও মজার ঘটনা ঘটছে, আলোচনায় প্রবেশ করতে না করতেই প্রসঙ্গ পাল্টে যাচ্ছে তাদের।
অনেকটা অলস সময়ে বে-খেয়ালে রিমোট টিপে আমারা যেমন একের পর এক চ্যানেল ঘুরিয়ে চলি ঠিক তেমনি। মনটা বারবার ওদিকে চলে যাচ্ছে, যদিও ভাব এমন দেখাচ্ছি যেন ওদের দিকে পাত্তাই দিচ্ছি না। আচমকা একটা খুব কমন টপিকে এক মোমিন ডেলিপ্যাসেঞ্জার বলে উঠলো, “ও আবার আসল মুসলমান নাকি? শালা কাফের দেশে কাফের মন্ত্রী! নামাযের পোজে ছবি তুললে আর ইফতারি দিলেই মুসলিম হয়ে যায় না!”
সেই দিন ট্রেনের শেষ কামরায় বসে ইউনিভার্সিটি যাচ্ছিলাম। জায়গা পেয়েছি বলা যাবে না, চার জনের ছিটে ছয় জন বসে কষ্ট করে জায়গা করে নিলাম। ডেলিপ্যাসেঞ্জাররা এত জোরে জোরে চিৎকার করে গল্প করছে যে বোঝার উপায় নেই সেটা গল্প না ঝগড়া।
রাজনীতি থেকে পর্ণো (ওদের ভাষায় পানু) কোনও কিছুই বাদ যাচ্ছে না ওদের আলোচনায়। আরও মজার ঘটনা ঘটছে, আলোচনায় প্রবেশ করতে না করতেই প্রসঙ্গ পাল্টে যাচ্ছে তাদের। অনেকটা অলস সময়ে বে-খেয়ালে রিমোট টিপে আমারা যেমন একের পর এক চ্যানেল ঘুরিয়ে চলি ঠিক তেমনি। মনটা বারবার ওদিকে চলে যাচ্ছে, যদিও ভাব এমন দেখাচ্ছি যেন ওদের দিকে পাত্তাই দিচ্ছি না। আচমকা একটা খুব কমন টপিকে এক মোমিন ডেলিপ্যাসেঞ্জার বলে উঠলো, “ও আবার আসল মুসলমান নাকি? শালা কাফের দেশে কাফের মন্ত্রী! নামাযের পোজে ছবি তুললে আর ইফতারি দিলেই মুসলিম হয়ে যায় না!”
যাই হোক, কিছুক্ষণের মধ্যেই টপিক আবার পাল্টে গেলো।
কিন্তু আমার মন থেকে প্রশ্নটা তো গেলোই না, উল্টো বেড়ে গেল আরও। বার বার একটি কথাই কানে ভাসছিল—তাহলে প্রকৃত মুসলমান কে? কি হলে আসল মুসলমান হয়?
যাই হোক ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরলাম। রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ করে ঘুমতে যাবার আগে ভাবছিলাম কোন বইটা নিয়ে ঘুমতে যাবো। বুক-সেলফের সামনে দাঁড়িয়ে কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে এইবই সেইবই নাড়াচাড়া করছিলাম। খেয়াল করিনি কোন বইটা নিয়ে নাড়ছি,মনে শুধু সেই একটাই প্রশ্ন, কে আসল মুসলমান আর কে নয়? শেষে নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজেই খুঁজে নেব ঠিক করে ডায়েরিটা তুলে নিলাম বইটা রেখে, তখন প্রথমবার খেয়াল করলাম, যে বইটা এতক্ষণ হাতে ছিল সেটা “ভারতীয় শক্তিসাধনা -১ম খণ্ড”।
ডাইরিটা নিয়েই শুয়ে পড়লাম কিন্তু তাতে একটিও আঁচড় কাটতে পাড়লাম না কারন অনেক কিছু জানলেও গুছিয়ে উঠেতে পারছিলাম না। এভাবেই ঘুমের রাজ্যের প্রবেশ করলাম। সকালে উঠে ব্রেকফাস্টে টেবিলে আব্বুকে দেখেই প্রশ্নটা করে বসলাম – “আচ্ছা আব্বু প্রকৃত মুসলমান বলতে ঠিক কি বোঝায়? মানে, প্রকৃত মুসলমান কারা?”
