ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজেট সরকারের সাড়ে চার বছরের উন্নয়নচিত্র এবার তুলে ধরা হয়েছে ডিজিটাল বিলবোর্ডে। কয়েক দিন ধরে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কের মোড়ে মোড়ে স্থান পাচ্ছে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নের তথ্যসংবলিত এসব বিলবোর্ড। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ডিজিটাল মুদ্রণ সুবিধার কারণে একযোগে সারা শহরে বিদ্যমান বিলবোর্ডের ওপর এসব প্রচার তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। 'উন্নয়নের অঙ্গীকার/ধারাবাহিকতা দরকার' শিরোনামের বিলবোর্ড প্রচারণায় আওয়ামী লীগকে পুনরায় ক্ষমতায় পাঠাতে জনগণের প্রতি আহ্বানও জানানো হয়েছে। তবে এ বিলবোর্ড প্রচারণায় সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অর্জন ও কর্মকাণ্ড স্থান পায়নি বলে অভিযোগ উঠেছে।
সরকার কিংবা আওয়ামী লীগের প্রচার সেলের পক্ষ থেকে এই প্রচারণার ব্যাপারে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। দলের নেতৃস্থানীয় অনেকে এ ব্যাপারে অবহিতও নন বলে জানা গেছে।
বিলবোর্ডগুলোয় সরকারের সাফল্য তথ্য তুলে ধরার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি লাগানো হয়েছে। কয়েকটি বিলবোর্ডে প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি এবং ভারতের কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। রাজধানীর বনানী, গুলশান, মহাখালী, মগবাজার রেলক্রসিং, মালিবাগ রেলক্রসিং, মৌচাক ও এর আশপাশ এলাকা, রামপুরা, আগারগাঁও বাসস্ট্যান্ড, মিরপুর ১০ নাম্বার গোলচক্কর, মতিঝিল, শ্যামলী, কল্যাণপুর, বিশ্ব রোড, শেরাটন মোড়, মগবাজার, গুলশান, পল্টন, দৈনিক বাংলা, ধানমন্ডি, আজমপুর, বিমানবন্দর সড়কসহ মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় এসব বিলবোর্ডে ছেয়ে গেছে।
ঈদ উপলক্ষে ভাড়া নেওয়া বিলবোর্ডেও সরকারি প্রচারণার তথ্যচিত্র তুলে ধরা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঈদ বাজারের পণ্য ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের এই হঠাৎ প্রচারে বেশ বিপাকেই পড়েছে। বিলবোর্ডগুলোয় খাদ্য নিরাপত্তা, কূটনৈতিক অর্জন, সামাজিক নিরাপত্তা, দারিদ্র্য বিমোচন, যুগান্তকারী পরিবর্তন, বিশুদ্ধ খাবার পানি, শিক্ষিত সমাজ, উন্নত জাতি, সবার জন্য শিক্ষা, যোগাযোগব্যবস্থার অগ্রগতি, ডিজিটাল বাংলাদেশ, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাসহ সরকারের বিভিন্ন অর্জনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
যা আছে বিলবোর্ডে : বিলবোর্ডে সরকারের মন্ত্রণালয়ভিত্তিক উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরা হয়েছে। 'কূটনৈতিক অর্জন' শিরোনামে কয়েকটি বিলবোর্ডে বলা হয়েছে, সৌদি আরবে ৬ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিককে বর্তমান সরকারের আমলেই বৈধতা দেওয়া হয়েছে।
একই শিরোনামে আলাদা বিলবোর্ডে বলা হয়, মালয়েশিয়ার ২ লাখ ৬৮ হাজার অনিয়মিত শ্রমিককে বৈধ করা হয়েছে। 'যোগাযোগব্যবস্থার অগ্রগতি' শিরোনামের বিলবোর্ডে বলা হয়েছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-ময়মনসিংহ হাইওয়ে চার লেনে উন্নীতকরণের কাজ প্রায় শেষ হয়েছে। 'যোগাযোগব্যবস্থার অসামান্য অগ্রগতি' শিরোনামের বিলবোর্ডে বলা হয়, মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজ অচিরেই শুরু হবে। এ ছাড়া বিমানবন্দর-যাত্রাবাড়ী এলিভেটেড এঙ্প্রেসওয়ে প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের গুণগান গেয়ে 'খাদ্য নিরাপত্তা' শিরোনামে বিলবোর্ডগুলোয় বলা হয়েছে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৩০% বৃদ্ধি করে ৩.৫ কোটি টন খাদ্য উৎপাদিত হয়েছে।
একই শিরোনামে অন্য আরেক বিলবোর্ডে বলা হয়, ২০০৬ সালের ২৬ লাখ টন খাদ্য ঘাটতির বিপরীতে বর্তমানে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। 'সামাজিক নিরাপত্তা' শিরোনামে একটি বিলবোর্ডে বলা হয়েছে, ২ লাখ ৪৭ হাজার ৫০০ জনকে বয়স্ক ভাতা দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ৯ লাখ ২ হাজার জনকে বিধবা ভাতা, ২ লাখ ৮৬ হাজার ৫০০ জনকে প্রতিবন্ধী ভাতা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচন শিরোনামে অন্য আরেক বিলবোর্ডে বলা হয়েছে, ভিজিডি কর্মসূচির আওতায় সাড়ে ৭ লাখ নারীকে ৩০ কেজি করে খাদ্যশস্য দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ওএমএস, ভিজিডি, ভিজিএফ, টিআর, কাবিখা ও খাদ্য নিরাপত্তা খাতে বছরে ৩ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।
