আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সরিষার ভেতরেই ভুত: বিবেকের মুখে তালা



সকাল বেলা। শাহবাগ মোড়। মানুষের আনাগোনা ক্রমেই বাড়তে শুরু করেছে, বাড়ছে যানযটের জটলাও। ১১ বছরের সুমন ব্যাস্ত রাস্তার একপাশে দাড়িয়ে অপেক্ষা করছে সিগন্যাল পড়ার। আটপৌরে বস্ত্র পড়ে শুধু সুমন নয়, সুমনের মতো আরো বেশ কয়েকজন ছেলে বিচ্ছিন্নভাবে সিগন্যাল পড়ার অপেক্ষায় আছে।

ওদের প্রত্যেকের হাতে ২০-৩০ টি সকাল বেলার ঝকঝকে নতুন পত্রিকা। সিগন্যাল পড়ার সাথে সাথে থেমে থাকা গাড়িগুলোর ভিড়ে হারিয়ে যায় ছেলেগুলো। বাইরে থেকে আওয়াজ পাওয়া যায়, “পেপার লন পেপার, মাত্র দুই টাকা...। ” প্রতিদিন ঢাকা শহরের প্রায় প্রতিটি ব্যাস্ত রাস্তার মোড়ে দেখা যায় এ একই দৃশ্য। দুই টাকা দিয়ে কেনা এসব পত্রিকায় জাতীয় খবর থেকে শুরু করে চটকদার বিভিন্ন খবরে পুর্ণ থাকে।

এরকম প্রচলিত আছে যে, শুধু বাংলাদেশ নয় বরং সারা পৃথিবীর আজব আজব খবর পাওয়া যায় সেখানে। আর এসব পত্রিকা কিনতে গেলে আরেকটি আজব বিষয় চোখে পড়ে, তা হলো কম দামী এসব পত্রিকার প্রায় ৯৮% হকারই শিশু! শিশু শ্রম বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে কোন আজব ঘটনা নয়, প্রতিনিয়ত ঘটছে এ ঘটনা। শিশু শ্রম বন্ধে বিভিন্ন মিডিয়ার মতো প্রিন্ট মিডিয়াকেও যথেষ্ঠ তৎপর দেখা যায়। বিবেককে জাগ্রত করার অগ্রপথিক বলে বিবেচনা করা হয় পত্রিকাকে। কিন্তু যখন প্রিন্ট মিডিয়া বা পত্রিকাওয়ালারা বিবেককে বর্জন করে নিজেদের বিপননের স্বার্থে শিশুদের ব্যবহার করে তখন তা আজব ঘটনাই বটে! বলা হয়ে থাকে, আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যত।

সুন্দর কল্যাণকর জাতি গঠনের জন্য প্রয়োজন এমন সুন্দর পরিবেশ যেখানে জাতির ভবিষ্যত স্থপতিগণ সকল সম্ভাবনাসহ সুস্থ, স্বাভাবিক ও স্বাধীন মর্যাদা নিয়ে শারীরিক, মানসিক, নৈতিক, আধ্যাতিœক এবং সামাজিকভাবে পূর্ণ বিকাশ লাভ করতে পারবে। জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে ১৮ বছরের কম বয়সী যেকোন মানব সন্তানকেই শিশু বলা হয়েছে । বাংলাদেশের জাতীয় শিশু নীতিতে ১৪ বছরের নীচে যে কোন বালক-বালিকাকে শিশু বলা হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে প্রচলিত সাবালকত্ব আইনে স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে যে, সাবালকত্বের বয়স শুরু হবে ১৮ বছর থেকে । এই সংজ্ঞা দুটির মধ্যে সমন্বয় সাধন করে বাংলাদেশ, জাতিসংঘে প্রদত্ত প্রতিবেদন এবং অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে ''শিশু এবং অল্পবয়সী'' শব্দটি ব্যবহার করছে ।

বাংলাদেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বয়স সর্ম্পকিত কোন গ্রহণযোগ্য লিপিবদ্ধকরণ ব্যবস্থা প্রচলিত নেই। যদিও কাগজে কলমে মিউনিসিপ্যালিটি এবং ইউনিয়ন পরিষদের উপর জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধীকরণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা কোন ভুমিকা রাখতে পারছে না- বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারগুলোর ক্ষেত্রে। দেশের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে শিশুদের জন্য সুষ্ঠু কার্যক্রম গ্রহণ অপরিহার্য ৷ প্রত্যেক শিশুকে দেশের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্ঠায় সকলের অংশগ্রহণ একান্ত বাঞ্জনীয়। তবে শিশু শ্রম পুরো বিষয়টিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। শিশু শ্রমের বিষয়টি নতুন কোন ঘটনা নয়।

আদি কাল থেকেই পারিবারিক পরিমন্ডলে হালকা-পাতলা শিশু শ্রমের ব্যাপারগুলো লক্ষ করা যেত বা এখনো যায়, কিন্তু মজুরির বিনিময়ে শিশুদের শ্রমে নিয়োগ শিল্পায়ন ও আধুনিকীকরণের ফসল। বিশ্বের প্রতি ছয়জন শিশুর একজন আজ শিশুশ্রমে জড়িত, যা তাদের ভাবাবেগ বিকাশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। নব্বই দশকে মার্কিন সিনেটর টম হারকিন আনীত একটি বিল শিশুশ্রম আন্দোলনের সূচনাকে ত্বরান্বিত করে। বাংলাদেশের বিভিন্ন আইন, অধ্যাদেশ, বিধিমালা ও বিভিন্ন নীতিমালা বিশেষ করে জাতীয় শিশু নীতিমালা-১৯৯৪ ও শিশুশ্রম নীতিমালা (খসড়া)-২০০১ এ শিশুশ্রমকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। সম্প্রতি আইএলও'র সহযোগিতায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দেশব্যাপী জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ পরিচালনা করেছে।

জরিপের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী দেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা ৪ কোটি ২৪ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার ৩২ শতাংশ। তাদের মধ্যে প্রায় ৩২ লাখ শিশু শ্রমিকের আওতাভুক্ত। দেশের নগর এলাকায় সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ জায়গা হলো রাজধানী শহর ঢাকা। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, নগর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়েই ঢাকা মহানগরী আজ বিকশিত এবং পাশাপাশি বিপর্যস্থ। দেশের শহরাঞ্চলে প্রায় ৩০০ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ অর্থনৈতিক কাজে শিশুরা শ্রম দিচ্ছে।

আইএলও রিপোর্ট অনুযায়ী কেবল ঢাকা শহরেই মোট ১২ হাজার শিশু অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিযুক্ত রয়েছে । হকার হিসেবে রাস্তায় ঝুকিপূর্ণভাবে পত্রিকা বিক্রি করছে কতো জন তার সুনির্দিষ্ট হিসাব না থাকলেও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর এক প্রতিনিধির মতে শুধু ঢাকাতেই তা এক হাজারের কম হবে না। ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম থেকে শিশুদের রক্ষা করতে আইএলও ১৯৯৯ সালে প্রণয়ন করে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম কনভেনশন নং ১৮২, যেখানে ১৯০টি সুপারিশ করা হয়েছে। ২০০১ সালে আইএলও কনভেনশনে সাক্ষর করা বাংলাদেশ এ দেশের প্রেক্ষিতে সেই সুপারিশকে গ্রহণ করে ১১ টি কাজকে শিশুর জন্য ঝুঁিকপূর্ণ বলে চিহ্নিত করেছে। শিশুদের দিয়ে রাস্তায় রাস্তায় পত্রিকা বিক্রি করানো সেই সব ঝুঁিকপূর্ণ কাজের তালিকায় অনুপস্থিত।

তবে সার্বিক দিক বিবেচনা করলে তা জাতিসংঘ শিশু সনদের ৩, ৫ ও ৬ নাম্বার অনুচ্ছেদের সরাসরি লঙ্ঘন। জাতীয় শ্রম আইনের বিরুদ্ধও এটি। বিষয়টি সাম্প্রতিক সময়ে সামনে এসেছে, এটি একটি কারণ হতে পারে অথবা এর অন্য কারণ হতে পারে রাস্তায় শিশু হকারের কাজকে ঝুঁিকপূর্ণ মনে না করা। পত্রিকার পাতায় শিশু হকারদের ঝুঁকির বিষয়টি না এলেও মাঝে মাঝে এ ঝুঁিকর ফলগুলো এসেছে প্রচ্ছন্নভাবে। রাজধানীর মগবাজারে পত্রিকা বিক্রি করতে গিয়ে আজমেরী পরিবহনের একটি বাসের চাপায় গত ২ সেপ্টেম্বর নিহত হয় ১১ বছরের শিশু হকার ইমন সরদার।