আব্বু যেন এতদিনে একটা সুযোগ পেলেন এমন ভাব করে মৃদু গলা ঝাঁকিয়ে একটু নড়েচড়ে বসলেন, “এসব তো তোমার জানার কথা! যাই হোক, জিজ্ঞাসা যখন করলে তখন শোন। আসলে মুসলমান ঘরে জন্মালেই কেউ মুসলমান হয়ে যায় না। এই যেমন তুমি, আল্লায় বিশ্বাস নেই, পরকালে বিশ্বাস নেই, নবীতে বিশ্বাস নেই; তোমাকে কি মুসলমান বলা যায়? ( তেঁতো লাগলেও গিলে ফেললাম কথাটা) আবার দ্যাখো, অনেকের আল্লাহ্-নবী- পরকালে বিশ্বাস তো আছে, কিন্তু কলেমাগুলোই জানে না, কোনোদিন কোরআন পড়েনি, তাদের কি মুসলমান বলা যায়?”
“--না”, ইতস্তত করেই বললাম আমি, “কিন্তু তুমি তো বললে কারা মুসলিম নয়, কিন্তু কারা মুসলিম সেইটা তো বললে না।
”
“ আচ্ছা, তবে শোন”, একটু থেমে আব্বু আবার বলতে শুরু করলেন, “একদিন বুঝলে, জিব্রাইল এসেছেন মহানবীর কাছে সাধারণ মানুষের ছদ্মবেশে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ইসলাম কি? তখন নবী (সাঃ) উত্তরে বললেন, তুমি আল্লাহ্র ইবাদত করবে। কাউকে তার শরিক করবে না। বছরের শেষে যাকাত দেবে। আর রমযান মাসে রোজা রাখবে” আব্বু আবার শুরু করলেন একটু থেমে, “তাহলে মুসলিম হল তারাই যারা এইসবগুলো মেনে চলে।
অর্থাৎ ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের মধ্যে হজ্জ ছাড়া বাকি যে চারটে মাস্ট, সেগুলো মানলেই তাকে মুসলিম বলা যাবে”।
--“আচ্ছা আব্বু! এসব তো শিয়ারাও করে। তুমি কি শিয়াদের মুসলিম বলে মানো? মানে, আমি সব সুন্নি মযহাবের বইতেই দেখেছি শিয়াদের পথভ্রষ্ট বলতে, এমনও বলতে দেখেছি যে তাদের স্থান দোযখে! তবে কি ওরা মুসলিম নয়?”
আব্বু মৃদু জোর গলায় বলে উঠলো,“ শিয়ারা নামে মুসলিম, আসলে ওরা পথভ্রষ্ট। ওরা আল্লাহ-র শরিক করে। ”
--“তার মানে ওরা দোযখে যাবে”, আমি স্বগতোক্তির মতো বলে উঠলাম।
তারপর অতি জিজ্ঞাসুর মতো বলে উঠলাম, “তাহলে আব্বু ধরো, একজন শিয়া আর একজন হিন্দু দুজনেই যদি জাহান্নামে যায় তাহলে শিয়াদের মুসলমান হয়ে লাভ কি হল?”
--“তাহলে কি তুমি বল, নামে মুসলমান হলেই হবে?”
--“না না আমি কেন, তুমিই তো বললে যে ইবাদত টিবাদত করলেই নাকি মুসলিম হবে। শিয়ারা তো তা করে, তাহলে ওদের মুসলিম বলবো নাকি বলবো না?”
