জীবন যেখানে যেমন..........
একরাশ কষ্ট নিয়ে অবশেষে দেশ ছেড়ে চলে আসতেই হল। যদিও একান্তই আমার অনিছছায়। কিন্তু আমার কিছু করারও ছিল না। এমন সুযোগ হয় ই বা কয়জনের ভাগ্যে!! যাই হোক মূল প্রসঙ্গে আসি, ঢাকার একটি নামকরা স্কুল এবং কলেজ থেকে ভাল রেসাল্ট করে যখন বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি গুলো তে ভরতি পরীক্ষা দিচ্ছি, তখনই জানতে পারলাম এই দুঃসংবাদ (নাকি সুসংবাদ!) টা। আমাদের পুরো পরিবারের কানাডা যাওয়ার ভিসা হয়ে গেছে।
যেহেতু উচ্চশিক্ষার জন্য কোন না কোন সময় দেশের বাইরে আসতেই হতো তবে আগেভাগেই কেন নয়?
এই ঘটনা টাই আর ৩-৪ বছর আগে ঘটলে হয়তো আমার তেমন কোন খারাপ লাগতো না। বরং খুব খুশিই হতাম। কারণ আমার অনেক স্কুল কলেজের-ই অনেক ফ্রেন্ড দের কে চলে আসতে দেখে মনে হত, ওরা স্বর্গরাজ্যে যাচ্ছে। কিন্তু এই স্বর্গরাজ্য যে আমাকে আমার হতদরিদ্র দেশের মত সুখ দিতে পারবে না একথা কি কখনো টের পেয়েছিলাম?
এস.এস.সি ও এইচ.এস.সি পরীক্ষা দেয়ার আগে দিয়ে কানে বাজতো একটাই মন্ত্র, এখন ভালো করে পড়ে পরীক্ষা দিতে হবে। এইতো, কলেজের গণ্ডি পেরুলেই খালি আনন্দ আর আনন্দ।
ইউনিভার্সিটি তে বন্ধু-বান্ধব্দের সাথে আড্ডা, আর খালি ঘুরাঘুরি সাথে অল্প একটু পড়াশোনা। একটা কথা বলে নেয়া ভাল, ডাবল জিপিএ ৫ পাওয়ার পর ও কিন্তু আমি অন্য সবার মতো আমি বুয়েট কিংবা মেডিকেল এ পড়ার স্বপ্ন আমি কখনো দেখিনি। আমার স্বপ্নের জায়গা ছিল একটাই, ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটি’। সেই স্বপ্ন আমার ভেঙ্গে গেলো এই কানাডা আসার জন্য। শুধু কি তাই? পহেলা বৈশাখ, পহেলা ফাল্গুন, বইমেলা, বিজয় দিবস আরও কত প্রানের উৎসব এ শাড়ি, চুড়ি আর ফুল পরে বান্ধবীদের সাথে ঘুরবো টি.এস.সি. চত্বরে , ক্লাস শেষ হলে চলবে ফুচকা খাওয়ার প্রতিযোগিতা, বিভিন্ন সাংস্ক্রৃতিক অনুষ্ঠানে গলা ছেড়ে গান গাইবো আরো কত কি! স্বপ্নপূরণ না হোক বা না হোক স্বপ্ন দেখার তো নেই মানা!