'শিক্ষিত সমাজ, উন্নত জাতি' শিরোনামে বলা হয়েছে, সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়েছে। ১ হাজার ৬২৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। ৪৫ হাজার শিক্ষকের নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত মেয়েদের অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করা হয়েছে। 'সবার জন্য শিক্ষা' শিরোনামে একটি বিলবোর্ডে বলা হয়, বিগত চার বছরেই জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বিনামূল্যে ১১৯ কোটি পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হয়েছে।
'ডিজিটাল বাংলাদেশ' শিরোনামের বিলবোর্ডে বলা হয়, মোবাইল ও ইন্টারনেটের ব্যবহার সহজলভ্য হয়েছে। ৪ হাজার ৫৮২টি ইউনিয়নে তথ্যসেবা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। ২০ হাজার ৫০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বল্পমূল্যে ল্যাপটপ দেওয়া হয়েছে। 'আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা' শিরোনামের বিলবোর্ডে বলা হয়েছে, 'যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্য চলমান রয়েছে। ' প্রধানমন্ত্রীর কন্যা পুতুলের সঙ্গে গ্রুপ ছবি ব্যবহার করে তৈরি করা একটি বিলবোর্ডে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্বে অটিজম সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশের প্রস্তাব জাতিসংঘে গৃহীত হয়েছে।
অন্যের বিলবোর্ড, সরকারের প্রচার : সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, অধিকাংশ বিলবোর্ড কোনো না কোনো কোম্পানির বিজ্ঞাপনের ওপরই সাঁটিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানগুলো বার্ষিক চুক্তির ভিত্তিতে নামি কোম্পানিগুলোর কাছে যেসব বিলবোর্ড ভাড়া দিয়েছিল সেগুলোয় এখন সরকারি প্রচারের লেবেল অাঁটানো। ফলে বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানগুলো পড়েছে বিপাকে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী তারা বিলবোর্ডের পরের মাসের ভাড়া পাবে কি না এ নিয়ে সন্দেহের মধ্যে রয়েছে। কয়েকটি বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, তাদের না জানিয়ে এসব বিলবোর্ড লাগানো হয়েছে।
নগরী ঘুরে দেখা গেছে, শাহবাগের শেরাটন মোড়ের চারপাশে ২৬টি, মিরপুর ১০ নাম্বার গোল চক্করের চারপাশে ৩৭টি, আগারগাঁও বাসস্ট্যান্ড মোড়ে ৭টি বিলবোর্ডে সরকারের প্রচারের বিজ্ঞাপন সাঁটানো হয়েছে। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক আখতার হোসেন ভূঁইয়া বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। তিনি বলেন, সরকারের সাফল্যের কথা প্রচার করে বিলবোর্ড টাঙানো হলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।
প্রতিক্রিয়া : আওয়ামী লীগের এই প্রচারের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির মুখপাত্র মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, জনগণ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। 'উন্নয়নের' ফিরিস্তি দিয়ে কোনো লাভ নেই।
বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলাম মিয়া ও এম কে আনোয়ারও বলেন একই কথা। বিএনপি নেতারা বলেছেন, সরকারের উন্নয়ন শুধুই বিলবোর্ডে, বাস্তবে নয়। এ ধরনের মিথ্যা প্রচারসংবলিত বিলবোর্ড দিয়ে জনগণের মুখ ফেরানো যাবে না। সাড়ে চার বছরে সরকারের অপশাসন, দুর্নীতি ও ব্যর্থতার চিত্র জনগণ দেখেছে। তারা কোনো উন্নয়ন করেনি।
জাতীয় প্রেসক্লাবে সকালে 'অল কমিউনিটি ফোরাম'-এর আলোচনা সভায় ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, এখন তারা বিলবোর্ড দিয়ে বলছে, পুরো দেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে। পাঁচ সিটি করপোরেশনে সরকার সমর্থকদের ভোট না দিয়ে জনগণ সরকারের প্রতি 'অনাস্থা' জানিয়েছে।
দুপরে প্রেসক্লাবে ড্যাবের এক আলোচনা সভায় এম কে আনোয়ার বলেন, গত সাড়ে চার বছরে সরকারের অপশাসন, দুর্নীতি ও ব্যর্থতার চিত্র জনগণ দেখেছে। তারা কোনো উন্নয়ন করেনি। এখন বিলবোর্ডের মাধ্যমে উন্নয়নের ঢোল বাজাচ্ছে।
আমরা বলতে চাই, এ বিলবোর্ড দিয়ে কোনো লাভ হবে না। পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খানও বিলবোর্ডে প্রচারের কৌশল নিয়েছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, আইয়ুব খানকে এ ধরনের মিথ্যা প্রচারণার বিলবোর্ড রক্ষা করতে পারেনি। শেখ হাসিনাকেও কেউ রক্ষা করতে পারবে না।
এদিকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেছেন, বিলবোর্ডে ভুল তথ্য আছে তা বিএনপি প্রমাণ করতে পারবে না। বিএনপি মিথ্যাচারের মাধ্যমে মানুষের মাঝে যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে তা দূর করতেই বিলবোর্ডের মাধ্যমে বর্তমান সরকারের প্রচারণা।
তিনি বলেন, সরকারের উন্নয়নের কিছু চিত্র এতে তুলে ধরা হয়েছে। এটা দেখে বিএনপি নেতাদের ভয় পাওয়ার কী আছে। গতকাল পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট আয়োজিত জাতীয় শোক দিবসের আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।