আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী, মুখস্থবিদ্যা বিধ্বংসী

কবে যাবো পাহাড়ে... কবে শাল মহুয়া কণকচাঁপার মালা দেব তাহারে....

তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের ছাত্র। ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। সাধারণ গণিতে ৬৫ পেয়েছি। সব বিষয়ের মধ্যে সেটাই সর্বোচ্চ।

উচ্চতর গণিতে কোনমতে পাস করেছিলাম শুধু। বাবা-মা দু’জনই মহা দুঃশ্চিন্তায়। এহেন অবস্থা থাকলে তো ছেলেকে এসএসসিতে স্টার মার্কস পাওয়ানো প্রায় অসম্ভব! কাজেই, মার স্বল্প আয়ের বাবা আমাকে অংকের টিচারের কাছে প্রাইভেট পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। বাড়িভাড়া, ইলেকট্রিক-গ্যাসের বিল, স্কুলের বেতন- এসব দিয়ে মা’র হাতে সেসময় সর্বসাকুল্যে ৪০০০ টাকার মত থাকত- সারা মাস ৪ জনের এ পরিবারটিকে চালিয়ে নেয়ার জন্য। এর মধ্যে এখন যোগ হল ৮০০ টাকা- মানিক স্যারের মাইনে।

মানিক বাবু কোন শিক্ষক নন। তিনি মূলত আমাদের কলেজের রসায়ন পরিক্ষাগারের প্রদর্শক (ডেমন্স্ট্রেটর)। কিন্তু, গাধা পিটিয়ে মানুষ করায় তিনি বেশ ওস্তাদ। তাঁর প্রাইভেটে অনেক কড়াকড়ি। এক মিনিটও লেট করে আসা চলবেনা।

সব অংক একেবারে হুবহু বইয়ের নিয়মে করতে হবে। একবার মনে আছে, একটি সম্পাদ্যে আমি ‘অংকন’-এর বানান ‘অঙ্কন’ লিখেছিলাম। এর কারণে তিনি ওই সম্পাদ্যে আমাকে ৪ এর মধ্যে ২ দিয়েছিলেন, যদিও আমি অন্য কোন ভুল করিনি! বেতন আদায়ের ব্যাপারেও তিনি অনেক কঠোর ছিলেন। মাসের ৫ তারিখের মধ্যে বেতন না দিলে তিনি চোখ কপালে তুলে, মুখ বিকৃত করে জিজ্ঞেস করতেন, ‘বাপ-মা কি ফকির নাকি? তাইলে প্রাইভেট পড়তে আসছ কেন?’ সে যাই হোক, মানিক স্যার আমাকে টেনে হিঁচড়ে ৬০ এর ঘর থেকে ৯০ এর ঘরে নিয়ে আসলেন। এমনকি, উচ্চতর গণিতেও ৮০-৮৫ পাওয়া শুরু করলাম।

বিশালাকর বপুর সাথে চরম বিসদৃশ গোঁফ, কুৎসিত ভাষা ও মুখভঙ্গি সত্ত্বেও মানিক স্যারকে আমার বেশ ভালই লাগত। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস গরুর মত খাটিয়েছেন। এত পরীক্ষা দিয়েছি তাঁর প্রাইভেটে, যে পুরো বইয়ের সব অংক পুরো মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। ঘুমোতে গেলেও চোখের সামনে অংক ভাসত। আমাদের স্কুলে অংকের বাঘা বাঘা শিক্ষকের কমতি ছিল না।

ফয়েজ স্যার, মঞ্জুর স্যার, লতিফ স্যার (লাট্টু) প্রমুখ। কিন্তু, সাফল্যের দিক থেকে মানিক স্যার নামক বিএসসি (পাস) প্রাণীটির সাথে তাঁরা কিছুতেই টেক্কা দিতে পারতেননা। ব্যাপারটা আমার কাছে সে সময় খুব অবাক লাগত। এখন আর অবাক হইনা। যে দেশের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা মুখস্থবিদ্যার উপর নির্ভরশীল, শিশুদের সৃষ্টিশীলতাকে যেখানে গলা টিপে হত্যা করা হয় প্রাইমারী স্কুলের ভর্তি কোচিংয়েই, সেদেশে মানিক স্যার নামক হাতুড়েরা প্রাইভেট পড়িয়ে মাসে মাসে কয়েক লাখ টাকা উপরি আয় করবেন, সেটাই স্বাভাবিক।