এখন আবার নতুন যুক্ত হয়েছে বিশ্ব কাপ ক্রিকেট, দেশে থাকার সময় আমি প্রায়-ই আমার বাবা, ভাই, এবং অন্য কাজিন দের সাথে খেলা দেখতে স্টেডিয়াম এ যেতাম।
আমাদের দল জিতুক বা হারুক, চিৎকার করতে করতে, গ্যালারী মাতিয়ে, গলা ব্যথা করে তবেই বাসায় ফিরতাম। আমাদের বাসার মোটামুটি সবাই ছিল ক্রিকেট পাগল, তাই প্রথম প্রথম কিছু না বুঝে খেলা দেখা শুরু করলেও একসময় খেলাটা কে উপভগ করা শুরু করি। দেশের মাটিতে ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আসরে আমি থাকবো না, একথা ভাবতেই কষ্ট হয়।
কিছুদিন আগে এখানকার একজন আন্টি বাংলাদেশ থেকে ঘুরে এসে আমাকে বললেন, “ তুমি যে এত বাংলাদেশ বাংলাদেশ কর, দেখে তো আসলাম এখনকার অবস্থা, মানুষ বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পরেছে, যা গরম তার উপর লোডশেডিং, পানির সমস্যা ইত্যাদি ”। তাঁকে মুখের উপর কিছু বলতে পারলাম না ঠিক ই, কিন্তু আমি তো জানি, আমার দেশ গরীব, বহু সমস্যায় জর্জরিত; সেই দিক থেকে কানাডা অনেক বেশি উন্নত, নিরাপদ।
কিন্তু আন্টি আপনি কি জানেন? এত সুবিধার মধ্যে থেকেও আমার ভাল লাগে না। পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট, ঝলমলে শপিং সেন্টার, তুষারাবৃত পরিবেশ আমাকে আকৃষ্ট করেনা। আমার রিকশায় চড়তে ইচ্ছা করে, এখানেও বৃষ্টি হয়, কিন্তু মাটির সেই সোঁদা গন্ধ পাওয়া যায়না, আমার সেই সোঁদা গন্ধ পেতে ইচ্ছা করে, আরও ইচ্ছা করে কাকের ডাক শুনতে, ঝিম ধরে থাকা দুপুরে কোনও এক ফেরিওয়ালার হাঁক শুনতে! খুব কি হাস্যকর শোনাচ্ছে? কি জানি হতেও পারে। কারন, আমার নিজেরই কিছু আত্মীয় আর বন্ধুবান্ধব আছে (যারা বিদেশে আসার স্বপ্নে বিভর, এবং আমি আসতে মানা করেছি) যারা ভাবে, “ও, নিজে পার হয়ে গিয়েছো তো তাই আমাদের আর আসতে দিতে চাওনা। ” আসল টা যে কি, আমি কিভাবে বোঝাবো তাদের কে?
সত্যি কথা টা শুনলে হয়ত অনেকে হাসবে, অনেকে পাগল ভাববে।
এখানে এসে আমি আল্লাহর রহমতে আমি University of Toronto তে চান্স পেয়েছি, কিন্তু এখনও পর্যন্ত অনেক মিস করছি আমার দেখা স্বপ্ন গুলোকে। আমার আর আমার ভাইয়ের জন্য আমার মা-বাবা দেশের এত ভাল চাকরি ছেড়ে নিঃস্বার্থ ভাবে চলে আসলেন। এখানেও মনের মাঝে একটা কষ্ট কাজ করে সবসময়। করতে পারব তো তাঁদের স্বপ্ন পুরন?
ভিন্ন পরিবেশ, ভিন্ন দেশি মানুষজন, এতো সহজেই কি আর আপন হয়? তারপর ও প্রাণপণ চেষ্টা করছি নিজেকে মানিয়ে নিতে, এই ক’দিনে কিছুটা সফলও হয়েছি বলা চলে, কিন্তু মনের কোন এক কোণে যেন এখনও হাতছানি দেয় আমার প্রিয় শহরটা, দেশটা, দেশের মানুষগুলো। শত ব্যস্ততার মাঝেও ভুলতে পারি না।
এখন থেকে কত উৎসব আসবে যাবে আমার প্রিয় দেশটায়, মানুষ মেতে উঠবে আনন্দে; কিন্তু হাজার হাজার মাইল দুরে বসে থাকা এই আমার দীর্ঘ নিঃশ্বাস, আকুলতা, হাহাকার কি পৌঁছবে সেখানে?
পুনশ্চঃ আমার আগামী লেখাগুলোতেও হয়তো এই তুলনা গুলো উঠে আসবে। আর এতদিন শুধু ব্লগ পড়েই এসেছি, কিন্তু ব্লগ লেখার ব্যাপারে আমি একেবারেই নতুন। প্রবীণ ব্লগারদের যেকোনো মতামত গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করব।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।