আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একজন আপাদমস্তক ভদ্রজনের কথা

মানুষে মানুষে সমানাধিকারে বিশ্বাস করি
মানুষ তার নিজের প্রয়োজনে সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করে থাকে। ব্যক্তি যখন সমাজের অগ্রগতির জন্য নিজের মেধা, মনন ও সক্ষমতাকে কাজে লাগান তখন তিনি হয়ে উঠেন অনন্য এক মানুষ। আমাদের সকলের প্রিয়জন অধ্যাপক অসিত কুমার মজুমদার এমনই একজন মানুষ। তিনি ঢাকা জেলার ধামরাইয়ের বনেদি ব্রাক্ষণ পরিবারের উচ্চশিক্ষিত মানুষ। সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করে অধ্যক্ষ হয়ে তারপর অবসর নিয়েছেন।

বাড়ি তার সাতক্ষীরাতে নয়, কিন্তু কি এক অপরুপ মমত্বের বাঁধন সাতক্ষীরার মাটিই শেষ পর্যন্ত বেঁধে রেখেছিল তাকে। আশির দশকে সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ জাতীয়করণের পর ১৯৮০ সালের জুলাই মাসে সেখানে প্রথম অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে তার সম্বন্ধ স্থাপিত হয় সাতক্ষীরার সাথে। আপদমস্তক ভদ্রলোক বলতে আমরা যা বুঝি, অধ্যাপক মজুমদার ছিলেন তেমনই এক ব্যক্তিত্ব। পোশাক পরিচ্ছদে সর্বদা পরিপাটি, আচরণে স্বভাবসুলভ বিনয় আর আন্তরিকতায় পরিচিত মহলে পিতৃতূল্য ছিলেন। অধ্যাপক মজুমদারের চরিত্রের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল তিনি সহজে কাউকে না বলতে পারতেন না।

লেখক তিনি ছিলেন না বটে, কিন্তু ছিলেন বিদগ্ধ পাঠক। অসিত কুমার মজুমদার আজীবন তার শ্রেষ্ঠ এবং অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে বইকেই যেন বেছে নিয়েছিলেন। সাহিত্যের অধ্যাপক হলেও পাঠ করতেন ইতিহাস, রাজনীতি, সমালোচনাগ্রন্থ এবং সর্বোপরি নির্মল সাহিত্য। পাঠে তার ছিল অনাবিল পরিতৃপ্তি। ১৯৩৪ (মতান্তরে ১৯৩৩) সালের ১৫ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়ায় মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।

বাবা জ্যোতিলাল মজুমদার ছিলেন আইনজীবী। বাড়িতেই মাত্র চার বছর বয়সে পণ্ডিত রমণী মাস্টারের নিকট শিক্ষা জীবনের শুরু। হার্ডিঞ্জ হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করার পর ১৯৫২ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে আই.এস.সি পাশ করেন। প্রথমে বি.এস.সি ভর্তি হলেও এক বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ছাত্র জীবনে তার শিক্ষক ছিলেন বাংলা সাহিত্যের অসামান্য গবেষক, প্রবন্ধকার প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক ড. আহমদ শরীফ।

অধ্যাপক আহমেদ শরীফের ব্যক্তিত্ব এবং পাণ্ডিত্য তাকে প্রভাবিত করেছিল দারুণভাবে। তিনি পছন্দ করতেন বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বে আঁধারের বিরুদ্ধে আলোকবার্তা নিয়ে পথ চলা এই শিক্ষককে। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক মজুমদারের সহপাঠী ছিলেন সদ্যপ্রয়াত বিশিষ্ট গবেষক, লেখক আব্দুল মান্নান সৈয়দ, প্রয়াত গীতিকার অধ্যাপক মনিরুজ্জামান প্রমূখ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে সম্মানসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ( ১৯৫৯ সালে) পাশ শেষে কিছুদিন মাদরীপুর কলেজে শিক্ষকতা করেন। ১৯৬১ সালে রাজশাহী কলেজে শিক্ষকতার মাধ্যমে সরকারি চাকুরী জীবনের শুরু।

১৯৬২ সাল থেকে প্রায় ৪ বছর পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে, ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত দেশের তৎকালীন অন্যতম শ্রেষ্ঠ কলেজ জগন্নাথ কলেজে অধ্যাপনা করেন তিনি। ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত দেশের আর এক বিখ্যাত কলেজ রাজশাহী কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। বদলির সূত্রেই তার সাতক্ষীরায় আগমন। এখনও পর্যন্ত তিনিই সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের সবচেয়ে দীর্ঘ (১৯৮০-১৯৮৯) সময়ের অধ্যক্ষ। অধ্যাপক মজুমদার শেষ পর্যন্ত জয়পুরহাট সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট অবসর গ্রহণ করেন।

কিন্তু সাতক্ষীরার মাটি ও মানুষের সাথে আত্মিক যোগের কারণেই তিনি স্থায়ী হন এখানে। আজীবন অকৃতদার এই প্রবীণ শিক্ষাগুরু ৭৬ বছর বয়সে বার্ধক্যজনিত কারণে ২০০৯ সালের ২৬ জানুয়ারী সাতক্ষীরার মাটিতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। ৭৬ বছর বয়সেও রুচি, আধুনিকতা ও মননের বিচারে তিনি ছিলেন যুবা। মূল্যবোধের প্রশ্নে আপোষহীন, সততা ও ন্যায়ানুবর্তিতায় অদ্বিতীয় এই মহান শিক্ষক তার প্রিয় শিক্ষক ড. আহমদ শরীফের মতই ছিলেন প্রগতিশীল এবং অসা¤প্রদায়িক। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধকালে ড. এ আর মল্লিকের নেতৃত্বাধীন মুজিবনগর সরকারের শিক্ষাবিদদের এক বিশেষ কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি।

