পাঁচ বছর পর পর এই দেশে ঈদ আসে, যেই ঈদটাকে বলা ভালো ভোটারদের ঈদ। অন্য বছরগুলোতেও ঈদ আসে, কিন্তু সেই ঈদ ভোটারদের নয়, এমপি-মন্ত্রী সাহেবদের ঈদ হয়ে আসে। এমপিরা সেসব ঈদেও এলাকায় আসেন, আসেন বড় গাড়ি চড়ে, তাঁর সামনে কর্মীদের মোটরসাইকেলের মিছিল, পেছনে গাড়ির বহর। এমপি সাহেব নিজের বাড়ি যান, পুরা বাড়ি গমগম করছে লোকে; সূর্যের চেয়ে বালুর তাপ বেশি, ঘনিষ্ঠ কর্মী তথা চামচারা নিয়োজিত থাকেন এমপিকে ঘিরে রাখার দায়িত্বে। আর নেতা যদি মন্ত্রী হন, তাহলে তো কথাই নাই, পুলিশ প্রশাসনের আরাম হারাম হয়ে যায়, ঈদ লাটে ওঠে।
সকাল থেকে পাড়ার বৃদ্ধা বিধবা হয়তো বাড়ির দাওয়ার এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর যুবক ছেলেটা সেই যে ছ মাস আগে হারিয়ে গেল, তার আর কোনো খোঁজ নাই, খবর নাই, মন্ত্রী বা এমপি কি পারেন না ছেলেটার কোনো হদিস বার করতে। তো সেই বিধবার কি উপায় আছে নেতার আশপাশে যাওয়ার? কে যাবে, কে যেতে পারবে—সব তো ঠিক করছেন কর্মীরা, তারও স্তরভেদ আছে। দুদিন ঘোরাঘুরি করে জয়নালের মা যেই না চিৎকার করে উঠেছেন, তাকে অমনি পাঁজাকোলা করে পাড়ার বাইরে রেখে এসেছে উদ্যমী কর্মীবাহিনী। অত বড় জোয়ান পোলা তোমার কি হারায়া গেছে নাকি, যাও দেখো গা, ঢাকায় কি বরিশালে কি ককসোবাজারে বিয়া করে শ্বশুরবাড়ির ফাইফরমাশ খাটছে। মন্ত্রী-এমপিরা করবেনই বা কী।
তাঁরাও তো মানুষ। রাজ্যের তদবির নিয়ে আসে মানুষজন। তিনি এলাকার সব কটা স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি। কত নিয়োগ, কত তদবির, কত বাণিজ্য! এলাকায় টেন্ডার আছে, হাট বা জলাশয়ের ইজারা আছে। আবার টেস্ট রিলিফের গম আসবে-যাবে।
বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা—সব এই এক বান্দাকেই তো সামাল দিতে হয়। তিনি করবেনটা কী? কাউকে দেন, কারোটা নেন, কাউকে মুখের কথায় সান্ত্বনা দেন, কাউকে জড়িয়ে ধরে কাঁদেন, কাউকে নিজের বেতনের টাকা পুরোটাই দান করে দেন। তবু এলাকার নেতা-কর্মীরা বলাবলি করেন, মূল্যায়ন হলো না। আসুক ভোট। আছে উপদলীয় কোন্দল।
অমুক মিয়া এবার নমিনেশনের জন্য জোর চেষ্টা করছেন। তাঁকে একটু ছেঁচা দিয়ে রাখা দরকার। অমুক আবার বিরোধী দল থেকে মাথাচাড়া দিচ্ছেন। তাঁকে একটু ডলা। এই সব করতে করতে নিজের দিকে তাকানোর তিনি সময় পান না।
তবু তাঁর টিনের ঘর দালান হয়ে যায়। তাঁর পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ভাঙা হাঁড়ি-পাতিলের ব্যবসাটা জাহাজের ব্যবসায় উন্নীত হয়। জাহাজও পানিতে ভাসে, হাঁড়ি-পাতিলও ভাসে। তফাতটা কী? ওদিকে জলবায়ু ফান্ডের টাকা আসবে কি আসবে না, টেনশন কি কম? এভাবেই কেটে গেল পাঁচটা বছর। এত দ্রুত সময় চলে যায়।
কেন যে যায়। আবার ইলেকশন এসে গেল সামনে। কেন যে এল। তিনি কি চিরদিনের জন্য এমপি থাকতে পারতেন না? সামনে নির্বাচন। তা আপনি এ দল থেকে মনোনয়ন চান কি ও দল থেকে, জনগণের কাছে তো আপনাকে যেতেই হবে।
