বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স) হলেন সর্ব কালের সর্ব যুগের সর্ব শ্রেষ্ঠ মহামানব। তিনি একাধারে আধ্যাত্বিক দিক দিয়ে সর্বোচ্চ মাকাম ও ব্যাক্তি জীবনে সর্বোত্তম আদর্শের অধীকারি ছিলেন। এ দুইয়ের সংমিশ্রণে ধর্মীয় জীবনে, ব্যক্তি জীবনে, সামাজিক জীবনে ও জাতীয় জীবনে তিনি এক অনন্য ও অতুলনীয় বৈশিষ্টমন্ডিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। এজন্য হযরত রাসূল (স) জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবার কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ মহাপুরুষ হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেছেন। আর অতূুলনীয় ব্যক্তিত্ব ও দৃষ্টান্তমূলক চরিত্রের বলে তিনি মাত্র দুই দশকে একটি বর্বর, অসভ্য ও অনুন্নত আরব জাতিকে সুসভ্য ও সমৃদ্ধশালী করে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতির মর্যাদায় উন্নীত করেন।
কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে , সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবের ওফাতের তারিখ নিয়ে আজ আমরা তার অনুসারীরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছি। বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও জীবনী লেখক হযরত রাসুল (স) এর ওফাতের তারিখ কে ভিন্ন ভিন্ন বলে মন্তব্য করেছেন। যিনি তার সুশিক্ষিত কাতেবদের দিয়ে আল্লাহর বাণী আল কুরআনের প্রতিটি আয়াত নির্ভূল ভাবে লিপিবদ্ধ করে গেছেন, যিনি অগণিত সত্যাশ্রয়ী নিবেদিত মানুষ তৈরী করে একটি সুশৃংখল আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, যিনি অসংখ্য নিরক্ষর মানুষকে শিক্ষার আলো দিয়ে কুরআন হাদীসের বিশেষজ্ঞ করে গেছেন, তার ওফাতের সঠিক তারিখটি লিখে রাখার মত কি কোন সাহাবী ছিলেন না? তিনি তো কোথাও যুদ্ধ করতে গিয়ে গুম হয়ে যান নাই অথবা লোকচক্ষুর অন্তরালে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন নি। তিনি তার প্রাণ প্রিয় সাহাবী হযরত আবু বকর (র), হযরত উমর (র), হরত উসমান (র), হযরত আলী (র),
হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (র), হযরত তালহা (র), হযরত যুবায়ের (র) এর মত অসংখ্য বিজ্ঞ, বিচক্ষণ ও দুরদর্শী বরেণ্য সাহাব কেরামের সামনে হাসি মুখে ওফাৎ লাভ করেছিলেন। কিন্তু তারা কি এই জগৎ গুরু হযরত রাসুল (স) ওফাতের তারিখটি লিখে রাখতে পারেন নি?
পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে-
"আজ আমি তোমাদের ধর্মকে পূর্ণত্ব প্রদান করলাম, আমার নেয়ামত পরিপুর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে একমাত্র ধর্ম হিসাবে কবুল করে নিলাম"
( সূরা মায়েদা-আয়াত-৩)
এ প্রসিদ্ধ আয়াতখানি হিজরী দশম বর্ষের ৯ই জিলহজ্ব তারিখে আরাফার ময়দানে অবতীর্ণ হয়।
এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার স্থান, দিন, তারিখ ও সময় নির্দিষ্ট হওয়ায় এ তারিখ কে হযরত রাসূল (স) এর ওফাতের তারিখ নির্ণয়ের জন্য নির্ভরযোগ্য ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করা যায়। বিখ্যাত সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেন, এ আয়াত দশম হিজরীর ৯ই জি্লহজ্ব তারিখে নাযিল হ্য়।