আজ যখন ফিরে তাকাই পেছনে, দেখতে পাই যে সারা জীবন শুধু মুখস্থ করা ছাড়া আর কিছুই করিনি। যখন ফেল করেছি, বা ভাল নম্বর তুলতে পারিনি, সেটাও ছিল মুখস্থ করার অক্ষমতা। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেও ব্যাপারটা খুব একটা পাল্টায়নি প্রথমে। তখন আমার অভ্যাস ছিল- একেকটা প্রশ্নের উত্তর ২-৩ টা বই ঘেঁটে দাঁড় করানো, আর তারপর সেটাকে মুখস্থ করা এবং ২-৩ বার লিখে ফেলা। এর ফলে, স্বয়ং আজরাঈল এসেও সেই উত্তরটা আমার মাথা থেকে মুছতে পারবে কিনা সন্দেহ।

এহেন ‘পড়ালেখা’ করতে করতে একদিন কিভাবে যেন কোন একটা বিষয় ভাল লেগে গেল। বিষয়টা ছিল resnick-haliday-krane এর বইয়ে quark সম্পর্কিত একটা অনুচ্ছেদ। মুগ্ধ বিস্ময়ে আবিষ্কার করলাম যে এই কালো কালো অক্ষরগুলোর অর্থ আছে। এদেরকে মনোযোগ দিয়ে পড়লে অনেক মজার মজার জিনিস জানা যায়! এর পর থেকে আর কখনো মুখস্থ করিনি- সেটা বলা যাবেনা। বরং, মুখস্থ করা অব্যাহত ছিল আগের মতই।

কারণ, এছাড়া পরীক্ষা পাস করা সম্ভব না। স্বয়ং আইনস্টাইনও যদি আমাদের ডিপার্টমেন্টে কোন বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা দিতে বসতেন, সম্ভবত ফেল করতেন। এ ডিপার্টমেন্টে ১ম বর্ষে ছাত্ররা কেপলারের গ্রহ-নক্ষত্রের গতি সংক্রান্ত সূত্রের গাণিতিক প্রমাণ শিখে ফেলে। ক্রনিগ-পেনি মডেলের চার পাতার প্রমাণ নস্যি হয়ে যায় কিছুদিনের মধ্যেই। এহেন আইনস্টাইন-নিউটনদের তো পুরো পৃথিবী জয় করে ফেলার কথা! কিন্তু ঢাবি-জাবি’র শিক্ষক হওয়া আর তারপর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করা ছাড়া আর কিছুই করে উঠতে পারেনা এরা! আমাদের ডিপার্টমেন্টে কামরুল হাসান নামে একজন শিক্ষক আছেন।

তিনি গতানুগতিক প্রশ্নধারার বিরোধী। তাঁর প্রশ্ন করার পদ্ধতি হল- তিনি প্রায় ৫/৬ লাইন ধরে একটা বিষয় ব্যাখ্যা করবেন, যেখানে প্রশ্নটির উত্তর দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় সরঞ্জাম উপস্থিত থাকবে। তারপর তিনি প্রশ্নটি করবেন, এবং প্রশ্নটির উত্তর পেতে হলে কিভাবে অগ্রসর হতে হবে- সেটাও বলে দেবেন। কিন্তু, তাঁর প্রশ্নপদ্ধতি তাঁর সহকর্মীগণ বা ছাত্র-ছাত্রী- কারোরই তেমন পছন্দ ছিলনা। কারণ একটাই- তিনি লেকচার থেকে প্রশ্ন করতেননা! তাঁর ওই ৫-৬ লাইনের বাহারি প্রশ্ন দেখেই ছাত্ররা ভিরমি খেয়ে যেত! এমনতর প্রশ্ন তারা জীবনে কখনো চোখে দেখেনি! লেকচারে তো এমন কোন প্রশ্নোত্তর ছিলনা! ছাত্রদের মাথায় পুরো কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সব প্রশ্নের উত্তর ঠাসা; কিন্তু কোন উত্তরের প্রশ্ন এটা- সেটাই তো বোঝা যাচ্ছে না! প্রথম বর্ষে ভর্তি হবার পর মিলন মামা’র ক্যান্টিনের সামনে কামরুল হাসার স্যারের প্রতি বিষোদগার করা একটা পোস্টার পড়েছিলাম।

