আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চিঠি দিলাম চিঠি দিও...



চিঠি চলে গেছে। সে আর আসবে না। চিঠিকে বুকে ধরে রাখতাম আমরা। চিঠির অপেক্ষায় থাকতাম। চিঠি আর আসবে না।

এ কথা ভাবতেই আজ আমার বুকে হঠাৎ এসে কোত্থেকে জমা হয়েছে এ পাথার হাহাকার। যে চিঠি ছুঁয়ে সুখ, শুঁকে সুখ, দেখে সুখ, সেই চিঠি আর ফিরে আসবে না। চিঠি কেন আসবে না? কি হয়েছে চিঠির! না, তেমন কিছুই নয়। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে বলেই চিঠি আর আসবে না। তবু সেই চিঠি আর ফিরে আসবে না, এ কথা মানতেই চায় না এই মন।

বহুদিন আমি চিঠিকে দেখি না। শেষবার কখন পেয়েছি তা ভুলে গেছি। শেষবার কখন চিঠি লিখেছি, তা ও ভুলে গেছি। আমাদের ঘরে আসতো চিঠি। আমরা বুক পকেটে রাখতাম।

রাখতাম বালিশের নিচে। মনে হতো আমাদের বুক পকেটে আকাশ রেখেছি, বালিশের নিচে সমুদ্র। হ্যাঁ, তাইতো। আমি তো বহুদিন পোস্টকার্ড কিনি নাই। মনে পড়ে পোস্টকার্ডটিকে।

তার গন্ধটা টের পাই। মট- মটর আওয়াজটাকেও। প্রথম পাতায় লিখে দ্বিতীয় পাতার অর্ধেকটাতে লিখা যেতো। অর্ধেকটা থাকতো ‘হইতে’ ও ‘পাইবেন’ লিখার জন্য। এই বাংলা শব্দটি কেমন যেন ঠেকতো।

কিংবা এগুলো দিয়ে কিছু বোঝাবার চেয়ে টু এবং ‘ফ্রম’ লিখে সেই দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে বাকি ঠিকানাটা বাংলায় লিখতাম। পিতা চিঠি লেখার শেষে ‘পুনশ্চ’ দিয়ে লিখতেন সবচে’ মূল্যবান কথাটি- ‘তোমার বোনের অসুখ, তড়িৎ আসিয়া দেখিয়া যাইও’। কিংবা লিখতেন-‘বাজারে শীতের সবজি উঠিয়াছে। ভালোমন্দ কি খাও জানি না। কিছুদিন আসিয়া বেড়াইয়া যাইও।

’ আমার পিতা আমাকে এক চিঠির পুনশ্চতে লিখেছিলেন- ‘ছোটবেলায় তোমার ফুসফুসে একটি ত হইয়াছিল। বহু ডাক্তার দেখাইয়াছিলাম, বাড়িখানা হাসপাতাল হইয়া গিয়াছিল। তোমার নিশ্চয়ই সে কথা মনে আছে। তাই তোমাকে বলা হইতেছে ধোঁয়া ও ধুলা হইতে নিরাপদ থাকার জন্য। ’ পিতার চিঠিতেও পুত্রকে শাসন করার এ ছিল শিষ্টাচার।

ইনভেলাপ কিছুটা খানদানি ব্যাপার। টাকা থাকলে তবেই না ইনভেলাপ। তবে ইনভেলাপে যতখুশি লেখা যায় আলাদা কাগজে। এত তো আর দরকার পড়ে না যে, ওজনে ভারী হয়ে গেলে ‘বেয়ারিং’ হবে। সেই লোভেই ইনভেলাপ কেনা।

সেই ইনভেলাপে চিঠি লেখার প্যাড কিনা ছিল আরেক বিলাসিতা। ‘লাভ মি’,‘আইলাভ ইউ’ লেখা প্যাড স্বামী, স্ত্রী’র জন্য নির্ধারিত অথবা অন্তরঙ্গ দোসরদের। লাল রঙের হার্ট মার্কা প্যাড ছিল কি? মনে পড়ে না। হয়তো ছিল। হয়তো ছিল না।