এরপর রাহমাতাল্লিল আলামিন (স) মাত্র ৮১ দিন পৃথিবীতে জীবিত ছিলেন
( তাফসীরে মা'রেফুল কুরআন)
বিদায় হজ্বের দিনে আলোচ্য আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়া থেকে ৮১ তম দিবসে রাসূলূল্লাহ (স) ওফাৎ লাভ করেন বলে সর্বসম্মত অভিমত। প্রাচীন ও আধূুনিক কালের প্রায় ভাষ্যকারই এ মত ব্যক্ত করেছেন। বর্তমান কালের আল্লামা সাব্বির আহমদ উসমানী ও তার বিখ্যাত উর্দু তাফসীরে ৮১ দিন উল্লেখ করেছেন।
*" ইবনে জারীর কতৃক ইবনে জুরাইজ হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন- এ আয়াত টি অবতীর্ণ হওয়ার পর হযরত রাসূল (স) ৮১ রাত দুনিয়াতে অবস্থান করেন" [ তাফসীরে দোররে মানসূর ৩য় খন্ড পৃষ্ঠা ২০]
**" হাজ্বাজ কতৃক ইবনে জুরাইজ হতে বর্নিত হয়েছে, তিনি বলেন-এ আয়াত টি অবতীর্ণ হওয়ার পর ৮১ রাত রাসুল (স) জীবিত ছিলেন"
[তাফসীরে তাবারী, ৪র্থ খন্ড ৮০ পৃষ্ঠা ]
***"ঈমাম বাগবী বলেন, হারূন ইবনে আনতারা তার পিতা হতে বর্ণনা করেন, এ আয়াত টি অবতীর্ণ হওয়ার পর রাসূল (স) ৮১ দিন জীবিত ছিলেন"
[ তাফসীরে মাযহারী, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা ২৫]
****"ইবনে জারীর ও অন্যান্যরা বলেন, আরাফাহ দিবসের পর হযরত রাসুল (স) ৮১ দিন জীবীত ছিলেন "
[ তাফসীরে ইবনে কাসীর ২্য খন্ড পৃষ্ঠা ১৩]
উপোরক্ত বর্ণনা গুলো হতে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় যে বিদায় হজ্বের দিন থেকে ৮১ তম দিবসে ওফাৎ লাভ করেছিলেন। সুতরাং আমরা বিদায় হজ্বের দিন থেকে ৮১ তম দিন কত তারিখ ও কি বার হ্য় তা গণনা করলে হযরত রাসূল (স)
এর ওফাতের তারিখ সম্মন্ধে নিশ্চিত হতে পারি।
এ কথা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত হ্য় যে বিদায় হজ্বের দিন টি ছিল শুক্রবার এজন্যই শুক্রবার দিনের হজ্বকে আকবরী হজ্ব বলা হয় এ ব্যপারে কারো কোন দি্মত নেই। সূতরাং বিদায় হজ্ব তথা দশম হিজ্বরীর ৯ই জিলহজ্ব শুক্রবারকে ভিত্তি ধরে হিসাব করলে হযরত রাসূল (স) এর ওফাতের সঠিক তারিখ নির্ণয় করা সম্ভব। হযরত রাসূল (স) এর হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী চান্দ্র বর্ষের একমাস হয় ৩০ দিনে এবং পরবর্তী মাস হয় ২৯ দিনে।
এ হিসাবে জিলহজ্ব মাস ২৯ দিন, মহরম মাস ৩০ দিন ও সফর মাস ২৯ দিনে হ্য়। কাজেই দশম হিজ্বরীর ৯ই জিলহজ্ব হতে হিসাব করলে দেখা যায়, জিলহজ্ব মাসের ২১ দিন,মহরম মাসের ৩০ দিন, সফর মাসের ২৯ দিন এবং রবিউল আউয়াল মাসের ১লা তারিখ তথা ১ দিন মিলে মোট একাশি দিন হয়। সুতরাং এ হিসাবে হযরত রাসূল (স) একাদশ হিজরীর ১লা রবিউল আউয়াল ওফাৎ লাভ করেছিলেন।
তাছাড়া হযরত রাসূল (স) রবিউল আউয়াল মাসের সোমবারে ওফাৎ লাভ করেছিলেন, এ ব্যপারেও সবাই একমত। আমরা দশম হিজরীর ৯ই জিলহজ্ব তারিখকে শুক্রবার ধরলে উপরোল্লিখিত হিসাব অনুযায়ী ১লা রবিউল আউয়াল সোমবার পড়ে।
