আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জলদস্যুদের কবল থেকে সমুদ্রপথের নিরাপত্তা রক্ষায় পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন



জলদস্যুদের কবল থেকে সমুদ্রপথের নিরাপত্তা রক্ষায় পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন ফকির ইলিয়াস ======================================== জলদস্যুদের দ্বারা জাহাজগুলো আক্রান্ত হওয়ার সংবাদ নতুন নয়। বাংলাদেশের জাহাজ এমভি জাহান মণি সোমালিয় জলদস্যুদের দ্বারা অপহৃত হওয়ার পর গোটা দেশের মানুষ তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। বিভিন্ন মিডিয়া বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করে। বাংলাদেশের সরকারও অবস্থা নিরসনে নানা উদ্যোগের কথা জানায়। অপহৃত বাংলাদেশি নাবিকদের সবাই এখন পর্যন্ত মুক্তি পাননি।

বিশ্বের বিভিন্ন সমুদ্রপথে জলদস্যুদের এ উৎপাত বিশ্বের শান্তিকামী মানুষকে খুবই আতঙ্কিত করে তুলেছে। বিশেষ করে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ যারা জলপথে বড় ধরনের আমদানি-রপ্তানিতে নিয়োজিত, তাদের এ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য বিশেষভাবে ভাবতে হচ্ছে। 'সোমালিয় পাইরেটস' বলে পরিচিত এ জলদস্যু চক্রে শুধু সোমালিয়ানই নয়_ হাইতি, নাইজেরিয়া, তানজানিয়াসহ আফ্রিকার আর কিছু দেশের কুখ্যাত দস্যুচক্র এখন সংঘবদ্ধ হয়েছে। তারা গত বছর সালে মোট ৫৩টি জাহাজ ছিনতাই অথবা জিম্মি করেছে। ২০০৯ সালে তারা ৫১টি জাহাজ ছিনতাই করে।

এদের এ উৎপাতে যুক্তরাষ্ট্র খুবই শঙ্কা প্রকাশ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন মিডিয়ায় এদের দৌরাত্ম্য বন্ধে নানা উদ্যোগ নেয়ার সুপারিশও করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব জলদস্যু প্রতিনিয়ত তাদের দুর্বৃত্তপনার পদ্ধতি পরিবর্তন করছে। নোঙ্গর করা জাহাজেই তারা হানা দিত সচরাচর। এখন তারা চলমান জাহাজকে ধাওয়া করে সেসব জাহাজেও ঢুকে পড়ছে।

নাবিকদের জিম্মি করে মুক্তিপণ চাইছে। অস্ট্রেলিয়ার নৌবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন টনি এলডার্ড জানিয়েছেন, কিছু জলদস্যু একটি বড় জাহাজকে তাদের 'মাদারশিপ' (মূল্য যান্ত্রিকা জাহাজ) হিসেবে ব্যবহার করছে। সেই জাহাজ থেকে ছোট ছোট বোট ব্যবহার করে ছিনতাই কাজের মিশন পারিচালনা করছে। তার মতে, তারা আরব সাগর, আটলান্টিক মহাসাগরের প্রায় আড়াই মিলিয়ন স্কয়ার মাইলজুড়ে তাদের দুর্বৃত্ত রাজ্য বিস্তৃত করেছে। ২০১০ সালে এরা মোট ১৬০টি জাহাজ ছিনতাইয়ের প্রচেষ্টা চালায়।

২০০৯ সালে এ প্রচেষ্টা ছিল ১৪৫টি জাহাজের প্রতি। বাণিজ্যিক জাহাজ অপারেশন্সের দায়িত্বে নিয়োজিত কম্বাইন্ড মেরিন ফোর্সের কমান্ডার লুইস রেন্সেল জানিয়েছেন, বর্তমানে প্রায় ৩১টি জাহাজ এসব জলদস্যুর হাতে জিম্মি রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৬০০ নাবিক রয়েছেন, যারা অত্যন্ত ভয়াবহ জীবনযাপন করছেন বন্দীদশায়। এসব জলদস্যুর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মহল ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধের ডাক দিয়েছেন ইতোমধ্যে। ইয়ামেনের একটি উচ্চ আদালত ১৩ জন সোমালিয় কুখ্যাত জলদস্যুকে জনপ্রতি ১২ বছরের কারাদ- দিয়েছেন।