--“খালি ইবাদত করলেই হবে? ওরা আল্লাহ-র শরিক করে যেটা ইসলামে হারাম! নবীর নির্দেশের সবগুলোই পালন করতে হবে! মুসলমান হওয়া অত সোজা নয়”।
--“তার মানে শিয়ারা আদতে মুসলমান নয়”, আমি বলতে বলতেই দেখি আব্বু উঠে দাঁড়িয়েছেন। বললাম, “কোথায় চললে?”
বললেন, “আমাকে এখুনি যেতে হবে। মাদ্রাসা যাবো।
অনেকগুলো কাজ আছে। দুপুরে খেয়েদেয়ে ড্রয়িং রুমে আলোচনা হবে”। আমি দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে না চাইলেও ঘাড় নেড়ে সম্মতি দেওয়া ছাড়া আর উপায় ছিল না।
যাই হোক প্রবল উৎসাহে অপেক্ষা করতে লাগলাম দুপুরবেলার। তারপর যথাসময়ে খাওয়ার পরে ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখি হাত-ভর্তি জোয়ান নিয়ে আব্বু গদিতে আগে থেকেই রেডি।
হাতের কাছে গোটা কতক বই। বুঝলাম হাতে-গরম প্রমাণ দেওয়ার জন্য রেডি হয়ে আছে। আমি উল্টোদিকের চেয়ারে বসলাম। মাঝে একটা ছোট্ট টেবিল। আমি আগের আলোচনার খেই ধরিয়ে দিয়ে বললাম, “তাহলে আব্বু তোমার কথা মতো শিয়ারা মুসলমান নয়।
তাহলে কি সুন্নিরা সকলেই মুসলমান?”
আব্বু ঠিক বুঝতে পারল না মনে হয়। তাই ব্যাখ্যার জন্য আমি বললাম, “আচ্ছা, সুন্নিও তো একটা সম্প্রদায় নয়, তাহলে এদের সকলেই কি প্রকৃত মুসলমান? মানে এরা তো সব করে,নবী যা যা নির্দেশ করেছেন, তাহলে এদের সকলকেই কি মুসলিম বলবো?”
--“হ্যাঁ, তা তো বলতেই হবে। সুন্নিরা তো আলাদা নয় তেমন। ”
এই নিয়ে বিতর্কে যেতে পারতাম, কিন্তু ইচ্ছা করেই চুপ রইলাম। আমি বললাম, “এবার মালয়েশিয়া আর ইন্দোনেশিয়ার দিকে চোখ ফেরাই।
আমরা কি দেখতে পাব? এরাও প্রায় সকলেই সুন্নি মযহাবের, কিন্তু এরা রামায়ণ পড়ে, রাম কে ঈশ্বরের থেকে কোনও অংশে কম করে দেখে না। এদের মতে লক্ষ্মী অর্থ ও সম্পদের দেবী। তাহলে সম্প্রদায়গত ভাবে সুন্নিদের প্রকৃত মুসলিম বলা গেলেও আসলে তো তারা স্রষ্টার শরিক করছে। তাহলে কি এদের প্রকৃত মুসলিম বলা যায়?”
আব্বু বিক্ষুব্ধ স্বরে বলে উঠলেন, “ওরা তো যতরকম হিন্দুয়ানী করা যায় সব করে। ওরা আবার মুসলমান কিসের!”
--“তাহলে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মুসলিম জনসংখ্যা বিশিষ্ট দেশটি আসলে কাফেরদের দেশ, ওদেশের লোক প্রকৃত মুসলমান নয়”, এই বলে চুপ করে গেলাম।
বুঝলাম প্রসঙ্গ পাল্টাতে হবে। নয়ত আব্বু যা রাগী, আমার কাজের কাজ মাটি হয়ে যাবে। প্রসঙ্গ পাল্টে আবার প্রশ্ন করলাম, “আচ্ছা আব্বু কোন কোন বইতে পড়ি ইসলাম নাকি পৃথিবীর প্রাচীনতম ধর্ম, কিন্তু ইতিহাস তো বলে বেদ প্রাচীনতম ধর্মগ্রন্থ আর সনাতন হিন্দু ধর্মই প্রাচীনতম ধর্ম। কোনটা ঠিক বলে তোমার মনে হয়?”