এ হিসাবেও রাসূল (স) ১লা রবিউল আউয়াল ওফাৎ লাভ করেছিলেন তা প্রমাণিত হয়।
অধিকন্তু হযরত রাসূল (স) এর জীবনি মোবারকের নির্ভরযোগ্য বর্ণনা হতে জানা যায়, জীবনের শেষভাগে তিনি বেশ কিছুদিন অসুস্থ ছিলেন। তবে ওফাতের ৫ দিন পূর্বে তিনি হঠাৎ করে সম্পুর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেন। আর ঐ দিনটি ছিল সফর মাসের শেষ বুধবার, যা মুসলিম জাহানে 'আখেরী চাহার সোম্বা' নামে পরিচিত। উপোরোল্লিখিত হিসাব অনুযায়ী একাদশ হিজরীর ২৫ শে সফর ছিল বুধবার।
আর এ দিন ও তারিখ হতে পাঁচদিন গণনা করলে একাদশ হিজরীর ১ লা রবিউল আউয়াল সোমবার হ্য়। অন্যদিকে 'আখেরী চাহার সোম্বা' যদি হযরত রাসূল (স) এর জীবনের শেষ বুধবার হয় এবং তিনি যদি এর পরবর্তীতে অপর কোন বুধবার না পেয়ে থাকেন, তবে ' আখেরী চাহার সোম্বা'র পরবর্তী সোমবারই হলো তার ওফাৎ দিবস। সুতরাং ১লা রবিউল আউয়াল তারিখে হযরত রাসূল (স) ওফাৎ লাভ করেছিলেন বলে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হ্য়।
সুতরাং উক্ত প্রমাণসই তথ্যর হিসাবে চারদিক থেকেই ১লা রবিউল আউয়াল সোমবার হ্য় বিধায় একথা নিশ্চিৎ ভাবে বলা যায় যে, হযরত রাসূল (স) হিজরীর ১লা রবিউল আউয়াল সোমবার ওফাৎ লাভ করেছিলেন।
ৃএ প্রসংগে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত , সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষের' ২য় খন্ডের ৩২৯ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে-'জীবনের শেষ দিন সোমবার প্রত্যুষে হযরত রাসূল (স) দরজার পর্দা সরাইয়া সাহাবীদের সালাত আদায়ের দৃশ্য অবলোকন করিয়া পরম তৃপ্তি লাভ করিলেন।
তাহার যন্ত্রণাকাতর মুখে হাসির রেখা ফুটিল। তৃতীয় প্রহরে অন্তিম অবস্থা দেখা দিল। বার বার তাহার সংজ্ঞা লোপ পাইতেছিল। চৈতন্য লাভের পর বার বার তিনি বলিতে লাগিলেন, 'আর রফিকুল আলা'-'তিনিই (আল্লাহ) শ্রেষ্ঠতম বন্ধু'। আলী (স) হযরত এর মস্তক কোলে করিয়া বসিয়াছেন, এমন সম্য় একবার চোখ মেলিয়া আলী (র) এর দইকে তাকাইয়া হযরত (স) অস্ফুটস্বরে বলিতে লাগিলেন, 'সাবধান দাস দাসীদের প্রতি নির্মম হইয়োনা।
একবার আয়শা (র) এর বুকে মাথা রাখিয়া শেষবারের মত চোখ মেলিয়া উচ্চকন্ঠে তিনি বলিয়া উঠিলেন 'সালাত-সালাত, সাবধান দাস দাসীদের প্রতি সাবধান অতপর শেষ নিশ্বাসের সাথে উচ্চারণ করিলেন 'হে আল্লাহ! শ্রেষ্ঠতম বন্ধু'। ১লা রবিউল আউয়াল সোমবার ৬৩ বছর বয়সে হযরত রাসূল (স) এর ইন্তিকাল হয় সূর্যাস্তের কিছু পূর্বে"
হযরত রাসূল (স) যে ১লা রবিউল আউয়াল ওফাৎ লাভ করেছেন এটাই সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে। সমাজের প্রচলিত ১২ ই রবিউল আউয়াল তার ওফাতের তারিখ বলে প্রমাণিত হয়না। কারণ দশম হিজরীর ৯ই জিলহজ্ব শুক্রবার হলে তিনটি মাসের সবকটি মাস যদি ৩০ দিন বা ২৯ দিন যে কোন ভাবেই হিসাব করা হোকনা কেন কোন হিসাবেই একাদশ হিজরীর ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার হয়না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।