আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বলদের হালচাষ,আমাদের নিস্ফলা মাঠ এবং ভবিষ্যতের শুণ্য গোলাঘর

"I may disagree of what you say, but I will defend to the death - your right to say it." – Voltaire

বলা হয়ে থাকে শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড, জ্ঞানই শক্তি, জানার কোন শেষ নাই। এই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে আমরা দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান আহরণ করতে থাকি। কিন্তু কতটুকু জ্ঞানার্জন আমাদের জন্য যথেষ্ট, কতটুকু জ্ঞানার্যনের মাধ্যমে আমরা নিজেদের সম্পূর্ণ ভাবতে পারব, সমাজস্বীকৃত হব তার পরিমাপ কি জানা আছে আমাদের কারো? একটা শিশু জন্মের পর থেকেই তার পারিবারিক অবস্থা যেমন হোক না কেন তার শিক্ষার অধিকার নিয়ে পরিবার,সরকার এবং অনেক ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে এক ধরনের সচেতনতার বলয় গড়ে ওঠে। শুরু হয় শিক্ষার জগতে শিশুর প্রবেশ যা বেশীরভাগ শিশুর জন্যই খুব একটা সুখকর অভিজ্ঞতা নয়। তাদের অনেকেই তখন সে জগৎ থেকে বেরিয়ে আসতে চায়।

কিন্তু আমরা, যারা খুব গলা ফুলিয়ে বলি “শিশুদের জন্য হ্যাঁ বলুন”, তারাই তখন সেই শিশুদের ঘাড় ধরে শিক্ষার জগতে ঢুকিয়ে দেই। অনেকে হয়ত বলবেন শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটির কথা, শিক্ষাখাতে দূর্নীতির কথা। কিন্তু আমরা ভেবে দেখি না একটি পরিবারের জন্য একটি শিশুকে এরকম অসীম জ্ঞানার্জনের পথে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া আদৌ বাস্তবসম্মত ধারণা কি না। আমাদের সমাজের দিকে যদি তাকাই, এখানে যারা দারিদ্রসীমার নিচে আর যারা বিত্তসীমার ওপরে, তাদের সবাই চান তাদের সন্তান শিক্ষিত হোক, স্বাবলম্বী হোক। কিন্তু কতটূকু শিক্ষাগ্রহণ করার পর একজন বিত্তহীনের সন্তান নিজেকে যোগ্য ভাবতে পারে? স্বাবলম্বী ভাবতে পারে? আমাদের সমাজে যারা গরীব তাদের মনে এক কূহকের জন্ম দেওয়া হয় যে তাদের সন্তান অনেক পড়ালেখা করে একদিন অনেক বড় হবে তারপর তাদের ওপর অন্যায় করে যারা বড় হয়েছে তাদের বিচার করবে।

এভাবেই বরং সমাজে শ্রেণীবিভক্তি আরো তিক্ততা লাভ করে। ভাগ্য-বিড়ম্বিত মানুষের সন্তানেরা ধরে নেয় সমাজ তাদের শোষণ করে, তার চেয়ে বড় কথা তারা সমাজের সবকিছুকেই তাদের পূর্ব-পুরুষের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া সম্পত্তি মনে করে এবং গোলযোগের মূহুর্তে একটি গাড়ি পুরিয়ে কিংবা একজন মানুষকে নির্মমভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারে। আর যারা অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের সন্তান তাদের কাছে পড়ালেখা অনেকটা মজার ব্যাপার। পড়ালেখার নাম করে তারা ঘ্র থেকে বের হয়, ক্লাস ফাঁকি দিয়ে নিজেদের খুব বুদ্ধিমান ভাবে, কোনভাবে গ্রাজুয়েশন শেষ করে পারিবারিকভাবে আয়ের ব্যবস্থা আর ব্যক্তিগত ভাবে পরিবার খুঁজে নেয়। আজ আমরা যারা লেখাপড়া করছি, তারা নিজেরাও জানি না তাদের লক্ষ্য কি।

যেখানে পৃথিবীতে হাজার হাজার মানুষ খেতে না পেয়ে মারা যাচ্ছে এবং ভাবছে যদি তারা সামান্য খাদ্য কিনতে যতটুকু পড়ালেখা করতে হয় তা করতে পারলেই তারা বেঁচে যায়, সেখানে পড়ালেখা করা মানুষগুলো চরম বিরক্তি নিয়ে পড়ছি, এসাইন্মেন্ট করছি আর ফেইসবুকে আপডেট দিচ্ছি “পড়ালেখা করতে চাই না/ আমার বই খাতা ভাল লাগে না” (ভাষা এতটা মার্জিত থাকে না)। উচ্চশিক্ষা ব্যপারটাও অনেক ধোঁয়াটে। বেশিরভাগ উচ্চশিক্ষা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। দেখা যায় জনগনের টাকায় পরা ছাত্র-ছাত্রিরা মেধাবী হয় এবং দেশে তাদের সংকুলান হয় না। তারা বিভিন্ন উন্নত দেশে পাড়ি জমান।

