‘যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে/সহস্র শৈবাল দাম বাঁধে আসি তারে। ’ এই নীতি কবিতার নির্গলিতার্থ দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশের কপালে সত্য হয়ে ফুটে উঠেছে। সে জন্য আজ স্বাধীনতার ৪০ বছর পর, সাত সাগর পাড়ি দিয়ে যে দেশের মানুষ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়, যে দেশের নেতা-নেত্রীদের চিত্কার-চেঁচামেচি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ, যে দেশের সরকারগুলোর দেশপ্রেমের ওপর ডগমগ বক্তৃতা শুনতে শুনতে সাধারণ মানুষের কান ঝালাপালা, সেই দেশের সরকারের সমুদ্রচিন্তা এখনও সৈকতেই পড়ে আছে। আর এই সুযোগে প্রতিবেশী দুই নেপোয় মজাছে দই মারছে। ভাতের হাঁড়ি দেখভাল করার যাদের দায়িত্ব ছিল তাদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও অযোগ্যতার সুযোগে এখন সারমেয়কুল তাতে মুখ দেয়ার সাহস পেয়েছে।
তারস্বরে গলা ফাটিয়ে বিশ্বসভায় বলছে, ও সমুদ্র আমাদের। বাংলাদেশের তাতে তেমন হক নেই। যেটুকু আমরা তাদের দেব সেটাই যথেষ্ট। এভাবেই আজ আমাদের অরক্ষিত ও অনির্ণীত সমুদ্রসীমায় হামলে পড়েছে প্রতিবেশী দুই দেশ ভারত এবং মিয়ানমার।
‘গরিবের বউ নাকি সকলের ভাবী’—এই প্রাচীন প্রবাদের পথ ধরেই আজ বাংলাদেশের দক্ষিণের গর্ব ও গৌরব, আনন্দ ও বেদনার মহাকাব্য, বহির্বিশ্বে পা দেয়ার একমাত্র খোলা পথ বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশের সীমার মধ্যে ঢুকে গায়ের জোরে ভারত বীরদর্পে গভীর মনোযোগ দিয়ে গ্যাস অনুসন্ধান করছে।
এর আগে তারা বাংলাদেশকে বেশ কয়েকবার বুড়ো আঙুল দেখিয়ে গিলে খেয়েছিল দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ। ভারতের এই আগ্রাসন মোকাবিলায় বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের ‘পোষা বিড়ালে’র ভূমিকা দেখে মিয়ানমার হাত গুটিয়ে থাকবে কেন? তারাও রণতরী নিয়ে দামামা বাজিয়ে বাংলাদেশের পানিসীমার মধ্যে জাহির করেছে নিজেদের বাহাদুরি। সবমিলিয়ে বলা যায় আমাদের সমুদ্র আজ সম্পূর্ণ অরক্ষিত। আর এই সমুদ্র ভারত ও মিয়ানমার যদি সত্যিসত্যি শেষ পর্যন্ত গিলে খেতে পারে তাহলে তার ভয়ানক ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে আমাদের অর্থনীতি, ভূগোল, পরিবেশ, নিরাপত্তা ও মানবিকতার ওপর। সবচেয়ে বেশি যেটা সেটা হলো আমাদের ন্যায্য অধিকার থেকে আমরা বঞ্চিত হব।
আর দেশ নিক্ষিপ্ত হবে অবাঞ্ছিত অস্তিত্ব সঙ্কটে। ভারত ও মিয়ানমারের এই দখল প্রক্রিয়ার আজও মীমাংসা না হওয়ায় সঙ্গত কারণেই দেশের সচেতন মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে উদ্বেগ ও উত্কণ্ঠা। এ উত্কণ্ঠা থেকেই আজ দেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষক, খনিজ এবং আন্তর্জাতিক সমুদ্র ও নদী বিশেষজ্ঞরা সমুদ্রসীমা রক্ষায় অতিদ্রুত আন্তর্জাতিক আদালত ও জাতিসংঘে অভিযোগ উত্থাপনের জন্য সরকারের কাছে দাবি তুলেছেন।
সমুদ্র নিয়ে আমাদের প্রধান সমস্যা হলো সরকারগুলোর উদ্যোগের অভাব। সীমাহীন উপেক্ষা ও উদাসীনতা।
গৃহীত পরিকল্পনায় ধারাবাহিকতার অভাব। সরাসরি এ সংক্রান্ত কোনো মন্ত্রণালয় না থাকার ফলে অন্যরা সমস্যা সমাধানে অতটা আন্তরিক ছিল না। সেজন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিষয়টি সময়মত নিয়ে যায়নি কেউ। এই ভুলের ছিদ্রপথে মিয়ানমার ও ভারত এখন চেপে ধরেছে বাংলাদেশের কণ্ঠনালী, সমুদ্রকে। তারা জোর করে কেড়ে নিতে চাচ্ছে বাংলাদেশের ৪৫ হাজার মাইল সমুদ্রসীমা।
এখন ভারত বা মিয়ানমারের অনুমতি ছাড়া সমুদ্রেও জাহাজ ভাসাতে পারবে না বাংলাদেশ।
আমরা প্রত্যাশা করব সময়ের আহ্বানে আমাদের সরকার সাড়া দেবে। বাংলাদেশের দাবি ও পাওনা শতভাগ ন্যায্য। আমাদের বিশেষজ্ঞদের তথ্য, উপাত্ত ও গবেষণাপত্র ভারত ও মিয়ানমারের চেয়ে প্রয়োজনের চাইতেও শক্তিশালী। সরকারি দল ও বিরোধী দলগুলো যদি এই ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে, তাহলে যথার্থ গবেষণাপত্রের পাশাপাশি গড়ে উঠবে বিপুল জনমত, যা আমাদের পাওনা পেতে সাহায্য করবে।
কিন্তু সবকিছু নির্ভর করছে আমাদের সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। তারা কোন্ শ্রেণীর আইনজ্ঞ বা বিশেষজ্ঞ পাঠাবে, তারা আন্তর্জাতিক আদালতে কীভাবে লড়বে—সেটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কারণ বাংলাদেশ হলো ঘরপোড়া গরু। সে তো লাল রঙের মেঘ দেখলেই ভয় পায়। আধিপত্যবাদের কাছে আত্মবন্ধক দেয়া বর্ণচোরা রাজনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা এই প্রিয় মানচিত্রের সঙ্গে বেশিরভাগ সময়ই প্রতারণা করেছে।
সেজন্য সমুদ্র বিষয়েও আমাদের দুশ্চিন্তা আছে। জাতিকে দুশ্চিন্তামুক্ত রাখার জন্য সরকার যদি সবকিছু স্বচ্ছতার মধ্য দিয়ে করে, যথার্থ দেশপ্রেমিক বিশেষজ্ঞদের যদি আন্তর্জাতিক আদালতে প্রেরণ করে তাহলে আমাদের বিজয় অনিবার্য। আমরা আশা করব, আর দেরি না করে সরকার প্রয়োজনীয় কাজটি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে সম্পাদন করবে। নইলে সর্বনাশ ঠেকানো যাবে না।
দৈনিক পত্রিকা থেকে
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।