লাল সবুজ হরেক রঙ্গের রোল করা প্যাডগুলো ছিল আমার মূল্যবান কাগজ-সামগ্রী। ইনভেলাপে টিকেট লাগানো হতো জিভের জল দিয়ে। হজম করা ছাড়া জিভের জলের এটাই ছিল অন্যতম ব্যবহার। একটা রটনা ছিল জবরদস্ত। সত্য মিথ্যা জানি না।

সরকার নাকি টিকেটের আঠা-পৃষ্ঠায় এমন ওষুধ দিয়ে রেখেছে যে, নারী কিংবা পুরুষ জিভ ঘষলেই পেটে গিয়ে পড়ে তাতে জন্ম নিয়ন্ত্রণ হয়। আজ বুঝি এটা নিতান্তই গুজব ছিল। আমরা চিঠি লিখতাম। চিঠি পেতাম। চিঠি লেখার জন্য শেখানো হতো আমাদেরকে।

স্কুলে এবং বাসায়। পরীায় খাতায় চিঠি লেখার প্রশ্ন আসতো। প্রথমে ভাঁজ করা দিয়ে শুরু। তারপর উপরের ডান কোণে তারিখ লিখে, তারও উপরে লিখতাম ‘এলাহী ভরসা’ কিংবা ‘বিসমিল্লাহ’। আরবীতে ‘বিসমিল্লাহ’ লেখা জানলে তো কথাই নেই।

আরবী তিনটা অংক দিয়েও ‘বিসমিল্লাহ’ লেখা যেতো-৭৮৬। গুরুজনদের কাছে সেই চিঠি লেখা শুরু হতো কত না আদব তমীজের সাথে। তেমনি করেই শেষ করা হতো। ‘হাজার হাজার সালাম বাদ আরজ করি....’ কিংবা ‘তসলিম নিবেন...’, কিংবা ‘আব্বাজান, প্রথমে আমার শতকোটি সালাম নিবেন, পর সমাচার এই যে,.....’। ‘এই পর সমাচারের পরেই শুরু হতো পিতা-পুত্রের কাহিনী।

পুত্র তার বিদেশে থাকে। পিতার অনেক কষ্টের টাকায় তার হোস্টেল খরচ চলে। তবে যা পাওয়া যায়, তাতে হয় না। পুত্র তাই টিউশনি করে। টানাটানির সংসার।

তবু এক মধুর সম্পর্ক বহমান ধারায় ‘চিঠি’ ও উত্তর- চিঠিতে বয়ে চলে। আগামী সুন্দর দিনের প্রত্যাশায় সকলেই কষ্ট ভোগ করে মধুর অন্তরঙ্গতায়। একেকটি পরিবারের অটুট বন্ধনের এক তাজমহল যেন এক একটি চিঠি। কত বেদনা, কত সুখ, কত চোখের জল, আনন্দের ধারা বয়ে যেত সেই সব চিঠিতে। চিঠি যেন নদী।

বাঙলার অপরূপ নদীগুলোর মতোই শুদ্ধ নদী। নিখাদ স্বর্ণ খণ্ড যেন এক একটি অর। বাড়ীতে আসার আকুল আকুতি ছিল মায়ের। মা তো লিখতেন না ব্যস্ততায় কিংবা লিখতে পারতেন না। তাই পিতাকে দিয়েই লিখিয়েছেন তাঁর প্রাণের পুত্রকে-‘শুনিলে বাবা খুশি হইবে, আমাদের কালা গাইটির এবারেও একটি বকনা বাছুর হইয়াছে।

বেশ গাঢ় দুধ হইয়াছে। তোমার মা বলিতেছেন বাড়িতে আসিয়া সেই দুধের ফিরনী যেন খাইয়া যাও। কবে আসিবা বাবা...। ’ সামনে পরী। পিতার ইচ্ছা এ সময় পুত্র না আসুক।