১৪ অক্টোবর ২০১০ রাজধানীর বাড্ডা লিংক রোডের নতুনবাজার এলাকায় সকালে বাসচাপায় হৃদয় নামে ১৩ বছরের এক পত্রিকা হকার নিহত হয়। পেটের দায়ে রাস্তায় নামা এরকম আরো বেশ কয়েকটি ইমন বা হৃদয়ের উদাহরণ সামনে নিয়ে আসা যাবে। তবে অনেকে শিশুদের হকার হিসেবে ব্যবহার করার একটি ভাল দিক চিহ্নিত করেছেন। তাদের মতে এতে কিছু শিশুর কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়। এ বিষয়টিকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।

ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য, পরিবেশগত অবনতি ও শিশুর ভালোভাবে বেঁচে থাকা, উন্নতি ও উৎপাদনশীলতা অর্জনে অন্যদের প্রতি দায়িত্বহীনতা থেকেই শিশুশ্রমের পরিমাণ বাড়ছে। সবচেয়ে শক্তিশালী যে কারণটির জন্য শিশুরা বিপজ্জনক ও কষ্টসাধ্য শ্রম দিতে বাধ্য হচ্ছে তা হলো- দারিদ্র্যের শোষণ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে দুই টাকা দামের পত্রিকাগুলো বিক্রি করলে পত্রিকা পিছু কমবেশি আশি পয়সা করে লাভ হয়। সে হিসাবে দৈনিক ১০০ পত্রিকা বিক্রি করতে পারলে ৮০ টাকার মতো লাভ থাকে, মাসে প্রায় আড়াই হাজার টাকা। তাই বলে শিশুদের ঝুঁিকর বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া যায় না।

আবার শিশুদের অর্জিত এ টাকা তারা কোন খাতে ব্যায় করে তা-ও ভাবার বিষয়। যদিও কিছু ক্ষেত্রে পত্রিকা বিক্রির টাকা শিশুরা তাদের পরিবারের পেছনে ব্যায় করে, তবে গুলিস্তান ও সদরঘাটের শিশু হকারদের পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে তাদের কেউ কেউ নেশার দ্রব্য কেনার জন্য পত্রিকা বিক্রি করে। সারাদিন পত্রিকা বিক্রি করে রাতের বেলায় এরা বুদ হয়ে যায় নেশায়! এ চিত্র ঢাকার বেশিরভাগ হকারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। জ্ঞানের আলোর অভাব এদের প্রকোট। প্রতিনিয়ত এই সব শিশু হকাররা ভুল মানুষের সাথে ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে।

পত্রিকাওয়ালারা যদি শুধু তাদের বিপননের চিন্তা না করে অবসরে এইসব শিশুদের লেখা-পড়া করার কোন সুযোগ করে দিত তা হলে নিশ্চয়ই সাধুবাদ পেত। গত ২৯শে মে ২০১০ তারিখে দুই টাকা দামের এইসব পত্রিকার একটির সম্পাদকীয়তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক শিক্ষক তার কলামে শিশু শ্রম বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বিভিন্ন উপাত্ত আর বিশ্লেষণ দিয়ে দেখিয়েছেন যে শিশু শ্রম একটি জাতির জন্য কতটা ক্ষতিকর, তিনি এর আইনী দিকগুলোকেও সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। মজার ব্যাপার হলো তিনিও শিশু হকারদের শ্রমকে সচেতনভাবে এড়িয়ে গেছেন। কারণ সকালবেলাতেই শত শত শিশু হকার তার কথাকে বিলি করেছে জাতির বিবেককে জাগ্রত করতে।

শিশু হকার না থাকলে তা ভালভাবে কতোটুকু সম্ভব হতো? সত্যিই সরিষার ভেতর ভূত থাকলে তা নামানোর সাধ্য কারো নেই।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.