--“আসলে নবী তো আর ইসলামের প্রথম নবী নন, উনি শেষ নবী ও মহানতম নবী। প্রথম নবী হজরত আদম।
তিনিই প্রথম মুসলিম। তার সন্তান হিসাবে আমরা সকল মানুষই মুসলিম। এরপর একে একে অনেক নবী এসেছেন আল্লাহ্র বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে। তখন থেকে এখন পর্যন্ত আল্লাহ্র বাণীর কোন পরিবর্তন কিন্তু হয়নি। মানুষের মুখে মুখে এই সব বিকৃত হয়েছে দেখে আল্লাহ্ কোরানকে চির অবিকৃত তৈরি করেছেন।
তাই বলা যায় নাম হয়ত ইসলাম ছিল না কিন্তু বিষয়টা একই ছিল”।
আমি সহমত হতে না পেরে একটু ইতস্তত করে বললাম, “এটা তো ঠিক মনে হল না আব্বু! যেমন ধরা যাক, আদমের সময় তো খৎনা ছিল না। তাই খৎনা-হীন আদম মুসলিম নবী ছিল একথা কিভাবে বলা যায়? আর যদি তাকে মুসলিম এবং নবী বলা যায়, তাহলে বুঝতে হবে আল্লাহ-র বাণীতে খৎনা বলে আসলে কিছুই ছিল না। আমরা এটা অনেক পরে দেখতে পাই, তাই নিশ্চিতভাবেই বলা যেতে পারে যে এইটা আসলে মানুষের তৈরি, স্রষ্টার বাণী নয়। মূল বিষয়ে অর্থাৎ স্রষ্টা প্রদত্ত বাণীতে এটা ছিল না।
তাহলে কোরআন হোক বা ইঞ্জিল, এগুলোই বিকৃত মনে করা ঠিক নয়?”
--“কোরআন কখনই বিকৃত হতে পারে না”, আব্বু খুব জোরের সঙ্গে বললেও কোনও যুক্তি বা তথ্য দিল না।
আমাকে আবার প্রসঙ্গে ফিরে আসতে হবে আব্বুকে না চটিয়ে। তাই আবার প্রশ্ন করলাম, “আচ্ছা আব্বু, ইসলামের উদ্দেশ্য কি বলে তোমার মনে হয়? মানুষের মূল লক্ষ্য কি, ইসলাম তা কিভাবে পূরণ করবে?”
--“দ্যাখ! মানুষ দুঃখ চায় না সুখ এবং শান্তি চায়। এটাই মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। আমরা এত সব করি সুখ-শান্তির আশায়।
এই জগতে তা সম্ভব নয়। ইসলামের রাহে চললে নেকী হাসিল হয়, জান্নাত নসিব হয়। সেখানে চির সুখ চির শান্তি। এই তো মানুষের লক্ষ্য। ”
--“তবে কি ইসলাম ছাড়া জান্নাত পাওয়া যেতে পারে না?” আমি বলতে না বলতেই আব্বু বলে উঠলো , “কখনই না।
একমাত্র ইসলামই পথ”।
আমি বললাম, “আর যদি সেই উদ্দেশ্য হাসিল না হয়, অর্থাৎ যেসব মুসলিম জান্নাতে যেতে পারবে না, তাদের সাথে অমুসলমানের পার্থক্য রইল কি?”
