আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সরকারের মিথ্যাচারই দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করছে (শাহরিয়ার কবির)

বাংলা আমার দেশ

খালেদা-নিজামীদের চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক নির্যাতন ও মানবাধিকার লংঘনের যে সব ঘটনা ঘটেছে সে বিষয়ে এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বার্ষিক প্রতিবেদনে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ সরকার যথারীতি এর প্রতিবাদ করেছে। ৩১মে (২০০২) সংবাদপত্রে প্রকাশিত সরকারী প্রেসনোটে ক্ষোভ প্রকাশ করে সরকার মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকালে সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যাচাই করে দেখতে এ্যামনেস্টির প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। ‘নির্বাচনের পরে ব্যাপক সংখ্যালঘু নির্যাতন সম্পর্কে এ্যামনেস্টির অভিযোগকে প্রকৃত বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে অভিহিত করেছে সরকার। ... তথ্য বিবরণীতে এ্যামনেস্টির মন্তব্যকে ঢালাও এবং সাধারণীকরণ বলেও আখ্যা দেওয়া হয়।

‘এতে বলা হয়, বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে সরকার সব সময় এ্যামনেস্টির প্রতি খোলা দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের ২০০২ রিপোর্টে তা প্রতিফলিত হয়নি। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতি এবং সংখ্যালঘু বিষয়ে তাদের বক্তব্য আরো দুভার্গ্যজনক। নির্বাচন সম্পর্কিত এ্যামনেস্টির পর্যবেক্ষণের সমালোচনা করে তথ্য বিবরণীতে বলা হয়, দেশ-বিদেশের সকল পর্যবেক্ষক নির্বাচনকে স্বচ্ছ, অবাধ ও নিরপেক্ষ বলে অভিহিত করলেও এ্যামনেস্টি আওয়ামী লীগের একপেশে বক্তব্যই গ্রহন করেছে। সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়ে সরকারের বক্তব্য হলো ঃ নির্বাচনের পরপরই কয়েক জায়গায় বিচ্ছিন্ন সহিংসতার কথা সরকার কখনই অস্বীকার করেনি।

কিন্তু হিন্দুদের ওপর পরিকল্পিত ও ব্যাপক হামলার খবর সত্যের অপলাপ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সমাজ বিরোধী কর্মকাণ্ডের ঘটনার শিকার হয়েছে হিন্দু-মুসলিম সবাই। ‘সাংবাদিক-সাহিত্যিক শাহরিয়ার কবির প্রসঙ্গে উত্থাপিত এ্যামনেস্টির অভিযোগ খণ্ডন করে সরকার বলেছে, কলকাতায় গিয়ে তিনি বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের জন্য কাজ করেছেন। এ সংক্রান্ত প্রমাণও আছে। আর সরকার প্রচলিত আইনেই তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে এবং তাকে আÍপক্ষ সমর্থনের যথাযথ সুযোগ দিয়েছে।

‘হিন্দুদের ব্যাপকভাবে দেশত্যাগের অভিযোগ অস্বীকার করে তথ্য বিবরণীতে এর কোনো ভিত্তি নেই বলেও মন্তব্য করা হয়। এতে আশা প্রকাশ করা হয়, এ্যামনেস্টি এ সংক্রান্ত তাদের পর্যবেক্ষণ সংশোধন করে নেবে। ’ (ভোরের কাগজ, ৩১ মে ২০০২) বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রতি বছরই আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন মানবাধিকার সংগঠন এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সমগ্র বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এ্যামনেস্টি তথ্য সংগ্রহ করে। মানবাধিকার লংঘনের প্রতিবাদ জানাবার সময় এ্যামনেস্টি কখনও কোন দেশের প্রতি বা দলের প্রতি বিশেষভাবে বিদ্বেষ পোষণ করেছে এমন অভিযোগ কেউ কখনও করেনি।