ইয়ামেনের নৌবাহিনী 'গালফ অব এডেন' এলাকা থেকে চোরাই বোটসহ অস্ত্রধারী এ চক্রটিকে ২০০৯ সালে পাকড়াও করে। অতিসম্প্রতি এ জলদস্যুচক্র ভারত মহাসাগর থেকে আলজিরিয়ার একটি বাণিজ্যিক জাহাজ ছিনতাই করেছে ২৭ জন নাবিকসহ। 'ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এন্টি পাইরেসি টাস্কফোর্স' জানিয়েছে এমভি বিস্নদা নামের এ জাহাজটি সুলতানাত অব ওমানের সালানাহ বন্দর ছেড়ে আসার পরপরই দস্যু আক্রান্ত হয়। জাহাজটি তানজানিয়া যাওয়ার কথা ছিল। এ জাহাজে আলজিরিয়া, ইউক্রেন এবং ফিলিপাইনের নাবিক রয়েছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সোমালিয়ায় গেল দুই দশকজুড়ে কোন কার্যকর শক্তিশালী সরকার না থাকায় এদেশের কিছু দুর্বৃত্ত বিশ্বের সমুদ্র অঞ্চলকে নিজেদের তালুক ভাবতে শুরু করেছে। তারা অবৈধভাবে এ মুক্তিপণ মুদ্রা আদায় করে অন্যান্য সন্ত্রাসী কর্মকান্ডেরও উৎস সৃষ্টি করছে এবং অর্থ জোগান দিচ্ছে। কিছুদিন আগে জার্মানির একটি তৈলবাহী জাহাজ হাইজ্যাক করে তারা প্রায় সাড়ে পাঁচ মিলিয়ন ডলার আদায় করে। 'মারিন্ডা মার্গারেট' নামক ওই জাহাজে ১৯ জন ভারতীয়, দুই জন বাংলাদেশি এবং একজন ইউক্রেনিয়ান নাবিক ছিলেন। জলদস্যুদের হানায় বিশ্বের সমুদ্র সীমানায় এই যে ছিনতাই ঘটনা ঘটছে তা রোধের উপায় কী? গেল তিন বছর আগে জাতিসংঘ অনুমোদন করেছিল এসব জলদস্যুর আস্তানায় আঘাত হানার অনুমোদন।

কিন্তু মূলত তা ধনী এবং শক্তিশালী দেশগুলোর গড়িমসির কারণে খুব একটা কার্যকর হয়নি। সেই অনুমোদনে জাতিসংঘ সম্মত হয়েছিল সোমালিয় এসব জলদস্যুর সব স্থল স্থাপনায়ও আক্রমণ করা যাবে। এখানে উল্লেখ করা দরকার, এসব জলদস্যুর গডফাদাররা সোমালিয়ার বিভিন্ন স্থলাঞ্চলেই বহালতবিয়তে বসবাস করছে। যারা মূলত জাহাজপ্রতি গড়ে পাঁচ মিলিয়ন ডলার আদায় করছে, তাদের শিকড় একেবারে দুর্বল নয়। এদের অস্ত্রের উৎসই বা কী? তারা অস্ত্রের জোগান পাচ্ছে কোত্থেকে? বিষয়গুলোও ভেবে দেখা দরকার বিশ্বের শান্তিবাদী রাজনৈতিক নেতাদের।

লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, জলদস্যুরা তাদের আক্রমণের গতিপথ বারবারই পরিবর্তন করছে। এখন তারা এরাবিয়ান গালফ, পূর্ব আফ্রিকান কোস্ট মোজাম্বিক, এমনকি ভারতীয় কোস্টকেও বেছে নিচ্ছে। গেল কয়েক বছর আগে এসব জলদস্যু একটি আমেরিকান বাণিজ্যিক জাহাজকে জিম্মি করে। এতে আমেরিকা খুবই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জলদস্যুদের সঙ্গে আলোচনার নামে ইউএস মেরিন কমান্ডো পাঠায়। ইউএস কমান্ডোরা বীরত্বের সঙ্গেই জাহাজ উদ্ধার করে এবং জলদস্যুদের কয়েকজনকে গ্রেফতার করে।

কয়েক জলদস্যু আক্রমণে মারাও যায়। গবেষকদের মতে, এরপর থেকে জলদস্যুরা আমেরিকান পতাকাবাহী কোন জাহাজ ছিনতাই থেকে বিরতই থাকছে। এদিকে জাতিসংঘ সমীক্ষায় বলা হয়েছে, সোমালিয়ায় দীর্ঘমেয়াদি গৃহযুদ্ধের কারণে প্রায় কয়েক লাখ গৃহহীন রয়েছে। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ উদ্যোগে এসব মানুষজনকে পুনর্বাসন এবং সাহায্যের চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু সেখানে পাশ্চাত্যের প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে 'হিজবুল ইসলাম' এবং 'আল শাবাব' নামের দুটি মুসলিম জঙ্গি সংগঠন।

আল শাবাব বহির্বিশ্বে জঙ্গি আক্রমণের জন্য সংগঠিত হয়ে প্ররোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রয়োজনে এরা সোমালিয়ার অভ্যন্তরেই মানুষকে জিম্মি করছে অস্ত্রের মুখে। সর্বোপরি এসব বর্বর হায়েনা চক্রকে দমনে বৃহৎ শক্তিগুলোর সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন বলেই মত প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। জলদস্যুরা বিশ্বের সমুদ্র সীমানায় যে আতঙ্ক এবং ত্রাস সৃষ্টি করেছে তা প্রতিরোধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সম্মিলিত টাস্কফোর্স জোরদার করা সময়ের জরুরি দাবি। কারণ জলপথ নিরাপদ না হলে বিশ্বে ব্যবসা-বাণিজ্য আরও চরম হুমকির মুখে পড়তে পারে।

নিউইয়র্ক, ১১ জানুয়ারি ২০১১ ---------------------------------------------------------------------- দৈনিক সংবাদ / ঢাকা / ১৪ জানুয়ারি ২০১১ শুক্রবার প্রকাশিত

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.