এই দেশে না তারা তাদের যোগ্য কর্মক্ষেত্র পান, না তাদের জ্ঞানপিপাসা মেটানোর উপকরন পান। অপরদিকে বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চশিক্ষালাভকারীরা যদি দেশে কিছু করতে চান তখন তাদের মনে এতদিনে তাদের জ্ঞানার্জনে যত খরচ হয়েছে তার একটা বিবরণ ভেসে ওঠে এবং তারা চাইলেও সুলভে সেবা দিতে পারেন না। তাদের মধ্যে যারা মেধার স্বাক্ষর দেখাতে পারেন, বিদেশে তাদেরও সু-ব্যবস্থা হয়ে যায়। পেছনে পড়ে থাকে শুধু এই ছোট্ট স্বদেশ। একথা স্পষ্ট প্রতীয়মান যে আমাদের মেধাবী মুখগুলো আমরা আমাদের মাঝে রাখতে পারি না, তার কারণ আমাদের দেশে অবকাঠামোগত দারিদ্র্য বিদ্যমান।

এখানে প্রয়োজনীয় শিক্ষোপকরণ নেই, অবকাঠামো নেই, আছে চরম অব্যবস্থাপনা। এর মাঝে আমরা উচ্চ শিক্ষিত হতে গিয়ে হয়ে উঠছি ভোক্তাশ্রেণী। যাদের জাতি গঠনে,অবকাঠামো গঠনে অবদান খুবই সামান্য কিন্তু এই ভোক্তা জনগোষ্ঠীকেই উন্নত বিশ্বের সমমানের বিলাস-সামগ্রী ব্যবহার করতে হয়। দেশে কলকারখানা বন্ধ হয়ে বড় বড় মার্কেট গড়ে ওঠা মানে হল জাতি আমদানী নির্ভর হয়ে পড়া। আমাদের মধ্যবয়সের প্রারম্ভে এসেও পড়ালেখার পাঠ চুকে না, কর্মমুখী শিক্ষার কোন ব্যবস্থা নেই এবং স্বাবলম্বী হতে আমাদের অনেক সময় লেগে যায়।

এইখানে চলে আসে ছাত্ররাজনীতির প্রসঙ্গ। আমরা আমাদের অতীতে ছাত্ররাজনীতির এক সোনালী অধ্যায় দেখি আমাদের ইতিহাসে। কিন্তু এখন কি দেখি? এখন দেখি সমাজ-জীবনে অবস্থান তৈরীতে ব্যস্ত নিম্ন-মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত ছাত্রটি যখন কোথায় থাকবে, কি করবে, খাবে কি এসব নিয়ে বিচলিত, তখন পাশে এসে দাঁড়ায় ছাত্র সংগঠনগুলো। তদের হয়ে কাজ করার মাধ্যমে ছেলেটি পায় হোস্টেলের সীট, পরীক্ষা পাশের নিশয়তা, সামাজিক পরিচিতি এবং রাজনৈতিক প্রতিপত্তি। তবে সে বড় রাজনৈতিক নেতা হতে পারে না।

কারণ তাদের ওপরে সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ সতর্ক দৃষ্টি রেখে তাদের ব্যবহার করতে থাকে এবং তাদের প্রতিপত্তি নিজেদের জন্য হুমকি মনে হলে কিংবা প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে খরচ করে দেয়। উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেরা রাজনীতিতে কমই আসে। তবে তাদের হঠাৎ করে নেতা/প্রেসিডেন্ট ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ পদে দেখা যায়। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেরা এসব এড়িয়ে চলে। তবে সময় ও সুযোগ অনুযায়ী সকল রাজনৈতিক দলের মানুষ থেকেই সহায়তা নিতে থাকে এবং খুব ভাব নিয়ে দেশের রাজনীতির দূরবস্থা এবং রাজনীতিবিদদের দূরনীতি নিয়ে বলতে থাকে।

যদি বাস্তবধর্মী শিক্ষা ব্যবস্থা হত, প্রত্যেক নগরিক যৌবনে পদার্পনের আগেই কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত হত, দেশে কাজ করার ক্ষেত্র থাকত তবে হয়ত জীবনের সাফল্য-ব্যর্থতা এবং স্বার্থকতা বিচারের মাপকাঠিতে নিজেকে বিচার করা নিজেদের জন্যই সহজ হত। এখন বাছ-বিচার না করে সব কিছু পড়তে গিয়ে আমাদের অবস্থা দাঁড়িয়েছে বলদ দিয়ে হালচাষের মতই, যার জন্য আমাদের নিস্ফলা মাঠ এবং ভবিষ্যতের শুণ্য গোলাঘর।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.