বরং এ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে মানবাধিকার লংঘনের বহু ঘটনা উল্লেখিত হয় নাএমন মন্তব্যও অনেকে করে থাকেন। সরকারীভাবে মানবাধিকার লংঘনের তথ্য প্রদানের ক্ষেত্রে এ্যামনেস্টি শুধু সতর্ক নয়, যথেষ্ট রক্ষণশীলও বটে। পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ না করে তারা কিছু বলে না। এবারও যেসব দেশে মানবাধিকার লংঘনের ঘটনায় এ্যামনেস্টি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সেই তালিকায় বাংলাদেশ ছাড়াও পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, চীন, ইসরায়েল এমনকি যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশও আছে। ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখেছি বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোন দেশ এ্যামনেস্টির বার্ষিক প্রতিবেদনের প্রতিবাদ করেনি।

এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে জামাত-বিএনপি সরকার আওয়ামী লীগ সমর্থক মনে করে অথচ আওয়ামী লীগ আমলে সংঘটিত মানবাধিকার লংঘনের উল্লেখ তখনকার প্রতিবেদনে রয়েছে। মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ধনতন্ত্র, রাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র নির্বিশেষে বিভিন্ন দেশে ঘটতে পারে এবং ঘটে থাকে। মানুষের মর্যাদা ও অধিকার সম্পর্কে বিভিন্ন দেশে সরকার কতটা সচেতন এবং গণতন্ত্রের রীতিনীতি তারা কী পরিমাণ অনুসরণ করে তার উপর নির্ভর করে সেই সরকারের কিংবা দেশের ভাবমূর্তি। কোন দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করা কোন নাগরিকের পক্ষে সম্ভব নয়। সরকারের আচরণই বলে দেয় তারা কতটা সভ্য বা অসভ্য।

ক্ষমতায় আসার পর থেকে বাংলাদেশে খালেদা-নিজামীদের চার দলীয় জোট সরকার ক্রমাগত অভব্যতা, অসভ্যতা, মিথ্যাচার, সন্ত্রাস, নির্যাতন ও দায়বদ্ধহীনতার চরম নিদর্শন স্থাপন করে চলেছে। এভাবেই তারা বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। আমরা আগে জানতাম না, এবার ক্ষমতায় আসার পর জানলাম আমাদের প্রধানমন্ত্রী ছাগল ভালোবাসেন। সরকার সারা দেশে ছাগল উৎপাদনের মহা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন অতি শীঘ্র তিনি প্রধানমন্ত্রীকে দশ হাজার ছাগল উপহার দেবেন।

চারপাশে ছাগল দেখতে অভ্যস্ত প্রধানমন্ত্রী দেশের আমজনতাকে ছাগল ভাবতে পারেন, কিন্তু তার সরকার যদি এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনকে ছাগল ভাবে বুঝতে হবে বাংলাদেশের সর্বনাশের আর কিছু বাকি নেই। আধুনিক তথ্যপ্রবাহের এই ইন্টারনেটের যুগে বসে কেউ যদি তথ্য গোপনের চেষ্টা করে তাকে ছাগল বলা হলে এই নিরীহ প্রাণীটিকে অপমান করা হবে। ক্ষমতায় আসার পর থেকে সরকার ক্রমাগত বলছে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি, কোথাও বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটলেও তা মোটেই সাম্প্রদায়িক নয়, গতানুগতিক নির্বাচনোত্তর সহিংসতা, যা সব সময় ঘটে। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট, কংগ্রেসম্যান কিংবা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুপরিচিত কোন পত্রিকা যখন বাংলাদেশে তালেবান, আল কায়দা ও মৌলবাদের অবস্থান সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশ সরকার তারস্বরে চিৎকার শুরু করে দেয় বাংলাদেশে এসবের কোন অস্তিত্ব নেই, বাংলাদেশ মডারেট মুসলিম রাষ্ট্র! প্রধানমন্ত্রী হাঁটুর চিকিৎসা করাতে আমেরিকা গিয়েও কদিন আগে মন্তব্য করেছেন, বাংলাদেশ মৌলবাদী হলে তিনি মহিলা হওয়া সত্ত্বেও কীভাবে প্রধানমন্ত্রী হলেন! প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া নিশ্চয় মানবেন এবং আমরাও জানি বাংলাদেশের চেয়ে পাকিস্তান ঢের বেশি মৌলবাদী ও সন্ত্রাসী হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত। পাকিস্তানে শরিয়া আইন, হুদুদ আইন, ব্লাশফেমী আইন রয়েছে যা বাংলাদেশে এখনও চালু হয়নি, যদিও তা চারদলীয় জোটের মৌলবাদী দুই শরিকের প্রধান এজেণ্ডা।

