জীবন কবিতার মত। আর কবিতাগুলো দুর্বোধ্য।
শেষ হয়ে যাওয়া সিগারেটের গোড়া দিয়ে দ্বিতীয় সিগারেটটা ধরালো আতিয়ার। সিগারেটে আর এমন কি নেশা। রেণুর বারণ শুনতে শুনতে নেশা ধরে গেছে।
প্রত্যেক সিগারেটে একবার করে বারণ।
‘সরে বসো হাতিয়ার। মুখ দিয়ে গন্ধ আসছে। তোমার ভাইকে বন্ধ করালাম। তোমাকে পারলাম না।
’
প্রত্যেকবার একই ডায়লগ। তবু খুব ভাল লাগে। গায়ে কাঁপুনি উঠে যায়। ইচ্ছে হয় গলা টিপে রেণুকে মেরে ফেলতে। এমন সুন্দর একটা মেয়ে আরেকজনের ঘর করছে।
‘রাতে যাওয়ার দরকারটা কি? কাল সকালে যাও । ভোরে তোমারে ডেকে উঠায়ে দিব। এত রাতে একা একা যাবা ভাল লাগছে না। তোমার কাজিন রাজি না। ’
‘হুঁ ’
‘মানে কি ? যাবা, না যাবা না?’
‘যাব।
’
‘রাত্ ে। ভয় পাবা না? ’
‘ফকফকা আকাশ । জোসনা রাত। দিনের বেলার মত আলো। চলে যেতে পারবো।
সবাইকে তোমার স্বামীর মত ইন্দুর ভাব কেন?’
‘তুমি হইলা বিলাই। তোমাকে ইঁন্দুর ভাবব কেন? ’
রেণু হাসছে।
আতিয়ারের গায়ে আবার কাঁপুনি উঠল। সাথে সাথে ইচ্ছে হল রেণুর গলাটা টিপে ধরতে। কি সুন্দর মুখ, এত মায়া।
আহা। আতিয়ারের মনে হল এখানে থাকলে বিশ্রী কিছু হয়ে যেতে পারে। আসাটাই ঠিক হযনি।
‘তা বিলাই সাব। জোসনা রাতে আকাশ থেকে পরী নামে জানেন তো? আপনাকে যদি ধরে নিয়ে যায়? ’, রেণু রহস্য করে।
আতিয়ার মুখে শুধু হাসল। মনে মনে বলল ‘ তুমি কি আকাশ থেকে নেমেছিলে?... রেণু, পরী বলে কিছু নেই গো সোনা। ’ আবার শীতশীত লাগছে। মেজাজটা খুব খারাপ হচ্ছে।
‘ উহ ... আমি যাব।
জরুরী কাজ আছে। কালকে মাল ডেলিভারী। কতবার বলবো? ’
রেণুর রান্না অসাধারন। এই রান্না খেলেও শীত শীত লাগে। খেয়েদেয়ে আতিয়ার আরেকটা সিগারেট ধরালো।
রেণু বলল.‘সরে বসো। ’
আতিয়ারের মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। বলল,‘আমি এখন বেরোব । ’
‘ তোমার কাজিন মন খারাপ করবে। কাল সকালে যাও..উনি আসুক।
’
‘ না। ’
ব্যাগ কাঁধে নিয়ে আতিয়ার বেরোচ্ছে। বুকের মধ্যে যেন কিছু একটা জমাট বেঁধে রয়েছে। রেণু দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
আকাশে অপুর্ব জোসনা।
রেণুদের নতুন বাড়ির টিনের চাল চাঁদের আলোয় চকচক করছে। অনেক দুর থেকে আতিয়ার একবার বাড়িটার দিকে ফিরে তাকালো। মনে হল ঐ চালের নিচে দরজা ধরে রেণু এখনও দাঁড়িয়ে আছে। দুরের আবছা ্অলোতে যতদুর পর্যন্ত আতিয়ারকে দেখা যাবে ততক্ষন পর্যন্ত সে দাঁড়িয়ে থাকবে। আতিয়ারের বুকের ভিতরটা হু হু করে উঠল।
শীত শীত লাগছে।
রেণুদের বাড়ি আর দেখা যাচ্ছে না। চাঁদের আলোতে আতিয়ার কাঁচা রাস্তা ধরে হাঁটছে।
রাস্তা একদম ফাঁকা। দুর থেকে বাতাস আসছে।
জোসনায় এরকম বাতাসে হাঁটতে হাঁটতে আঁতিয়ারের বেশ প্রশান্তি হচ্ছিল।
বাতাসে আতিয়ারের চুল উড়ছে। দেহের ছোট ছায়া মাটির রাস্তায় লেপটে পড়েছে। ছায়ার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে অনেকটা পথ চলে এসেছে আতিয়ার। রেণুর কথাগুলো কানে রিনরিন করে বাজছে।
‘...আজ না গেলে হয় না?...জোসনা রাতে পরী নামে...যদি ধরে নিয়ে যায়?.....আবার কবে আসবা?..’