এ সময় তিনি কলকাতায় উদ্বাস্তু বাংলাদেশীদের এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতাও করেন। আমাদের অন্তরের নিকটতম এই জ্ঞানপিপাসু মানুষটির গুণের কোন শেষ ছিল না। ভালো কোন বই পেলেই তিনি তা কিনে ফেলতেন। তার সংগ্রহে বেশ কিছু দুর্লভ বইপত্র ও সাময়ীকি ছিল। তিনি ভালোবাসতেন মানুষকে আর তাই সমাজের সকল নীপিড়িত মানুষের প্রতি তার দরদ ছিল প্রাণঢালা।

আমাদের এই ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ সমস্যাসঙ্কুল সমাজে তিনি ছিলেন এক বিরল ব্যতিক্রম। আমরা সাধারণত খুঁজে ফিরি আত্মস্বার্থ। বিপরীতে তিনি খুঁজতেন গণমানুষের স্বার্থ। সক্রিয় রাজনীতি তিনি করেননি বটে, কিন্তু তার বিশেষ দরদ ছিল গণবান্ধব প্রগতিশীল ও সাম্যবাদী রাজনীতির প্রতি। নীরবে-নিভৃতে তিনি অকাতরে সাহায্য করেছেন তার অসংখ্য দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের।

নাম না জানা কতজনকে যে তিনি নানা সময়ে অর্থ দিয়ে, শিক্ষা দিয়ে সহযোগিতা করেছেন তার পরিসংখ্যান কে রাখে। প্রতিদিন সূর্যাস্তের পর তিনি বের হতেন সান্ধ্য আড্ডায় যোগ দিতে ছোট-বড় বন্ধুদের উদ্দ্যেশে। তার সঙ্গ ছিল আমাদের জন্য বিরাট এক প্রাপ্তি। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা আর বিপুলা পৃথিবী সম্পর্কে অগাধ জ্ঞানের কারণে সবাই বিনম্র শ্রদ্ধায় নানা বিষয়ে তার মত, ব্যাখ্যা ও সমালোচনা শুনতেন। সর্বজন শ্রদ্ধেয় এই শিক্ষক নানা শারীরিক সমস্যায় দীর্ঘদিন ভুগেছেন বটে, কিন্তু বিভিন্ন অনুষ্ঠান, আলোচনা সভায় তার সপ্রতিভ উপস্থিতিতে তা তেমন বাঁধা হয়ে দাড়ায়নি কখনও।

আমাদের প্রাণপ্রিয় শিক্ষক সন্ধ্যার আড্ডার মধ্যমণি অসিত স্যারের সেই দীপ্ত পথচলা আজ থেমে গেছে। তিনি নেই, আছে তার সোনায় মোড়ানো স্মৃতি যার সকলি জুড়ে তার বুদ্ধিদীপ্ত মুখচ্ছবি আর প্রাণবন্ত প্রজ্ঞার স্ফুরণ। অকৃতদার এই মানুষটি তার জীবনকালে অসংখ্য শিক্ষার্থীর জীবন গঠনে শিক্ষাগুরুর ভূমিকা রাখার পাশাপাশি সমাজে ক্রিয়াশীল সকল প্রগতিশীল সংগঠনের কর্মকাণ্ডে অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়ে গেছেন। চিরকুমার এই মহান এই মানুষটি দেশ ও দশের ন্যায়ভিত্তিক উন্নয়নের সপক্ষে কাজ করাকেই জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। অসংখ্য শিক্ষার্থী, সহকর্মী আর সমাজঘনিষ্ঠ ব্যক্তিই ছিলেন তার বন্ধু ও পরিবার।

মানুষের জন্য নিবেদিত ছিল যে শিক্ষাগুরুর জীবন তার স্মৃতিকে ধরে রাখা, তার নীতি ও আদর্শকে পরবর্তী প্রজন্মের নিকট তুলে ধরা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। অধ্যাপক মজুমদার চাইতেন সৃষ্টিশীলতা ও নান্দনিকতার নিরন্তর চর্চার মাধ্যমে প্রগতির পথে সমাজ এগিয়ে যাবে, বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন মানুষ নেতৃত্ব দেবে জাতির। অধ্যাপক মজুমদারের স্মৃতিকে ধরে রাখতে তার নামে প্রতিবছর একটি ‘স্মারক বক্তৃতা’ আয়োজনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। সকলের নিকট আমাদের প্রার্থনা এই মহৎ কাজটি এগিয়ে নিয়ে যেতে আপনাদের সহযোগিতার হাতটি প্রসারিত করবেন। যে মানুষটি আমাদের এত কিছু শিখিয়েছেন সেই মানুষটির স্মৃতিকে ধরে রাখার মাধ্যমে আমরা তার গুণমুগ্ধ বন্ধুজন আমাদের উপর অর্পিত দায়িত্বই পালন করার প্রয়াস পাচ্ছি মাত্র।

এই প্রচেষ্টাকে তাই সফল করতেই হবে। আজ এই কীর্তিমান মহান মানুষটির দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। আমরা তোমাকে ভুলব না হে জ্ঞানী।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.