কাজেই কি সরকারি নেতা, কি বিরোধী নেতা, কি স্থায়ী নেতা, কি মৌসুমি বসন্তের কোকিল—সবাই এবার ঈদে যাবেন এলাকায়। তবে সেখানেও কিন্তু টানাপোড়েন কম না। এলাকায় যাব, নাকি নেত্রী ঈদের দিনে যে গণসংবর্ধনা বা গুণী সংবর্ধনা দেবেন, সেটায় হাজিরা দেব। কোনোটার গুরুত্ব কম নয়। জনগণ ভোট না দিলে নমিনেশন পেয়েও লাভ নাই।
আবার নমিনেশন না পেলে জনগণের ভালোবাসা ধুয়ে কি পানি খাব। তাহলে এক কাজ করা যাক। ঈদের আগের দুটো দিন এলাকায়। তারপর ঈদের সকালে এলাকার ঈদগায় নামাজ আদায়। গণকোলাকুলি।
আবালবৃদ্ধযুবক। শিশুদের ভোট নাই, ওদের সঙ্গে কোলাকুলির দরকার নাই। বয়স্কদের পায়ে হাত দিয়ে কদমবুসি। তরুণীদের সালাম। তারপর দৌড় ঢাকা অভিমুখে।
নেত্রীর পার্টি ধরতেই হবে। নেত্রী কষ্ট করে দাঁড়িয়ে থাকবেন। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে হাতটা কচলাতে হবে। টিভি ক্যামেরাম্যানদের বলে রাখতে হবে, দৃশ্যটা যেন ভালো করে ধারণ করে। টিভিতে দেখালে এলাকার লোক দেখবে।
তারা বুঝে ফেলবে, কে এবার মনোনয়ন পাচ্ছে। আর আমরা যারা সাধারণ ভোটার, আমরা তো এক দিনের রাজা। ভোটের দিনটাই তো আমাদের দিন। তার আগে নেতারা আসেন, পাতি নেতারা আসেন, ব্যবসায়ীরা আসেন, আমাদের এলাকার ঈদগায় আমাদের কাতারে দাঁড়ায়, আমাদের সঙ্গে গলাগলি করেন, আমাদের ভালো লাগে। বিশ্বাস করুন, নির্বাচনের আগের এই সময় আমাদের খুব ভালো লাগে।
ঈদ তো চিরকালই আমাদের দিয়েছে মেলার আর মেলানোর সুযোগ। কবির ভাষায়:
সবার দুয়ার খোলা আজি কোথাও নাই মানা,
খাঞ্জা ভরে বিলাব আজ নানা রকম খানা।
...
কেউ যাবে না কারো ঠেলে
কেউ যাবে না কারো ফেলে
অন্যে যদি দুঃখ পায় খুশির কিছু নাই তাতে...
এমনই উদারতা নিয়ে, আনন্দ নিয়েই তো আমরা ঈদ করি প্রতিবছর। যানজট ঠেলেঠুলে কত কষ্ট করে টিকিট জোগাড় করে ট্রেনের ছাদে চড়ে লঞ্চের ছাদে চড়ে বাড়ি ফিরে যাই। ফিরে যাই মায়ের কাছে।
ফিরে যাই দাদার কবরের পাশে, ডালিমগাছের তলায়। মিলিত হই পুরোনো বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে। আমরা জানি, প্লেনের প্রথম আসনটা মন্ত্রী-এমপি সাহেবের জন্য কোটা করে রাখা। আমরা জানি, ট্রেনের এসি বগিটার টিকিট এমপি সাহেবের পরিবারের জন্য। আমরা জানি, গণতন্ত্রে সবাই সমান, সবার এক ভোট হলেও কেউ কেউ একটু বেশি সমান।
এভরি ম্যান ইজ ইকুয়াল বাট সাম আর মোর ইকুয়াল দ্যান আদারস। তবে নির্বাচনের আগে যে এই আকাশের তারারা নেমে আসেন মর্ত্যের মাটিতে, আমাদের কাছেই হাত পাতেন একটা ভোটের জন্য, একটু ভালোবাসার জন্য, ও ছোট ভাই, দোয়া করবেন বলার জন্য, সেটা আমাদের ভালোই লাগে। কী বলেন।
তাহলে আসুন, আমরাও সবাইকে বলি, ঈদ মোবারক। সবাই ভালো থাকুন।
ভালো থাকুক এই দেশটা। বেঁচে-বর্তে থাকুক আমাদের গণতন্ত্র। আমাদের এক দিন রাজা বনে যাওয়ার ভোট। আমাদের প্রজাতন্ত্র।
সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা।
আমাদের প্রতিদিন হোক ঈদের দিন। প্রতিটা ঈদ হোক নির্বাচনের আগের ঈদ।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।