--“ বরং ভেবে দেখ, কি জন্য তারা জান্নাতে যেতে পারবে না? নিশ্চয়ই তারা প্রকৃত মুসলিম নয়! ”
--“Exactly! আমিও তো ঠিক এই কথাটাই বলতে চাইছিলাম। নবী (সাঃ) বলেছেন, দোযখে নাকি বেশিরভাগই নারী। জান্নাতে নারীর সংখ্যা নাকি খুব কম! তাহলে বেশিরভাগ মুসলিম নারী প্রকৃতপক্ষে মুসলিম নামধারী হলেও আসলে মুসলিম নয়। ”
--“না নয়তো! এই তোমাকেই দ্যাখো, কত আশা নিয়ে পড়াশুনা শেখালাম।
কিন্তু আমাকে সালাম পর্যন্ত দাও না। আমার কি করার আছে, চেষ্টার তো ত্রুটি করিনি আমি। সব কর্মের হিসাব তো ওখানেই দিতে হবে। ”
--“সে আর আমি কি করবো? আমাকে আল্লাহ্ যেভাবে তৈরি করেছেন আমাকে তো সেইভাবেই চলতে হবে! সেটাই তো আমার নসিব! এতে আবার আমার দোষ কোথায়?”
--“মুখের উপর কথা বল না বেশি”, উত্তরটা পেয়ে স্বাভাবিক ভাবেই উত্তেজিত স্বরে বললেন, “যা জিজ্ঞাসা করছ করে নাও, যদি নজর একটু দ্বীনের দিকে একটু ফেরে!”
--“তাহলে তোমার মতে মুসলমানি করার উদ্দেশ্য কি? পুরুষ শিশু যখন জন্ম নেয়, তখন তাকে মুসলমানি করা নাকি ফরয। কিন্তু আমার প্রশ্ন হল, তাহলে মানুষকে আল্লাহ্ যখন মুসলিম করে পাঠায় না, তখন অযথা খোদার উপর খোদকারী করে মুসলমানি করা কেন? বিশেষ করে এটা যখন দুনিয়ায় শিশু নির্যাতনের পর্যায়ে পড়ে, যা কিনা আসলে অপরাধ।
”
--“আল্লাহ্ তো নির্দেশ দিয়েছেন মুসলমানি করার। ”
আমি বললাম, “তাহলে কি মুসলমানি করার আগে শিশুটি মুসলমান নয়?”
--“না নয়! বাকি আলোচনা পরে হবে সন্ধ্যায়। ” ,আব্বু উঠে শোওয়ার ঘরের দিকে পা বাড়াল ।
আমি সন্ধ্যায় আবার ড্রয়িং রুমে এসে বসলাম দুই কাপ কফি হাতে। আব্বুর হাতে একটা কাপ ধরিয়ে দিয়ে বললাম, আর খুব কম প্রশ্ন বাকি রয়েছে।
এগুলোর উত্তর পেলেই চলবে। আমি শুরু করলাম--
“আব্বু তুমি নিশ্চয়ই জানো ইসলাম বলে রোজ পাঁচবার নামাজ পরতে হবে। এটা ইসলামে অবশ্য-কর্তব্য। কিন্তু এখনকার কর্মব্যস্ত জীবনে রোজ পাঁচবার নামাজের সময় অনেকের হাতেই থাকে না! এরা কি প্রকৃত মুসলিম?”
--“দ্যাখো, প্রকৃত মুসলিম হলে তাকে তো নামাজ পরতেই হবে। নবী এই সবের উপরেই সমান গুরুত্ব দিয়েছেন, কলেমা, নামাজ, যাকাত, রোজা, আর সামর্থ্য থাকলে হজ্ব!” এগুলোর একটাও বাদ গেলে হবে না।
ইসলামে যা কিছু ফরয তা পালন না করলে তাকে কি সত্যিকার মুসলিম বলা যায়?”
--“তার মানে তোমার উত্তর হল ‘না’। কিন্তু আমি বা ভাই কেউ তো নামাজ রোজা করি না। আম্মি করে কিন্তু তোমার মতো বাড়াবাড়ি...”