পাকিস্তানের মতো মৌলবাদী দেশে বেনজির ভূট্টো যদি প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন বাংলাদেশে খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রী হতে বাধা কোথায়? চারদলীয় জোটের দুই শরিকের নেতারা বাংলাদেশকে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মতো মৌলবাদী তালেবানি রাষ্ট্র বানাবার কথা প্রকাশ্য জনসভায় ঘোষণা করেছেন এবং সেই লক্ষ্যে তারা কাজও করছেন। তারপরও যদি বলা হয় সরকারে মৌলবাদী নেই সেই প্রচেষ্টা সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায় ‘বন্ধাগমনের মতো নিস্ফল প্রয়াস’ ছাড়া আর কিছু নয়। সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের কারণে জীবন ও সম্ভ্রম বাঁচাবার জন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হাজার হাজার সদস্য ভিটেমাটি সহায় সম্পত্তির মায়া ত্যাগ করে দেশত্যাগ করে প্রতিবেশী ভারতে গিয়ে যে আশ্রয় নিয়েছে এ তথ্য আমার অথবা এ্যামনেস্টির আবিষ্কার নয়। আমি ভারতে যাওয়ার আগে ‘যুগান্তর’-এর মতো সরকার সমর্থক পত্রিকায় এ খবর বেরিয়েছে। ভারতে গিয়ে বাংলাদেশী শরণার্থীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে বিবিসি ধারাবাহিকভাবে সাম্প্রদায়িক নির্যাতন ও অভিপ্রয়ান সম্পর্কে বলেছে।

বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন টেলিভিশন নেটওয়ার্ক ও পত্রিকার মাধ্যমে সারা পৃথিবী জেনেছে নির্বাচনকেন্দ্রিক সাম্প্রদায়িক সহিংসাতার শিকার বাংলাদেশী শরণার্থীদের অভিপ্রয়ানের ঘটনা। আগে এসব ঘটনা সম্পর্কে এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বা অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা যত না জানতো আমাকে গ্রেফতারের পর দশগুণ বেশি জেনেছে। আমি কারাগারে বন্দি থাকাকালে এ্যামনেস্টির মহাসচিব বাংলাদেশে এসে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে সাম্প্রদায়িক নির্যাতন ও আমার গ্রেফতার সম্পর্কে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী যথারীতি অস্বীকার করেছেন। ক্রমাগত মিথ্যাচার, সন্ত্রাস ও নির্যাতন বন্ধ না করে তা অস্বীকার কিংবা যৌক্তিক প্রমাণের চেষ্টা হিটলার মুসোলিনির নাৎসিবাদ ও ফ্যাসিবাদের লক্ষণ।

জামাতে ইসলামীর আদর্শিক গুরু মওলানা মওদুদী চল্লিশের দশকে এই দলের প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই গণতন্ত্রকে ‘কুফরি মতবাদ’ বলে হিটলার ও মুসোলিনির নাৎসিবাদ ও ফ্যাসিবাদকে আদর্শ দর্শন হিসেবে প্রচার করেছেন। জামাতের সঙ্গে জোট বেঁধে বিএনপির মন্ত্রীরা যেমন জামাতীদের ভাষায় কথা বলছেন, খালেদা-নিজামীর জোট সরকারও জামাতের মৌলবাদী ও ফ্যাসিবাদী নীতি অনুসরণ করছে। হিটলারের তথ্যমন্ত্রী গোয়েবলসের কাজ ছিল একটা মিথ্যা একশবার প্রচার করে সেটাকে সত্য প্রমাণ করা। বাংলাদেশ সরকার গোয়েবলসের মতো ক্রমাগত মিথ্যা বলে সত্যকে আড়াল করার চেষ্টা করেও সফল হতে পারছে না, কারণ এটা ইন্টারনেটের যুগ। যেখানেই যা ঘটুক না কেন কয়েক ঘণ্টার ভেতর সারা পৃথিবীতে সেই সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে।

