স্বপ্নের হাতিরঝিলের মূল পরিকল্পনার সঙ্গে বাস্তবতার আর মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আজও পার্ক, মুক্তমঞ্চ নির্মাণসহ বিনোদনের অন্যান্য উপকরণের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি। কথা ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসীদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরে নিয়মিত অনুষ্ঠানের আয়োজন হবে হাতিরঝিলে। ঝিলে গড়ে তোলা মুক্তমঞ্চে আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী নৃত্য, গান পরিবেশনসহ তাদের উৎপাদিত পোশাক, খেলনা ও অন্যান্য সামগ্রী কেনাবেচার ব্যবস্থা থাকবে বলেও সিদ্ধান্ত ছিল। পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশি-বিদেশি পর্যটকদের হাতিরঝিলে প্রবেশের ক্ষেত্রে টিকিট ব্যবস্থা চালুসহ আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার কথা।
ভেতরে আলাদা আলাদা ফুডকোট গড়ে তোলার উদ্যোগ ছিল। এসব ফুডকোটে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিখ্যাত খাবার থাকবে বলেও জানানো হয়েছিল। নিরাপত্তাসহ সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য হাতিরঝিলে সেনাবাহিনীর একটি ইউনিট থাকারও কথা। হোটেল রেডিসন ইন্টারন্যাশনাল, বান্দরবানের নীলগিরি পর্যটন স্পটসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যেভাবে সেনা সদস্যরা পরিচালনা করেন, তেমনভাবেই হাতিরঝিলের ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু সেসব পরিকল্পনার কোনোটিই বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
এমনকি মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী এখন পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ নির্মাণকাজও শেষ করা যায়নি বলে জানা গেছে। যানজটে স্থবির রাজধানীর জন্য এসব ছিল কল্পনাহীন, কিন্তু সরকারের বেগুনবাড়ী খালসহ হাতিরঝিল সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে সেই অসম্ভবকে বাস্তব রূপ দেওয়া গেছে। তবে এখনো রামপুরা ব্রিজসংলগ্ন প্রগতি সরণিতে দুটি ইউ লুপ ও গুলশান অংশে একটি ভায়োডাক্ট নির্মাণ সম্পন্ন হয়নি। পরিকল্পনা অনুযায়ী, রাস্তার পাশে লাগানো হয়নি সারি সারি গাছ। গড়ে তোলা হয়নি সবুজের আচ্ছাদন, অস্তিত্ব নেই ফুলবাগানের।
কিছু খেজুর আর তাল গাছের চারা রোপণ করেই দায়িত্ব শেষ করেছে রাজউক। আধমরা এসব গাছ সবুজ হয়ে উঠতে আরও অন্তত দুটি বর্ষা মৌসুম অপেক্ষা করতে হচ্ছে। ধারাবাহিক অযত্ন-অবহেলায় এরই মধ্যে হাতিরঝিলের পরিবেশ নোংরা হয়ে পড়েছে। ময়লা-আবর্জনায় দূষিত হয়ে পড়েছে ঝিলের পানি, মাঝেমধ্যে দম বন্ধ করা তীব্র দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টটি সচল থাকলেও অনেক ময়লা-আবর্জনা ঢুকছে প্লান্টের ভেতর দিয়েই।
বর্জ্যযুক্ত পানি নিষ্কাশনের জন্য ১২টি স্পেশাল স্যুয়ারেজ ডাইভারশন স্ট্রাকচার (এসএসডিএস) নির্মিত হলেও তা ঠিকভাবে কাজ করছে না। হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ী বর্জ্যযুক্ত খালের পানির রং কালো থেকে দৃষ্টিসহনীয় পর্যায়ে আনতে ও দুর্গন্ধমুক্ত করতে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে মাঝেমধ্যেই ফিটকিরি ও বি্লচিং পাউডার ছিটানো হতো। এতে ফল পাওয়া গেলেও ঝিল মাছ চাষের উপযোগী করা সম্ভব হচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা জানান, ঝিলের পানি মাছ চাষের উপযোগী করতে হলে অন্তত দুই বছর অপেক্ষা করতে হবে। এ সময়ের মধ্যে নতুন করে আর বি্লচিং পাউডার বা ফিটকিরি ব্যবহার করা যাবে না।