কথাটা শেষ হতে দিল না আব্বু, “কি বাড়াবাড়ি!” রীতিমত উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগলেন, “যা করি আমার ইমান দুরস্ত রাখতে করি। আমি মুসলিম এটা আমার কাছে গর্বের। তোরা করিস না, তোদের কিছু বলি কি? এটাও আমি সেই মহান আল্লাহ-র বাণী মেনেই করি।
”
আমি বলতে যাচ্ছিলাম যে তুমি তো মুসলিম বিবেকানন্দ, কিন্তু চেপে যেতে হল। খালি একটা শব্দেই এই অবস্থা! তার উপর একথা বললে কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তার ঠিক নেই! বললাম, “কয়েক বছর আগে যে দেখতাম তুমি রিয়ায কে মারতে শুধু নামাজে না বসার জন্য!”
--“রসুলুল্লাহ বলেছেন, সন্তানের সাত বছর বয়স হলে তাকে নামাজ আদায় করতে বল আর দশ বছরেও যদি সে নামাজ আদায় না করে তাহলে মারধর করো!”
আবু দাউদে আছে জানা সত্ত্বেও আব্বুকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কোরআনে আছে?”
“না”, আব্বু বলল, “হাদিসে”।
আমি স্বগতোক্তির ভান করে আব্বুকে শুনিয়ে বললাম, “আল্লাহ্র তো দেখি বহুমুখী প্রতিভা! একবার বলে জোর জবরদস্তি নেই, পরক্ষনেই আবার পেটাতে বলে!”
বলতে বলতেই দেখি আম্মি হাজির টিফিন নিয়ে। আম্মি জানে যে আমি আব্বুকে কতটা ভালবাসি! আমাকে বলল, “হ্যাঁরে তোদের কথা তো শেষই হচ্ছে না। ” পাশের ঘরে রিয়ায পড়তে পড়তে খোঁচা দিলো একটু গম্ভীর স্বরে, বোঝো না কেন আম্মি বিপরীত মেরু পরস্পরকে আকর্ষণ করে”।
কোনও উত্তর দেওয়ার সুযোগ না দিয়েই আবার গুনগুণ করে পড়া শুরু করলো। আমিও কথা বাড়ালাম না। আব্বু দেখি ডিমের টোস্টে কামড় দিয়েছে। আমি গোটা কতক পাঁপড় তুলে নিয়ে আব্বুকে প্রশ্ন করলাম, “আব্বু, যারা নেশা করে নিয়মিত এবং প্রচুর, তারা কি প্রকৃত মুসলমান?”
আব্বু বলে উঠলো, “ তুমি কি জানো না, ইসলামে নেশা করা হারাম! সেই জন্য দ্যাখো মুসলিম দেশগুলোতে মদ্যপানের সংখ্যা প্রায় নেই বললেই চলে!”
--“ তুমি খবর রাখ না আব্বু। তুমি কি জানো বিখ্যাত পত্রিকা ‘দি ইকনমিস্ট’ অনুসারে ২০০১ সাল থেকে ২০১১ সাল অব্দি সারা পৃথিবীতে মদ বিক্রি বেড়েছে ৩০ শতাংশ।
সেখানে মুসলিম দেশগুলোতে মদ বিক্রি বেড়েছে ৭২ শতাংশ!”
আব্বু অবাক হয়েছে মনে হল। বলল, “সত্যি বলছ! কারো প্রতি অভিযোগ করার আগে কিন্তু একশবার ভেবে নেওয়া উচিত!”