এ্যামনেস্টির প্রতিবেদন যেমন ইন্টারনেটের মাধ্যমে কয়েক ঘণ্টার ভেতর উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম গোলার্ধে ছড়িয়ে পড়েছে, একই ভাবে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিক্রিয়াও সবাই জেনেছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় বাংলাদেশের সরকার ছাড়া সরকারী বক্তব্য সমর্থন করার কেউ নেই, কিন্তু এ্যামনেস্টির বক্তব্য সমর্থন করার জন্য রয়েছে শত শত সংগঠন, সংবাদপত্র ও মানবাধিকার সচেতন ব্যক্তি। এই লেখাটি শুরুর আগে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ভ্রমণ করে বাংলাদেশে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িক নির্যাতন সম্পর্কে হাজার হাজার প্রতিবেদনের তালিকা পেযেছি। এর ভেতর বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুর উপর নির্যাতনের সংবাদ হচ্ছে ২৪৬০টি, যার ভেতর শুধু হিন্দুদের উপর নির্যাতনের সংবাদ ২৩৩০টি। আজকের (৩১ মে ২০০২) অনুসন্ধানে বাংলাদেশে আল কায়দা নেটওয়ার্কের ওপর ওয়েব সাইটে ৫১৭০টি, বাংলাদেশে আল জেহাদের ওপর ৭৭০০টি, বাংলাদেশে জঙ্গী মৌলবাদীদের উপর ৭০৭০টি, বাংলাদেশে ওসামা বিন লাদেনের নেটওয়ার্কের ওপর ৮৬১০টি এবং বাংলাদেশে তালেবানের ওপর ৩০,২০০টি প্রতিবেদনের তালিকা খুঁজে পেয়েছি।

তালিকাভুক্ত এসব প্রতিবেদন বিভিন্ন সংবাদপত্র, সংগঠন ও নিজস্ব ওয়েবসাইটের। এতে পক্ষ ও বিপক্ষ দুই ধরনেরই প্রতিবেদন রয়েছে। তবে মৌলবাদের অবস্থানের পক্ষে ও বিপক্ষের অনুপাত হচ্ছে ১০০ ঃ ১। বেশ কিছু প্রতিবেদন একাধিকবার তালিকাভুক্ত হয়েছে, কিছু অপ্রাসঙ্গিকও বটে, তবে এর এক চতুর্থাংশও যদি প্রাসঙ্গিকও সত্য হয় তাহলে বাংলাদেশ সম্পর্কে শুধু এদেশের মানুষ নয়, মানবাধিকারে বিশ্বাসী বিশ্বের তাবৎ শান্তি ও গণতন্ত্রকামী মানুষের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। ‘ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ’র একটি প্রতিবেদন পড়ে মাস দুয়েক আগে সরকার এমনই চিৎকার শুরু করেছিল যে মনে হয়েছে বাংলাদেশের উপর কেউ বুঝি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।

‘রিভিউ’ সরকার নিষিদ্ধ করেছে, আনুষ্ঠাকিভাবে প্রতিবাদ পাঠিয়েছে, সরকারের সমর্থক পত্রিকায় এর বিরুদ্ধে অনেক লেখাও বেরিয়েছে। ইন্টারনেটে রিভিউর প্রতিবেদন পড়ে মন্তব্য করেছিলাম, এতে এমন কিছু লেখা হয় নি যা আমরা জানি না, বা ইতিপূর্বে যা কোথাও ছাপা হয়নি। রিভিউর প্রতিবেদন সরকারের ভাবমূর্তি যত না ক্ষুণœ করেছেআন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুপরিচিত একটি পত্রিকা নিষিদ্ধ করে ফ্যাসিসুলভ আচরণের জন্য সরকার নিজেদের ভাবমূর্তি আরও বিনষ্ট করেছে। সরকার রিভিউ নিষিদ্ধ করেছে, কিন্তু ‘ওয়াল ষ্ট্রিট জার্নাল’, ‘ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর’, ‘গার্ডিয়ান, নিউইয়র্ক টাইমস’ কিংবা ‘লা মঁদ’-এর মতো পত্রিকা, বিবিসি কিংবা ডয়েশে ভেলের মতো বেতার কেন্দ্র নিষিদ্ধ করেনি। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের সংবাদ বাংলাদেশ, নেপাল বা ভারতের পত্রপত্রিকায় শুধু নয়, বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সকল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