রাস্তার দু পাশে ধান ক্ষেত। ধানে দুধ এসে গেছে। দুরে মিথিলিন গ্যাস জ্বলে নিভে গেল। আতিয়ার বাঁশ ঝাড়ের মধ্যে দিয়ে বের হলো। এখন রাস্তার দুপাশে কলার ক্ষেত ।
দমকা বাতাস। পিছনে বাঁশ বাগানে বাতাসের শো শো শব্দ হচ্ছে। বাতাসে কলা গাছের পাতা দুলছে। একটা পাতার সাথে আরেকটা পাতা ঠোকাঠুকি খাচ্ছে। যেন চাঁদের আলোয়, পাতাগুলো হেসে হেসে একটা আরেকটার গায়ে গড়িয়ে পড়ছে।
আতিয়ার হঠাৎ কিছু দেখে থমকে দাঁড়ায়, ঘড়িতে প্রায় রাত সাড়ে এগারটা। জামার পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। সিগারেট ধরালো।
বিশ পঁচিশ হাত দুরে ক্ষেতের মধ্যে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চেহারা অস্পষ্ট ।
মেয়েটা আতিয়ারের দিকে তাকিয়ে আছে। নগ্ন দেহ। কোন নড়াচড়া নেই। স্থির দাঁড়িয়ে আছে। কলার পাতার ঠোকাঠুকিতে একবার মেয়েটার গায়ে আলো পড়ছে , একবার ছায়া পড়ছে।
আতিয়ারের শরীর শক্ত হয়ে গেছে। বেণু বোধ হয় ঠিকই বলেছে। জোসনায় পরী নামে। সিগারেটের তাপ ঠোঁটের কাছাকাছি এসে গেছে। আতিয়ার দ্বিতীয় সিগারেটটা ধরালো।
আতিয়ার নড়ছে না মেয়েটাও নড়ছেনা। দুজন দুজনার দিকে তাকিয়ে আছে। আতিয়ার ঘেমে নেয়ে গেছে।
একনাগারে দাঁড়িয়ে আতিয়ার তিন নম্বর সিগারেটটা শেষ করল আতিয়ার। মেয়েটার কোন নড়াচড়া নেই।
আতিয়ার রাস্তার উপর বসে পড়ল। চিৎকার করল, ‘কে রে তুই? ...কি ওখানে? ’
নিরুত্তর।
মন নিজেকেই যেন প্রহসন করছে। ‘..পরী বলে কিছু নেই আতিয়ার? ...হা..হা..হা...’
আতিয়ার উল্টা পথ ধরলো। রেণুর বাড়ি যখন পৌঁছ্লা তখন রাত দেড়টা।
সারাটা পথে আতিয়ার একবারও পিছনে ফেরে নি। রেণুর বাড়ির উঠানে পৌছানোর পরে ভয় কেটে গেছে অনেকটা। পুরো ব্যপারটা মনের ভুল বলে কিছুতেই মনে হচ্ছে না।
রেণু গভীর ঘুমে অচেতন। আতিয়ার তাকে জাগালো না।
বারান্দার পাতা বেঞ্চিতে নির্ঘুম রাত কাটালো।
আকাশ সামান্য পরিস্কার হতেই আতিয়ার আবার রওয়ানা হলো। মনে মনে বলল, রেণু তোমার এত কাছ থেকে চলে গেলাম তুমি জানলে না..
বাঁশঝাড় পেরিয়ে কলার ক্ষেতটায় আতিয়ার যখন পৌঁছাল তখনও মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। একইভাবে , একই দৃষ্টিতে। মাটির মুর্তি।
আশেপাশে হিন্দু বাড়িঘর রয়েছে বোধ হয়। আরাধনার দেবীকে মন্দির থেকে কোন কারনে কলার ক্ষেতে স্থাপন করা হয়েছে।
আতিয়ার সেই নারী মূর্তিটার মাথায় হাত রেখে বলল, ‘বলেছিনা রেণু,পরী বলে কিছু নেই গো , সোনা...’
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।