এই নির্দেশ ইসলামে কোথায় আছে তা আমার জানা নেই অবশ্য, কিন্তু আমি আমার বক্তব্য প্রতিষ্ঠার জন্য আরও তথ্য দিয়ে বললাম, “শুধু তাই নয়, কিছু বিশেষ ধরনের ড্রাগ (সেক্স ড্রাগ,সেটা উল্লেখ করিনি)সৌদি আরবে বিশাল পরিমাণে বিক্রি হয়। প্রতি বছরে এই ড্রাগগুলো যে পরিমাণে বিক্রি হয় তা নাস্তিক দেশ রাশিয়ায় বিক্রির দশ গুন। কিন্তু জনসংখ্যার দিক থেকে দেখতে গেলে দেখা যাবে সৌদি আরবের জনসংখ্যা রাশিয়ার জনসংখ্যার প্রায় পনের গুণ। তাছাড়া যদি স্মোকিং-এর কথা ধরা যায়, তাহলে দেখতে পাব যে, মুসলিম দেশ গুলোতে স্মোকিং এর প্রবণতা খ্রিস্টান বা ধর্মনিরপেক্ষ দেশগুলোর চেয়ে কম তো নয়ই বরং অনেক ক্ষেত্রেই বেশি।
তাহলে এরাও তো প্রকৃত মুসলিম নয়?”
--“নয়” , আব্বু একটু থেমে নিয়ে বললেন।
আমি বললাম, “ কিন্তু স্মোক করা মুসলিম তো নামায রোজা যাকাত হজ্জ করে, তবুও তো তারা প্রকৃত মুসলিম নয়। তবে যে তুমি বললে যে এসব যারা করে তারাই প্রকৃত মুসলিম --”
আব্বুর মুখে কোনও কথা নেই। আমি বুঝতে পারলাম, আব্বুর সবজান্তা ভাবটা কেটে গিয়েছে। যদিও তা স্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা শূন্য।
মুসলিম বলতে ঠিক কি বোঝায়, কি কারণে কাউকে প্রকৃত মুসলিম বলা যায়, তার কোনও স্পষ্ট উত্তর দিতে না পেরে আব্বু যেন বিধ্বস্ত।
--“বাদ দাও! তাহলে এখন বরং একটু রাফ হিসাব করে নিই মুসলিমদের সংখ্যা বিষয়ে--”, বলে আমি একটু সময় নিয়ে আব্বুর কোঁচকানো ভুরুর দিকে একবার আড়চোখে চেয়ে নিয়ে মাথা নিচু করে বলতে শুরু করলাম, “ যদিও শিয়া সম্প্রদায়কে সুন্নিরা বারবার অমুসলিম হিসাবে দাবী করে এসেছে এবং তাদের জনসংখ্যা ৩% থেকে ৫% হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করে এসেছে, কিন্তু নিরপেক্ষ অনেক পৃথক গবেষণা থেকে জানা যায় যে তাদের সংখ্যা ১০ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে। আমরা যদি গড়ে ১৫ শতাংশ ধরে নিই। তাহলে ১৫০ কোটি মুসলিমের মধ্যে ২২ কোটি শিয়াদের বাদ দিলে হয় ১২৮ কোটি। এবার ইন্দোনেশিয়ার ২০ কোটি মুসলিম যদি বাদ পড়ে যায়, তাহলে থাকে ১০৮ কোটি।
মালয়েশিয়ার ১ কোটি বাদ দিলে থাকে ১০৭ কোটি। এবার এই ১০৭ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় অর্ধেক, মানে ৫৩ কোটি নারী। এই নারীদের অধিকাংশ মানে অন্তত ২৭ কোটি যদি বাদ পরে,তবে থাকে ৮০ কোটি। ”
“--না না, এভাবে হিসাব করলে চলে নাকি?” আব্বু আমাকে থামানোর জন্য সচেষ্ট হতেই আমি থামতে বলি, “না আব্বু,আমার কথা এখনো শেষ হয়নি। আমি বলে নিই একটু থামো, তারপর বোলো”।
আব্বু কেমন যেন চুপ করে গেল। আমি তো জানি এই লজিক ভুল প্রমাণ করা কঠিন বলে আব্বুর যত ছটফটানি। আমি আবার বলতে শুরু করলাম, “এই ৮০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে আমরা ১৪ বছরের কম বয়স্ক পাই ২০% মানে ১৬ কোটি। আর দশ বছরের কম কতজন তা পাওয়া না গেলেও মোটামুটি আন্দাজ করে নিতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তো ধরে নিলাম প্রায় ১০ কোটি।