তবুও মায়ের আবদার মাতৃশ্রদ্ধার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে পিতা তেমনি লিখেছেন, যেমনটি মা চেয়েছেন। পুত্রটির আকুল মনে বাড়ী ফেরার তাড়না। তার হোস্টেল ঘরের চৌকির নিচে টিনের ট্রাংকে জং ধরেছে। সেখানে লাল সালু কাপড়েরর লেপখানা জংয়ে আটকে গেছে। শীত পড়েছে বলে ট্রাংক থেকে লেপ বের করে ওঁদা গন্ধ দুর করতে ছাদে কড়া রৌদ্রে দিয়ে নামিয়ে এনে আজ প্রথম গায়ে দিয়েছে।

কিন্তু ঘুম তার আসে না। কালা গাইটি তার কত প্রিয়। গাইটি গলা বাড়িয়ে দিত চুলকানোর জন্য। সে চুলকিয়ে দিলে চোখ মুদে থাকতো কৃতজ্ঞতায়। নানা বাড়ীতে গেলে চিঠি পড়ে দেয়ার হিড়িক পড়তো আমার।

কত কি দুঃখের ও আনন্দের চিঠি। পড়ে দেয়ার জন্য ফিস হিসেবে পেতাম- ভাঁপা পিঠা, মেরা পিঠা। লিখেও দিতে হতো। পিড়ায় বসে হাঁটুতে দু’হাত মুড়ে মা বলে চলেছেন, যেন সরাসরি সে কথাগুলোই পুত্রের কানে গিয়ে ঠেকছে, বিরতী দিয়ে দিয়ে কথা বলছেন, হাঁসছেন আবার কাঁদছেন। চিঠি চলে গেছে।

আর ফিরে আসবে না। আজ কেবল ভণিতা করতে আসে অফিসিয়াল চিঠি, মিটিংয়ের চিঠি, দাওয়াতের চিঠি। এসব কী চিঠি? চিঠির সাজানো সংসার যখন বানের জলে ভেসে গেল তথন আর ‘রিলিফ’ দেয়া কেন? এসবও নিয়ে গেলে ভালো হয়। আমাদের হৃদয় তো বয়ে চলেছে আজও প্রেমের চিঠির ভার। গোপন কথার শালীন ফুলঝুড়ি, তাতে আবার বইয়ের পাতায় জব্দ করে শুকিয়ে রাখা গোলাপ, পাপড়ী।

শুনেছি আমার খালা নতুন বিয়ের পর খালুকে চিঠি লিখেছেন, সেই চিঠিতে আতর মাখানো। আরো শুনেছি রাংতা- আব ছড়ানো চিঠির কথা। অপর প্রান্তে চিঠি গিয়ে পৌঁছতো সুন্দর কথার মনোহরী ডালা নিয়ে, সঙ্গে সুগন্ধির শিশি। নতুন কনেকে কিনে দেয়া হয়েছে চিঠি লেখার বই। কনে সেই বই দেখে দেখে কোটেশন দিত।

গোপন সুযোগ পেলেই বালিশে উপুড় হয়ে ভাবতো ‘কী লেখা যায়, যা বইতে লেখা নাই, অথচ তার মনের কথা। ’ হাহাকার করে ওঠে মন যখন মনে পড়ে সেই চিঠিটির কথা। প্রেমিকা তার দূর বিভুঁইয়ের প্রেমিকের কাছে লিখেছিল, চোখের পানিতে ঝর্ণা কলমের কালিতে। পানি টপ টপ করে কালির উপর পড়ে চিঠিকে বানিয়ে দিয়েছিল বিষনআকাশ। আমাদের রয়েছে রক্ত দিয়ে লেখা চিঠির ইতিহাস।

মুক্তিযোদ্ধা পুত্রটি তার মায়ের কাছে লিখেছিল শেষবার। মা আজও সেই চিঠি আগলে রেখেছেন। চিঠিতে রক্তের দাগ, তারপাশে বাঙ্কারের কাঁদা মাখা। রক্তের শপথে, রক্তের বন্ধনে, রক্তের টানে, রক্তাক্ত হৃদয়ে আমাদের ইতিহাসের কত না চিঠি হৃদয়ের আর্কাইভে জমা। তাই তো আমরা লিখি অমর গান ‘...আঙ্গুলও কাটিয়া, কলমও বানাইয়া লিখিলাম প্রাণ বন্ধুর কাছে....।