কারণ জাতিসংঘ সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা সংখ্যালঘু জাতিসত্তার স্বার্থ এবং মানবাধিকার সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন। ওয়েবসাইটে বাংলাদেশে তালেবান সংক্রান্ত সংবাদ খুঁজতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা ‘দি নেশন’-এর বর্তান সংখ্যাটি চোখে পড়েছে। আগামী ১০ জুন প্রকাশিতব্য এই সাময়িকীর একটি বিশেষ প্রতিবেদনের শিরোনাম হচ্ছে ‘দি তালেবানাইজেশন অব বাংলাদেশ। ’ (যঃঃঢ়://িি.িঃযবহধঃরড়হ.পড়স) রুথ বল্ডউইনের লেখা এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘যে সময়ে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান গণমাধ্যমের প্রধান সংবাদ, সে সময়ে অদূরবর্তী বাংলাদেশে মৌলবাদের উত্থান কার্যতঃ অগোচরে থেকে গেছে। গত অক্টোবরের নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর বিজয়ের পর থেকে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার হুমকির সম্মুখীন হয়েছে এই জাতির মডারেট ইসলামের ঐতিহ্য ।

’ প্রতিবেদনে এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও কংগ্রেসম্যানের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক নির্যাতন ও মৌলবাদীদের বিভিন্ন তৎপরতার কথা বলা হয়েছে। ‘ওয়ার্ল্ড রেফিউজি সার্ভে’র এশিয়া পলিসি এ্যাডভাইজার জানা ম্যাসনের বক্তব্য উদ্ধৃত করে দি নেশনের এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অক্টোবরের পর থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ২০ হাজার নির্যাতিত মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে গেছে। গত ডিসেম্বরে এ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল শতাধিক নারী ধর্ষিতা হয়েছে। রুথ বল্ডউইন তাঁর প্রতিবেদনে এটর্নি এলিজাবেথ বার্নার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন নির্যাতিত নারীর সংখ্যা সহস্রাধিক। প্রসঙ্গক্রমে এই প্রতিবেদনে আমার গ্রেফতার এবং আমার প্রতি মৌলবাদীদের হুমকির বিষয়টিও এসেছে।

মাস দুয়েক আগে নিউইয়র্ক থেকে ‘দি নেশন’-এর প্রতিবেদক রুথ বল্ডউইন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। বলেছিলেন, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক নির্যাতন ও মৌলবাদের উত্থান সম্পর্কে তিনি লিখবেন। ইন্টারনেট-এ আমার একটি সাক্ষাৎকারও তিনি নিয়েছিলেন। বলেছিলেন আমাকে তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রে আমন্ত্রণ করতে চান। জবাবে বলেছি, সরকার আমার পাসপোর্ট নিয়ে গেছে, এ মুহূর্তে দেশের বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়।

জামিনে ছ মাসের জন্য জেলের বাইরে এলেও কার্যত আমি যে বন্দিজীবন যাপন করছি সে বিষয়েও তাঁকে বলেছি। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণের আগেই আমাকে সাজা ভুগতে হচ্ছে। রুথের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার সময় পাঁচবার আমার লাইন বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। সাত দিন টিএনটি আমার ইন্টারনেট বন্ধ করে রেখেছিল। এ্যামনিস্টির প্রতিবেদনের প্রতিবাদ করতে গিয়ে সরকার আমার সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছে সেটিও সর্বৈব মিথ্যা।

বার বার সরকার বলছে, আমার বিরুদ্ধে নাকি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার প্রমাণ তাদের হাতে রয়েছে, আমার কোন অধিকার নাকি হরণ করা হয়নি। আদালতে প্রথম দিন থেকে বলছি আমার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার কী প্রমাণ আছে সরকার আদালতে প্রদর্শন করুক। আদালত ও দেশবাসী দেখুক আমার কাছ থেকে জব্দ করা ভিডিও টেপ-এ কী রয়েছে। ছ মাসের ওপর হয়ে গেল সরকার আমার বিরুদ্ধে কোন চার্জশিট দিতে পারেনি। মাঝখানে বরং টেপগুলো নষ্ট করার উদ্যোগ নিয়েছিল, যা আদালতের মাধ্যমে অতি কষ্টে সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়েছে।