জানি এই ১০ কোটির মধ্যে কয়েক কোটি নারী-শিশু এমন থাকবে যা আগেই বাদ পড়ে গেছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও এটা যেহেতু একটা রাফ হিসাব তাই আপাতত এটা ধরেই এগোতে পারি। অর্থাৎ পড়ে রইল ৭০ কোটি। এবার এই ৭০ কোটির কতজন রোজ পাঁচ বার নামায পড়ে? আমাদের পাড়ার হিসাবে ধরলে তুমি একা। সেই হিসাবে ধরলে সংখ্যা কি থাকবে তা তো বোঝাই যায়। আর এসবের হিসাব তো বই, ইন্টারনেট কোথাও পাওয়া যায় না।
যদি ধরে নিই যে এর অর্ধেক লোক রোজ পাঁচ বার নামায পড়ে, তাহলে তো থাকে ৩৫ কোটি। এরপর ধরো মুসলিম দেশগুলোতে নেশার হার যেভাবে বাড়ছে তাতে তো সৌদি আরব,লেবানন,বাহারিন, ইরাক সেই সব দেশের অধিকাংশই বাদ পড়ে যাবে, ভারতের মতো কাফেরদের আচার আচরণে অভ্যস্তদের কথা তো বাদই দিলাম। তাহলে সত্যিকার মুসলিম ঠিক কত আব্বু? আর তোমাদের মতে তো শুধু নামে মুসলিম হলেই মুসলিম হয় না। এরপরও সমস্ত মুসলিমরা গলা ফাটায় এই বলে যে—“Islam is the fastest growing community”
যত রাগ আছে সমস্ত ঝেড়ে দিয়ে চুপ করতেই আব্বু ঘড়ির দিকে ঈশারা করে বলল, “তাকিয়ে দ্যাখ কটা বাজে। চল খেতে যেতে হবে।
তোর আম্মি ডাকছে মনে হয়। ” ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত্রি এগারোটা চার বাজে। আম্মি দরজার কোনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছিল এতক্ষণ মনে হয়। দেখি রীতিমত ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে। আমি কথাটা কেয়ার না করার ভাণ করে বললাম, “কি যেন বলছিলে না?”
--“কথা পড়ে।
আগে চলো খেতে হবে। আম্মিকে তো বাসন ধুতে হবে নাকি?”
আমি গলার টোনে বুঝে গেলাম, সেই পড়েটা আর আসছে না। বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল। এর মাঝে অনেকক্ষণ অনেক বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, তবু আব্বু ওই প্রসঙ্গ আর টেনে আনেন নি। আমি আনার একাধিক চেষ্টা করলেও আব্বু সন্তর্পনে এড়িয়ে গেছেন।
যাই হোক, আরও অনেক বিষয় বাকি রয়ে গেল আলোচনার। সমস্ত দিক বিবেচনা করে অপসারন পদ্ধতিতে এগিয়ে চললে দেখা যাবে পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর দশা, মানে সত্যিকার মুসলিম বলে শেষমেশ কিছুই পাওয়া যাবে না হয়তো। তবে মুসলিমরা ‘সত্যিকার মুসলিম’ নামক এই শূন্যগর্ভ ধারনাটিকে নিয়ে এত মাতামাতি কেন করে? সেই আলোচনা নয় পরে আরেকদিন হবে। শুধু আফসোস, শেষ প্রশ্নটা আব্বুকে আর করা হল না। তবে একদিন নিশ্চয়ই করবো প্রশ্নটা -- তুমিও কি সত্যিকারের মুসলিম? ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।