’ সেই চিঠি যদি না-ইবা থাকলো, তাহলে কেন আর সেই গান বাজবে? তাই বাজে না সেই গানও। আর বাজেও যদি, বোঝে না আর কেউ। ছেঁড়া জিন্সে ফ্যাশান করেছে যে যুবক, এই গান শুনলে সে হাসে। বলে, বন্ধ করো যতোসব ‘তে’। হ্যাঁ, সেই ‘েেত’র কথাই তো বলছি।

ইন্টারনেটের যুগ এখন, এসএমএসের যুগ। ফেইসবুকে বসে সারারাত কি যেন চালাচালি। চিঠির বদলে আজ আমরা পেয়েছি ‘চ্যাট’। যেন নাকের বদলে নুরুন। নিমদাড়ী যুবকের রাতভর চ্যাট আর দুপুর অবধি ঘুম।

মানি বন্ধুরা, আজ যুগের প্রয়োজনে এসব এসে হাজির হয়েছে আমাদের দোড়গোড়ায়। প্রয়োজন আছে বলেই আমরা এদেরকে গ্রহণ করেছি শুভাশিষ জানিয়ে। কিন্তু মুখের প্রলেপ যতোই চকচকে হোক না কেন চোখের নিচে যদি কালি পড়ে যায় আর চোখ ওল্টালেই যদি ধরা পড়ে রক্ত শুন্যতা, তাহলে কি আমি তোমাদের বিগত দিনের ভালো কিছুর দিকে আহবান করবো না? চিঠি লিখার দিনগুলি কি এই চ্যটের সঙ্গে বিকিকিনি হয়? বিনিময় হয়! আমার দিকে সহস্র তীর তাক করে থাকলেও আমাকে দিয়ে কেউ একথা বলাতে পারবে না যে চিঠি আর চ্যাট এক কথা হলো। চিঠি পাবার তাড়নায় আমাদের কত নির্ঘুম রাত গেছে। খয়েরি পোষাকের পিয়ন দেখলেই বুকের ভিতরটা আমাদের কেমন করে উঠতো।

এই তো এলো বুঝি তার চিঠি। আর চিঠি পেয়ে গেলে, হাতে পেলে সেই এয়ারমেইলের ইনভেলাপ, যাতে আছে চারকিনারে বিশেষ কোণাকুণি ছেড়ে ছেড়ে চিকন ফিতার মত ছাপ। আর সেখানে প্রিয়জনের হাতের লেখায় আমার ঠিকানা যখন জ্বলজ্বল করতো তখন চিঠিটা সযতনে নিয়ে কত না আয়েশ করে দরজায় খিল লাগিয়ে শুয়ে শুয়ে পড়া হতো। বারবার পড়তাম। সযতনে রেখে দিতাম আবার পড়ার জন্য।

তা কি তোমার ‘চ্যাট’ এ আছে বন্ধু! তাই তো বলি, নাও না কবুল করে আমার নিমন্ত্রণ। সেখানে যাই যে দেশে আজও চিঠি লেখা হয়। আবারও পেতে চাই প্রিয় বন্ধুর চিঠি, আব্বা, আম্মা ভাই-বোনের চিঠি। শিষ্টাচার-আদব-শ্রদ্ধা-ভরসা-ভালোবাসায় মাখামাখি হয়ে সেই সব চিঠি আবারো গড়ে দিবে আমাদের হারানো পরিবারের সীমানাকে, অটুট বন্ধনকে। তাই চলো না শালিক দেখতে বের হই।

ধুর ছাই! শালিক এখন কোথায় পাবো? ধ্বংসস্তুপের মতো ফেলে রাখা নির্মাণ সামগ্রীর এ শহরে এখন চটি শালিক নেই আর। তবে চলো একটু শহর থেকে দূরে বেরিয়ে যাই শালিক খুঁজতে। তিন শালিক। তিন শালিক দেখলে নাকি চিঠি আসে...।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.