জানতে পারলাম, আমাদের সিনিয়র ব্যাচের মেকানিক্স পরীক্ষায় তিনি দাঁতভাঙা কঠিন প্রশ্ন করেছেন। আর তাই সবাই সে কোর্সটা ইম্প্রুভমেন্ট রেখে আসতে বাধ্য হয়েছে। কিছুদিন পরে সেই বিখ্যাত প্রশ্নপত্রটি হস্তগত হল। সাগ্রহে পড়ে দেখলাম। পড়তে পড়তে প্রশ্নের মধ্যেই ডুবে গেলাম।

“দুটো মাইক একে অপরের দিকে তাক করা। দুটোই একই গান বাজাচ্ছে। কিন্তু, গানটা কোথাও শোনা যাচ্ছে, আবার কোথাও শোনা যাচ্ছেনা। শব্দতরঙ্গের কোন ধর্মের কারণে এমনটি হচ্ছে? এ ধরনের তরঙ্গের নাম কি? এই তরঙ্গের বৈশিষ্ট্য ও ধর্ম ব্যাখ্যা কর”। তখনো আমি standing wave, interference- এসব কঠিন কঠিন শব্দ জানতাম না।

বিস্ময়ের সাথে বলে উঠলামঃ ‘স্থির তরঙ্গ!’ স্থির তরঙ্গের যে এরকম বাস্তব উদাহরণ থাকতে পারে- তা আমাকে কেউ কখনো বলেনি। আমি অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করলাম, যে ওই একটি প্রশ্নপত্র আমার পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ কয়েকগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে! মজার ব্যাপার হল, আমাদের সিনিয়র ব্যাচের ১ম বর্ষের মেকানিক্সে এহেন ‘ব্যর্থতা’-র কারণে তাঁকে সে কোর্স থেকে সরিয়ে দিয়ে কেমিস্ট্রির ছাত্রদেরকে একটা মাইনর কোর্স পড়ানোর দায়িত্ব দেয়া হয়। একদিন রসায়ন বিভাগের আমার এক বন্ধুর সাথে কোন একটা বিষয়ে কথা হচ্ছিল। vector analysis- সম্পর্কে তার অপরিসীম জ্ঞান দেখে আমি একটু ধাক্কা খেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুই এইগুলা কোত্থেকে জানসিস?’ ও বললো, ‘স্যার পড়াইসে’।

‘কোন স্যার?’... ‘কামরুল হাসান স্যার’! সেদিন সারাদিন আমার খুব মন খারাপ ছিল। কেমিস্ট্রির ছাত্ররা ভেক্টর এনালিসিস শিখেছে কামরুল স্যারের কাছ থেকে, আর আমরা জনৈক ম্যাডামের কাছ থেকে। প্রহসন আর কাকে বলে! যাই হোক, এর পরেও এ ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রতি বছর দু’একটা অংশুমান-সাব্বির বের হয়। রাকিব ভাই, তালাল ভাই কিংবা আরশাদ মোমেন ও বের হয় মাঝে-মধ্যেই। এত প্রতিকূলতার মধ্যেও দু’একটা মগজ যে কোন না কোন ভাবে ধোলাইয়ের হাত থেকে বেঁচে যাচ্ছে- সেটা পরম আশার সংবাদ।

বেঁচে থাকুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বেঁচে থাকুক ফিজিক্স ডিপার্টমেন্ট। বেঁচে থাকুন কামরুল হাসান স্যাররা।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।