মাছ চাষের পরিকল্পনা থাকায় দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে পানি দুর্গন্ধমুক্তির কর্মকাণ্ড পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে।
রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তা : সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্ট ইউনিট অতি সম্প্রতি হাতিরঝিলের রক্ষণাবেক্ষণে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ প্রদানের সুপারিশসংবলিত একটি ফাইল রাজউকের কাছে পাঠায় বলে জানা গেছে। কিন্তু রাজউক এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় হাতিরঝিল নিয়ে সেনাবাহিনীর পরিকল্পিত তৎপরতা রীতিমতো থমকে দাঁড়িয়েছে। রাজউকের নগর স্থপতি ইকবাল হাবিব জানান, হাতিরঝিলের রক্ষণাবেক্ষণ খরচ সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হবে, নাকি নিজস্ব আয়ে মেটানো হবে সে বিষয়ে একটি সুপারিশ সেনা প্রস্তাবে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু এখনো তা ফাইলবন্দী হয়ে পড়ে আছে।
ইকবাল হাবিব বলেন, 'হাতিরঝিলের নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি), রাজউক কিংবা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি) রাজি নয়। এ খাতে আলাদা কোনো আর্থিক বরাদ্দ না থাকায় হাতিরঝিল রক্ষণাবেক্ষণ কাজে কোনো সংস্থার আদৌ আগ্রহ নেই। অযত্ন, অবহেলায় শ্রীহীন হাতিরঝিল দিন দিনই অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ গড়ে না ওঠা, রক্ষণাবেক্ষণে অর্থের জোগান না থাকা, মাত্রাতিরিক্ত বখাটেপনা, মাদকসহ অসামাজিক কার্যকলাপের দৌরাত্দ্য, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারির অভাবসহ নানা কারণে হাতিরঝিল এলাকাটি এখন পর্যটকদের যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যথেচ্ছ চলছে প্রাইভেট, মাইক্রো, মোটরসাইকেল থেকে শুরু করে রিকশা, ভ্যান, ঠেলাগাড়ি পর্যন্ত।
বেশির ভাগ গাড়িকে লেন, সিগন্যাল লাইট, ট্রাফিক আইন ভঙ্গের মারাত্দক প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। সকাল-বিকাল এমনকি মধ্যরাতেও হাতিরঝিলের ব্যস্ততম সড়কগুলোয় বিপজ্জনক কার রেসিং চলে। বিকট শব্দে বেপরোয়া রেসিং কারের এদিক-সেদিক ছোটাছুটিতে পায়ে হেঁটে ঘোরাফেরাকারী নারী-শিশুসহ ভ্রমণপিয়াসীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। ইদানীং কার রেসিংকে ছাড়িয়ে গেছে মোটরসাইকেল রেসিং। এসব রেসিংয়ের ঘটনায় প্রায় প্রতিদিনই দুর্ঘটনা ঘটছে, আহত হচ্ছে সাধারণ পথচারী।
সেখানে সেনা সদস্যদের উপস্থিতি থাকার সময় এসব মোটরসাইকেল ও কার রেসিংয়ে অংশগ্রহণকারীদের আটকপূর্বক প্রকাশ্যে লজ্জাজনক নানা শাস্তি দেওয়া হতো। এখন সে ব্যবস্থা বহাল না থাকায় বখাটেদের দৌরাত্দ্য বেড়ে গেছে। হাতিরঝিল লেকের দুই পাশে পাকা রাস্তা, তার পাশে ফুটপাত। লেকের ঢাল কমপক্ষে ১০-১৫ ফুট নিচু। ল্যাম্পপোস্টের আলো লেক ঢালের যেসব স্থানে পেঁৗছে না, সেসব স্থানেই আখড়া গেড়েছে মাদকসেবীরা।
ব্রিজগুলোর নিচ থেকে উঠে আসা গাঁজার উৎকট গন্ধে নাক চেপে ধরতে বাধ্য হন পথচারীরা। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ঝিলের সংযোগ সেতুর আশপাশেই তাদের তৎপরতা থাকে বেশি। রাতে আলোস্বল্পতার সুযোগে সেখানে আপত্তিকর নানা দৃশ্যপটের কারণে সপরিবারে বেড়াতে এসে বিব্রত হচ্ছেন অনেকেই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।