নষ্ট করা কিংবা নষ্ট হওয়ার আগে আমি চাই জব্দকৃত টেপগুলো সবাই দেখুক। প্রবীণ কলাম লেখক এবিএম মুসা সহ অনেকে এ দাবি করেছেন। লণ্ডনভিত্তিক ‘এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’, প্যারিসভিত্তিক ‘রিপোটার্স স্যান ফ্রন্টিয়ার্স’, নিউইয়র্কভিত্তিক ‘কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস’ সহ বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা আমার বিরুদ্ধে দায়ের করা মিথ্যা, প্রতিহিংসা ও ষড়যন্ত্রমূলক মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে। আমি মামলা প্রত্যাহারের কথা বলবো না। সরকারের মিথ্যাচার ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা প্রমাণের জন্য এই মামলা আমি শেষ পর্যন্ত লড়বো।

বার বার সরকার বলছে নাগরিক হিসেবে আমার কোন অধিকার নাকি খর্ব করা হয়নি! তাই যদি হবে তবে আমার অবাধ চলাচলের উপর কেন এত সব নিষেধাজ্ঞা, কেন এত নজরদারি, টেলিফোনে, ইন্টারনেটে আড়িপাতা? আদালত আমার পাসপোর্ট জব্দ করতে বলেনি। প্রতি বছর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার আমন্ত্রণে আমাকে দেশের বাইরে যেতে হয়। জীবিকার প্রয়োজনেও যেতে হয়। পাসপোর্ট জব্দ করে সরকার আমার জীবিকার উপর হস্তক্ষেপ করেছে, সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার হরণ করেছে। আমার রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা এখন আদালতে।

আদালতে প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত আমাকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলা বা কোন রকম শাস্তি দেয়া বাংলাদেশের সংবধিানবিরোধী, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদের লংঘন এবং এর জন্য বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যেভাবে ক্ষুণœ হচ্ছে তার দায় সম্পূর্ণভাবে খালেদা-নিজামীর ফ্যাসিস্ট-মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক সরকারের। সরকারের শরিক নিজামীরা মৌলবাদী, রাজাকার, স্বাধীনতাবিরোধী, একাত্তরের ঘাতক দালাল নয়এ কথা বিএনপির নেতারা শত কোটিবার গেলাতে চাইলেও বাংলাদেশের মানুষ এতটা ছাগল নয় যে তা গিলবে। গত কদিন ধরে রাজাকারকে রাজাকার বলার জন্য সরকারী দলের সন্ত্রাসীরা বুয়েটের ছাত্রী মুমু ও তার সংগঠনের ছাত্রদের জীবন অতিষ্ট করে তুলেছে। কিশোরী পুর্নিমার ধর্ষণকারীরা জামিনে বেরিয়ে এসে হুমকি দিয়ে বেড়াচ্ছে। প্রতিদিনের মতো আজও খবরের কাগজে হত্যা ও ধর্ষণের প্রাত্যহিক খবরের পাশে সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের খবর পত্রিকায় ছাপা হয়েছে।

গত জুলাইয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের খবর পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। সরকারের সমর্থক পত্রিকাগুলিতেও এ ধরনের খবর ছাপা হয়েছে। ৩২০ দিন অতিক্রান্ত হয়েছে, নির্যাতন বন্ধ হয়নি। সরকারের ধারাবাহিক মিথ্যাচার এবং নির্যাতনের ঘটনা অস্বীকার প্রকৃতপক্ষে সন্ত্রাসীদের আরও নির্যাতন, হত্যা ও ধর্ষণসহ যাবতীয় দুষ্কর্মে উৎসাহিত করছে। ক্রমাগত মিথ্যাচারের দ্বারা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য খালেদা-নিজামীর সরকারকে একদিন অবশ্যই জনতার আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.